অভিবাসী নারী শ্রমিকের অধিকার বনাম বঞ্চনা

0
117

সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই নারী-পুরুষের বৈষম্য তেমনভাবে প্রকট না হলেও এক বিশিষ্ট পর্যায়ে নারীই হয়ে যায় সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। প্রাচীন ইতিহাসবিদরা মনে করেন সভ্যতা যাত্রায় নারীর অবদান অভাবনীয়। কৃষি সভ্যতার বীজ বপন করেন নারীরাই। এ ছাড়া অবাধ স্বেচ্ছাচারে পিতৃপরিচয় চিহ্নিত না হওয়ায় মায়ের ভূমিকা হয়ে যায় গোষ্ঠীবদ্ধ জীবনের অন্যতম নির্ণায়ক। মায়ের গর্ভ থেকেই সন্তান পৃথিবীর আলো দেখত ফলে মাই ছিল নতুন প্রজন্মের আলোকিত অধ্যায়। বংশপঞ্জি থেকে শুরু করে সম্পত্তি সমর্পণ সবই ধরা হতো মায়ের দিক থেকে। ফলে পৃথিবীজুড়ে বিস্তার লাভ করা আদিম সমাজের বন্য এবং বর্বর দশায় মাতৃতান্ত্রিক পরিবার গড়ে উঠতে সময় লাগেনি। আর এটা চলতে থাকে সভ্যতা সূর্য উদয়ের প্রাক্কাল এবং অব্যবহিত পর অবধি। ঊনবিংশ শতাব্দীর দুই দিকপাল লুইস হেনরি মর্গার এবং ফ্রেডরিখ এঞ্জেলস অনেক ঐতিহাসিকের পর্যালোচনার সূত্র ধরে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে মেয়েদের এই সার্বভৌম ক্ষমতা অতি আদিম অবস্থায় পুরুষের তুলনায় কোনভাবেই কম ছিল না। তার চেয়েও বেশি নারী-পুরুষের বিভাজিত পর্যায়টি তখনও শুরু হয়নি। সভ্যতার আলোকরশ্মি যখন সারা পৃথিবীতে ছড়াতে থাকে সেই সুবর্ণ সময় নারী জাতির জন্য ছিল তমসাচ্ছন্ন অধ্যায়। কারণ খাদ্য সংগ্রহ অর্থনীতি যখন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় যুগান্তকারী রূপ নিল তখন সম্পদের সুষমবণ্টন হয়ে গেল। কুক্ষিগত আর মজুদ করার অন্য রকম ধারার শৃঙ্খলিত। ব্যক্তি সচেতনতা বোধ তৈরি হলো, নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করার অভিপ্রায় নতুন সভ্য হওয়া মানুষ শারীরিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশ নারীকে বশীভূত করার প্রচেষ্টায় মনোযোগী হলো। ফলে নারী তার সর্বময় ক্ষমতা আর কর্তৃত্ব হারাতে বসল। যা তারা আর কখনও ফিরে পায়নি।

নারী জাতির ঐতিহাসিক পথচলা সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের ধারায় এগিয়ে চললেও সামাজিক বৈষম্যের আবর্ত থেকে নিজেকে মুক্ত করা আজ অবধি সম্ভব হয়নি। ঘরে-বাইরে সবক্ষেত্রেই এই ফারাক মেনে চলতে বাধ্য হচ্ছে। নারী অভিবাসী শ্রমিক ব্যাপারটিও সেই আদি যুগ থেকে চলে আসা একটি সামাজিক ব্যবস্থা যা সময়ের দুর্বার মিছিলেও নিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে। সভ্যতাবিবর্জিত যুগেও মানুষ এক স্থান থেকে অন্য জায়গায় শুধু ঘুরেই বেড়াত না অস্থায়ীভাবে বসতিও স্থাপন করত। আর তাই পুরাকালের সামাজিক নিয়মের মধ্যে এই অভিবাসী বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। আধুনিক সময়ে আরও যুগোপযোগী হয়ে এর বিস্তার এখন দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশমান যুগে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি বড় নিয়ামক শক্তি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। সমকালীন সময়ের বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অভিবাসী প্রত্যয়টি নির্দিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক গতিধারায় অন্যতম চালিকাশক্তি। এক সময় উন্নত চাকরি এবং উচ্চতর ডিগ্রী অর্জনের জন্য দক্ষ পুরুষরা বিদেশে পাড়ি জমাতেন। সেখানে মেয়েদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনার মতো। কিন্তু উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় দেশ যখন সামগ্রিক সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে অর্ধাংশ নারী জাতিও সেখানে কোনভাবেই পিছিয়ে থাকছে না। এমন এক সময় ছিল যখন মেয়েরা শুধু স্বামীর সঙ্গেই বিদেশে পাড়ি জমাত। যেখানে নিজেদের যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলার কোন তাগিদই ছিল না। সময় পাল্টেছে মেয়েরা এখন শুধু শিক্ষায়ই নয় উচ্চতর ডিগ্রী, ব্যবসা বাণিজ্য এবং চাকরির সুবাদে বিদেশে যেতে আগ্রহী হচ্ছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে শ্রম অভিবাসন কর্মসূচীর আওতায় নারী শ্রমিকরা অন্যান্য দেশে নিজের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে উদ্যোগী হচ্ছে। ’৯০-এর দশক থেকে শুরু হওয়া নারী শ্রমিক অভিবাসীর কর্মযাত্রা অন্য দেশে তাদের ঠিকানা করে দিচ্ছে। একেবারে প্রথমে এই সংখ্যা এত কম যে উল্লেখ করার মতোই নয়। পরবর্তীতে সরকার কর্তৃক গৃহীত অভিবাসন নীতিমালায় নারী শ্রমিকের অন্তর্ভুক্তিকরণ একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এর পরবর্তী ধাপ নারী শ্রমিকদের কর্মী হিসেবে বিদেশ গমনের এক নিরন্তর অভিযাত্রা। এতে সংখ্যায়ই শুধু বাড়ছে না, কর্মক্ষেত্রের সম্ভাবনাময় পর্যায়গুলোও প্রতিনিয়তই প্রসারিত হচ্ছে। এক সময়ে নিজ দেশে যেমন একইভাবে বিদেশেও পেশা হিসেবে নারীদের পছন্দের তালিকায় ছিল চিকিৎসক, শিক্ষক কিংবা মানব সেবামূলক কিছু পর্যায়। কিন্তু যুগের দাবিতে মেয়েরা কর্মক্ষেত্রের পরিধিকে ক্রমান্বয়ে বাড়িয়ে তুলছে যা দেশে-বিদেশে তাদের অবস্থানকে শক্ত আর মজবুত করছে। যে কোন কর্মপরিকল্পনায় শুভ-অশুভের যে মেলবন্ধন অভিবাসীর ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। ফলে দেশে যেমন নারী নির্যাতনের প্রকোপ বৃদ্ধি পেয়েছেÑ একইভাবে ভিন দেশেও মহিলা শ্রমিক নানা সহিংস ঘটনার মোকাবেলা করছে। শুরু হয় একেবারে গোড়া থেকে। দেশে থেকে বিদেশ পাড়ি দেয়ার আনুষ্ঠানিক সমস্ত বৈধ নীতিমালা অনুসরণ করা। ইতোমধ্যে সরকার ‘প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান’ নামে একটি মন্ত্রণালয় সংযুক্ত করেছে। ফলে সরকারীভাবে নারী শ্রমিকের বিদেশ গমন এবং সেখানে নিজেদের কর্মক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করার ব্যাপারে কোন ধরনের সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। আর বেসরকারী অননুমোদিত ‘পাচার চক্রে’র খপ্পরে পড়ে নারী অভিবাসী কর্মীদের যে দুর্বিপাকে পড়তে হয় তা বর্ণনায়ও আসে না। ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের নারী শ্রমিকের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় পুরো ব্যাপারটি এখন আর সরকারের নিয়ন্ত্রণেও নেই। বাংলাদেশের দরিদ্র্যপীড়িত নারীরা তাদের সহায় সম্বল ও পরিবারকে জিম্মি রেখে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে অধিক অর্থ আয়ের লক্ষ্য নিয়ে। সুষ্ঠু সমন্বিত অভিবাসী প্রক্রিয়া আজ পাচার আর দালালচক্রের কঠোর শৃঙ্খলের আবর্তে পড়ে নারীরা অসহায়ভাবে শুধু কর্মক্ষেত্রই হারাচ্ছে না অত্যন্ত নৃশংসভাবে সম্ভ্রমকেও বিসর্জন দিতে হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার আদায় সংক্রান্ত বিধির উল্লেখ থাকলেও বিভিন্ন চক্রের খপ্পরে পড়া নারী শ্রমিকরা শ্রমবাজারের বৈধ অবস্থান থেকে অনেক দূরে। নিয়ন্ত্রণহীন এই সমস্ত অবৈধ চক্র নারীদের কর্মক্ষেত্রে বিনিয়োগ করার বদলে একেবারে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে কোন ধনাঢ্য ব্যক্তি কিংবা সমাজবহির্ভূত প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করে দেয়। যেখানে এসব নিগৃহীত মেয়ের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তো বটেই মানসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকাও দুঃসহ হয়ে পড়ে। তবে বৈধ প্রক্রিয়ায় কর্মসংস্থানের সুযোগ নিয়ে যারা অন্য দেশে যায় তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের পেশাগত জীবন নির্বিঘ্ন ভাবে চালিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রয়োজনীয় ভূমিকা রাখছে। যাতে বাংলাদেশে বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের বেশকিছু অংশ নারী অভিবাসী শ্রমিকদের কষ্টার্জিত আয়ের উৎস বলাই যেতে পারে। এখন নারীরা বিদেশে উন্নত মানের চাকরির চেয়েও বেশি নিয়োগ পায় গৃহকর্মী হিসেবে। সেখানে পারিবারিক সমস্ত কাজকর্ম সম্পন্ন করে গৃহকর্তার মনোরঞ্জন করাও তার প্রতিদিনের কাজের উল্লেখযোগ্য অংশ। নিরক্ষর, স্বল্প শিক্ষিত, অদক্ষ, হতদরিদ্র নারীরা যখন অযোগ্য বিবেচনায় পরদেশে গৃহশ্রমিকের দায়িত্ব নেয় তখন এমনতর উপদ্রবই উপহারের শামিল। পিছিয়ে পড়া এসব হতভাগ্য নারী কি নিজ দেশে এর চেয়ে বেশি ভাল থাকে? এখানেও বালিকা কিংবা কিশোরী নারী কর্মী কতখানি নিরাপদ, অধিকারসম্পন্ন কিংবা শঙ্কামুক্ত? এসব বিপন্ন গ্লানিকর জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে দেশে-বিদেশে কোথাও স্বমর্যাদায় নিজেদের টিকিয়ে রাখা মুশকিল হবে। নিজেকে শিক্ষিত, যোগ্য, সচেতন এবং দক্ষ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে না পারলে নিজের মৌলিক অধিকারকে নাগাল পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।