আঁকা বাঁকা পথ বেঁয়ে মেঘ পাহাড়ের দেশ বান্দরবান

0
378

শফিউল আজম॥
পাহাড় ঘেরা নৈসর্গিক বান্দরবানে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকরা এসে ভিড় করছেন। পাহাড়ের আকাঁবাকাঁ ও উঁচু নিচু পথ বেঁয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত স্থানীয় চাঁদের গাড়ীগুলো পর্যটক বহন করে দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে বড় বড় গাড়ী নিয়ে বান্দরবান শহর পর্যন্ত গেলেও ঝুঁকিপূর্ণ ও সরু পাহাড়ী রাস্তার নিরাপদ বাহন হিসেবে স্থানীয় চাঁদের গাড়ীগুলোই পর্যটকদের অন্যতম বাহন। পাহাড়ী উঁচু নিচু ও সরু পথের নিরাপদ বাহন ও চালকদের অভিজ্ঞতার কারণে বান্দরবানের সুন্দর পিকনিক ষ্পটগুলোর মধ্যে চিম্বুক পাহাড়, নীলগিরি, বগা লেক, নীলাচল, শৈল প্রপাত, জীবন নগর পাহাড়, মিরিঞ্চা, আলী সুড়ঙ্গ, তাজিংডং বিজয়, কেওক্রাডং, ক্যামলং জলাশয়, উপবন লেক, কানাপাড়া পাহাড়, স্বর্ণ মন্দির, মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স, প্রান্তিক লেক, শ্রভ্র নীল অন্যতম ।

সুউচ্চ পাহাড়, সবুজ বনানী, ঘন মেঘমল্লার দল, বাহারি রংয়ের আকাশ, সাঙ্গুর বহতা স্রোত, দুর্গম অরণ্য ঘেরা হাজারো ঝরনা ধারায় বেঁচে থাকা পাহাড়- সব মিলিয়ে প্রকৃতির লীলাভূমি বান্দরবান। পাহাড়ে ঘেরা মনোমুগ্ধকর নানা দৃশ্যপটে ভ্রমণকারীর দু’চোখ ক্ষণে ক্ষণেই আটকে যাবে। হৃদয় দোলানো রূপের মাদকতায় যে কেউ বিভোর হয়ে যাবেন নিশ্চিত। তাই বান্দরবানকে অনেকেই রূপের রাণী বলে থাকেন। আবার কেউ কেউ একে পাহাড়ী কন্যাও বলেন।
বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলোতে সব সময় পর্যটকদের উপচে-পড়া ভিড় থাকে। যে কোনো মৌসুমের শুরুতেই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বান্দরবানে হাজার হাজার পর্যটক ভিড় জমান। শহরের হোটেল-মোটেল, রেস্ট হাউসগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। প্রতিদিনই পর্যটন শহর বান্দরবান এখন মানুষের মিলন মেলা, হাজারো মানুষের সরব উপস্থিতিতে মুখরিত হয়ে উঠেছে।
বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা সভা সমিতির ব্যানারে পর্যটকরা ছুঁটছে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে। ওখানে শিক্ষা সফরে যাওয়া পটিয়া সেন্ট্রাল কলেজ এর একদল শিক্ষার্থীকে দেখা যায়। কথা হয় কলেজের প্রভাষক মো: রফিকুল ইসলামের সাথে। তিনি জানান কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পর পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ পাহাড় ঘেরা বান্দরবান। আমাদের কলেজের প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী বান্দবানে শিক্ষা সফরের উদ্দেশ্যে এসেছেন। শিক্ষার্থীরা এখানে এসে পাহাড়ি সুন্দর্য দেখে খুবই অভিভুত। আসলেই বান্দরবানের পাহাড় সত্যিই অসাধারণ।
চিম্বুক পাহাড়
বান্দরবানের অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান চিম্বুক পাহাড়। পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত এবং সূর্যোদয়ের সৌন্দর্য দেখতে যেতে পারেন চিম্বুক পাহাড়ে। চিম্বুককে বাংলার দার্জিলিং হিসেবেও ডাকা হয়। চিম্বুকের চমৎকার দৃশ্য আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে। যাত্রাপথের আঁকা-বাঁকা রাস্তা আপনাকে রোমাঞ্চিত করবে। আর নিচ দিকে তাকালে মনে হবে আপনি সাদা মেঘের মাঝখানে ভেসে আছেন।
চিম্বুক পাহাড় যেতে হলে ঢাকা থেকে বাসে যেতে পারেন বান্দরবান। ঢাকার আরামবাগ, গাবতলিসহ বিভিন্ন জায়াগা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এসি বাসে যাতায়াত ভাড়া লাগবে প্রায় ৬৫০ টাকা। পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১০ ঘণ্টা। বান্দরবান যাওয়ার পর আপনি চাঁন্দের গাড়ি/জিপ/মাইক্রোবাস/পাবলিক বাস যোগে বিভিন্ন জায়াগায় যাতায়াত করতে পারেন।
কেওক্রাডং
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ছোটবড় পাহাড়, ঘন জঙ্গল আর বিভিন্ন ধরনের পশু-পাখিতে ভরপুর দুর্গম এলাকাটিতে আরও রয়েছে ঝর্ণাধারা, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথ এবং আকাশে মেঘের লুকোচুরি। শীতের মৌসুমে রোমাঞ্চপ্রিয় পর্যটকরা ছুটে যায় কেওক্রাডং দেখতে। আপনিও অবাক হয়ে যাবেন সেখানের সৌন্দর্যে।
ঢাকা থেকে বান্দরবান, বান্দরবান থেকে চান্দের গাড়িতে রুমা উপজেলা, রুমা বাজার থেকে প্রায় ২৫০০ টাকায় চান্দের গাড়িতে করে বগা লেক পর্যন্ত যাবেন। বগা লেক থেকে জদিপাই ঝর্ণায় পৌঁছানোর জন্য একজন গাইড নিতে হবে। গাইড ভাড়া দিন প্রতি প্রায় ৬০০ টাকা, ততক্ষণে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। আর তাই রাতটা আপনাকে বগালেকে কাটাতে হবে। পরদিন ভোরে যাত্রা শুরু করতে হবে দার্জি পাড়ার উদ্দেশ্যে, সেখানে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিতে হবে কেওক্রাডংয়ের উদ্দেশ্যে। কেওক্রাডং পৌঁছে সেখানে সময় কাটিয়ে রওনা দিতে পারেন জাদিপাই ঝর্ণার উদ্দেশ্যে।
মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স বান্দরবানের বিশেষ আকর্ষণ মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স। সেখানে রয়েছে কৃত্রিম হ্রদ, শিশুদের জন্য পার্ক, সাফারী পার্ক, কিছুক্ষণ জলে ভাসার জন্য রয়েছে পেডেল বোট, ঝুলন্ত ব্রিজ, চিড়িয়াখান এবং পিকনিক করার জন্য পিকানিক স্পটও। মেঘলায় চিত্ত বিনোদনের বিভিন্ন ধরনের উপকরণ আপনাকে অবশ্যই মুগ্ধ করবে।
এখানে যেতে হলে ঢাকা থেকে বাসে যেতে পারেন বান্দরবান। ঢাকার আরামবাগ, গাবতলিসহ বিভিন্ন জায়াগা থেকে বান্দরবানের উদ্দেশ্যে বাস ছেড়ে যায়। এসি বাসে যাতায়াতে ভাড়া লাগবে প্রায় ৬৫০ টাকা। পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১০ ঘণ্টা। বান্দরবান যাওয়ার পর আপনি চাঁন্দের গাড়ি/ মাইক্রোবাস/পাবলিক বাস যোগে বিভিন্ন জায়াগায় যাতায়াত করত পারেন। বান্দবান শহর থেকে চান্দের গাড়ি বেবি টেক্সি, জিপ যোগে যাওয়া যায় মেঘলা পর্যটন কেন্দ্রে।
বগা লেক
বগালেক প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্টি হওয়া পাহাড়ের উপরে একটি লেক। যার পানি স্তর সারা বছরই প্রায় একই অবস্থানে থাকে। এখানে যেতে হলে ঢাকা থেকে বাসে যেতে পারেন বান্দরবান। এসি বাসে যাতায়াত ভাড়া লাগবে প্রায় ৬৫০ টাকা। পৌঁছাতে সময় লাগবে প্রায় ১০ ঘণ্টা। বান্দরবান যাওয়ার পর আপনি চাঁন্দের গাড়ি/জিপ/মাইক্রোবাস/পাবলিক বাস যোগে বিভিন্ন জায়াগায় যাতায়াত করতে পারেন। আপনি যদি শুষ্ক মৌসুমে বগালেক যেতে চান, তাহলে বান্দরবান থেকে প্রায় ৭৫০০ টাকায় চান্দের গাড়ি ভাড়া করে যেতে পারেন। আলী সুড়ঙ্গ
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার গহীন অরণ্যেও অবস্থিত এক রহস্যময় গুহা আলু সুড়ঙ্গ। হাতে টর্চ জালিয়ে সিড়ি বেয়ে সুড়ঙ্গের ভিতরে নামার সময় অনুভব করবেন এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। শত পথ পাড়ি দিয়ে পর্যটক প্রতিনিয়ত ছুটে আসে সুড়ঙ্গ দেখতে।
উপবন লেক
উপবন লেক একটি কৃত্রিম হ্রদ। মাছ ধরার শখ অথবা নেশা থাকলে কিংবা বান্দরবনে গিয়ে নৌকা ভ্রমণ করতে চাইলে যেতে পারেন উপবন লেকে। লেকটি ইকোট্যুর এবং পিকনিক স্পট হিসেবে সমাধিক পরিচিত।
তাজিংডং পাহাড়
স্থানীয়দের ভাষায় তাজিং অর্থ বিশাল আর ডং অর্থ পাহাড় অর্থাৎ তাজিংডং মানে বিশাল পাহাড়। বালাদেশের সর্বোচ্চ পাহাড় তাজিংডং পাহাড়। সেখানে গেলে দেখতে পাবেন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি আর শুনতে পাবেন প্রাকৃতিক পরিবেশে তাদের টিকে থাকার গল্প। পাহাড়ের যে দিকেই তাকাবেন আপনি মুগ্ধ হয়ে যাবেন। সৌন্দর্য ভালভাবে দেখতে হলে যেতে হবে শীতকালে। তাজিংডং-এর পৌঁছানোর হাঁটার রস্তার স্মৃতিও অম্লান হয়ে থাকবে আপনার হৃদয়ে। বান্দরবান যাওয়ার পর আপনি চাঁন্দের গাড়ি/জিপ/মাইক্রোবাস/পাবলিক বাস যোগে বিভিন্ন জায়াগায় যাতায়াত করত পারেন। চান্দের গাড়িতে করে তাজিংডং-এর কাছাকাছি যেতে পারবেন। তারপর পায়ে হেঁটে যেতে হবে। বান্দরবান থেকে রুমা ব্রিজঘাট, সেখান থেকে নৌপথে রুমায়, রুমা থকে বগা লেক বগা লেক থেকে পায়ে হেঁটে যেতে হবে তাজিংডং।
নীলাচল
সমগ্র বান্দরবান শহরে চোখবুলিয়ে নিতে চাইলে যেতে পারেন নীলাচল। নীলাচলকে অনেকেই স্বর্গভূমি হিসেবেই আখ্যা দিয়ে থাকেন। নীলাচলের নির্মল বাতাসে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের দৃশ্য আপনাকে এক স্বর্গীয় অুভূতি এনে দিবে।

পর্যটকদের থাকার জন্য নীলাচলে কটেজ রয়েছে। এছাড়া আপনি ইচ্ছে করলে বান্দরবানে ফেরত এসে হোটেলে থাকতে পারেন। বান্দরবান সদর এবং চিম্বুক এলাকায় থাকার জন্য বিভিন্ন হোটেল এবং গেস্টহাউজ রয়েছে।
নীলগিরি
নীলগিরি পর্যটন কেন্দ্রটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। এখানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করে দিবে। এখানে দাঁড়িয়ে উপভোগ করত পারবেন শীতকালের মিষ্টি রোদ, বর্ষাকালে আকাশের গর্জন, রংধনুর আলোক রশ্মি, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক পরিবর্তন, যা আপনাকে সারা বছরই নীলগিরি যাওয়ার জন্য আকর্ষণ করবে। এখনে দাঁড়িয়ে দেখতে পাবেন সাগর ও জহাজের দৃশ্য। পাহাড়ের কোল ঘেষে বয়ে চলা নদীর দৃশ্য। অনেকের কাছে নীলগিরি বাংলার দার্জিলিং নামেও পরিচিত। নীলগিরিতে অবস্থান ও থাকতে চাইলে আগাম যোগাযোগ করে যাওয়াই ভালো। এখানে থাকার জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত মেঘদূত, আকাশনীলা, নীলাঙ্গনা, মারমা হাউজসহ নানা নামের আকর্ষণীয় কটেজ রয়েছে। আছে একটি ক্যাফেটেরিয়াও।
স্বর্ণ মন্দির
সোনালী রংয়ের মন্দিরটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে জায়গাটি তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। মন্দিরটির নির্মাণ শৈলী ও আধুনিক স্থাপত্য নকশার নিদর্শনের জন্য পর্যটকদেরকে আকর্ষণ করে। এখান থেকে সাঙ্গু নদী এবং তার পারিপার্শ্বিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন।