আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ সাধনে রমজান

0
163

nc ramadanএক সময় পুকুরটি ছিল পুরো জনপদের পানির উৎস, প্রাণ ও জীবনের স্পন্দন। কিন্তু নানা অনাচারে এখন নষ্ট, হাজামজা ডোবায় পরিণত হয়েছে। মানুষের তাই কষ্টের সীমা নেই। বিরাট পুকুরের পাড় ভেঙে অনেক নালা হয়েছে। বাইরের নর্দমার পচা পানি ঢুকে হরদম সেই নালা দিয়ে। পুকুর সংস্কারের উদ্যোগও ব্যর্থ হয়েছে। এদিকে পুকুরের সংস্কার না হওয়ায় জনগণের দুর্দশা কাটছে না। বিজ্ঞজন বললেন, আগে পুকুর পাড়ের নালা বা সুড়ঙ্গ বন্ধ করে বাইরের পচা পানি ঢোকা বন্ধ করেন। তারপর আগাছা, কচুরিপানা পরিষ্কার করেন। আর হাজামজা পানি সবটুকু সেচে বাইরে ফেলে দেন। অনেক দিন পর সূর্য তার প্রখর রোদ দিয়ে উত্তাপ ছড়াক পুকুর তলার মাটিতে। দেখবেন বর্ষার নতুন পানিতে পোনা ছাড়লে মাছের ভালো চাষ হচ্ছে। আর যদি পচা পানির সঙ্গে পুকুর তলার কাদামাটিও সরিয়ে ফেলেন দেখবেন নিচ থেকে স্বচ্ছ নির্মল পানি বের হচ্ছে ঝরনার মতো। এবার পুকুরের পাড় খুলে দেন। ঝরনার সেই পানি প্রবাহিত হবে পুরো লোকালয়ে। নতুন জীবনে প্রাণ স্পন্দনে শিহরণ বয়ে যাবে জনপদে।

মানুষের ভেতরের যে সত্তা প্রাণ-মন-আত্মাকে নিয়ে যে মানবসত্তা, তাকে যদি কল্পনা করা হয় পুকুরের সঙ্গে, বলতে হবে বস্তু জগতের নানা অনাচারে মনের পুকুর নষ্ট হয়ে ডোবায় পরিণত হয়েছে। এর সংস্কারের জন্য প্রথম প্রয়োজন পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পথে বাইরের পচা দুর্গন্ধময় পানির প্রবেশ বন্ধ করতে হবে নির্দিষ্ট কিছু দিনের জন্য। এর মধ্যে ভেতরের আবর্জনা, কচুরিপানা, কাদামাটি তুলে বাইরে ফেলে দিতে হবে। মুখ বন্ধ রাখতে হবে। পানাহার বর্জন করতে হবে বছরের এক মাস। দিনের বেলা মানুষকে পথহারা করার শয়তানি হাতিয়ার যৌনতাকে দমন করতে হবে বৈধ স্ত্রীর সংসর্গ ত্যাগ করে। মিথ্যা কথা ও কাজ বর্জন করার সাধনা করতে হবে দীর্ঘ এক মাস। এভাবে মনের পুকুরের তলদেশ সম্পূর্ণ পাকসাফ হলে আকাশ থেকে আল্লাহর নূরের তাজালি্ল বিচ্ছুরিত হবে। মন হয়ে যাবে কলুষতামুক্ত, গোনাহ মাফ হবে। আল্লাহর রহমতে মনের জমিন সিক্ত হবে। তারপর ভেতর থেকে আধ্যাত্মিক ঝরনাধারা প্রবাহিত হবে। মন সুন্দর হবে, জীবন মহিমান্বিত হবে। চরিত্রের মাধুরী ছড়িয়ে পড়বে সমাজে। সেই রোজাদারের মারফত আল্লাহর রহমতের সওগাত অবারিত হবে সমাজের জন্য।

মন ও জীবনকে এভাবে সংস্কার, সাজানোর অপর নাম তাকওয়া। তাকওয়ার জন্যই আল্লাহপাক রমজানের রোজা ফরজ করেছেন_ এ ঘোষণা পবিত্র কোরআনের। অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় রোজার আলাদা বিশেষত্ব হচ্ছে দীর্ঘ ৩০ দিনের সিয়াম সাধনা বান্দাকে আল্লাহর একেবারে সানি্নধ্যে নিয়ে যায়। হাদিসে কুদসিতে আল্লাহপাক বলেন, বনি আদমের প্রত্যেক নেক আমলের সওয়াব দেয়া হবে ১০ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত। আমলের শুদ্ধতা ও নিষ্ঠার অনুপাতে এ সওয়াব বরাদ্দ। কিন্তু রোজা এর ব্যতিক্রম। আল্লাহ বলেন, রোজার সওয়াব এভাবে দেয়া হবে না। রোজা একান্ত আমার জন্য এবং আমি নিজেই তার সওয়াব দেব। অথবা রোজার বদলায় আমি নিজেই বান্দার হয়ে যাব।

মহামহিম আল্লাহর নৈকট্য ও একান্ত সানি্নধ্য লাভের এ সুযোগ এনে দেয় রমজান সবার জন্য। আল্লাহর সানি্নধ্যের এ সাধনায় কৃতকার্যতার জন্য পার হতে হয় কয়েকটি স্তর। প্রথম স্তর সাধারণ রোজাদারের। মাহে রমজানে দিনের বেলা পানাহার ও যৌন সংসর্গ থেকে বিরত থাকলেই বলা হবে লোকটি রোজা পালন করছেন। কিন্তু রোজা পালন করলেই হবে না, আল্লাহর দরবারে কবুল হওয়ার জন্য মানতে হবে অতিরিক্ত নিয়ম। হাত, মুখ, কান, নাক বা পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে নিয়োজিত করতে হবে রোজা পালনে। প্রিয় নবী বলেছেন, যে ব্যক্তি রোজা রাখল, অথচ মিথ্যা কাজ ও কথা ত্যাগ করল না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ কাজেই এ স্তরের রোজাদার হতে হলে সাধনার প্রয়োজন। নিজের পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে মন্দ কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে বিরত রাখতে হবে। শেষ স্তরে গিয়ে আল্লাহর প্রিয় হওয়া বা সরাসরি আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব নেয়ার জন্য প্রয়োজন মনের জমিনকে সম্পূর্ণ আগাছামুক্ত করা। অন্য কথায়, আল্লাহ ছাড়া সবকিছু থেকে খালি করা, তখনই আল্লাহর অবারিত রহমত ছেয়ে ফেলবে। সেই মন রোজাদারের জীবন। আল্লাহপাক কিসে রাজি বা খুশি তা পালন আর আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন এমন বিষয় বর্জন করতে হবে। আল্লাহর ফয়সালায় সদা সন্তষ্টচিত্ত থাকতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন, সবর বা ধৈর্যের পরাকাষ্ঠা। হাদিস শরিফে এরশাদ হয়েছে, যে রোজা রাখে সে যেন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে, ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ গায়ে পড়ে তার সঙ্গে ঝগড়া বাধায় তাতেও সে প্রতিক্রিয়া দেখাবে না, বরং বলবে, ‘আমি রোজাদার।’ যারা এই স্তর ও মানের রোজা রাখতে পারবে, আশা করা যায়, তারা তাকওয়ার গুণে গুণান্বিত হতে পারবে, আল্লাহর প্রিয়জন হবে। আল্লাহর অলিদের খাতায় তাদের নাম লেখা হবে। এর জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন আমাদের মনের জাগৃতি, আল্লাহতে সমর্পিত হওয়ার শানিত চেতনা। তখনই রমজানে কোরআন তেলাওয়াত, তারাবি, তাহাজ্জুদ ও ইবাদতের জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। রমজানে ঈমানের বসন্তে জেগে ওঠুক আমাদের মন, জীবন, দেশ ও গোটা জাহান।