আবরার হত্যাকাণ্ড: ছাত্রলীগ নেতা অমিতসহ গ্রেফতার আরও ৩

0
140

বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় তার রুমমেট মো. মিজানুর রহমান, আলোচিত ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা এবং এজাহারভুক্ত আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহাকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ।

এ নিয়ে ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হল। এর মধ্যে পুলিশ রিমান্ডে আছে ১২ জন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র অমিত বুয়েট ছাত্রলীগের আইনবিষয়ক উপসম্পাদক। এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন হিসেবে তার নাম আসে। কিন্তু মামলার এজাহারে অমিতের নাম ছিল না। এ নিয়ে দু’দিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় ওঠে। এর মধ্যেই বৃহস্পতিবার রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করল ডিবি।

আবরার হত্যাকাণ্ডে অমিত সাহার পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল বলে নিশ্চিত করেছেন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, কোনো অপরাধের সঙ্গে কেউ ঘটনাস্থলে থেকে জড়িত হতে পারে, আবার কেউ ঘটনাস্থলে না থেকেও জড়িত হতে পারে। তথ্যপ্রযুক্তি, ডেটা বিশ্লেষণ এবং জিজ্ঞাসাবাদের তথ্য অনুযায়ী তারা মনে করছেন, ঘটনাস্থলে হয়তো তিনি (অমিত) ছিলেন না, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে তার পরোক্ষ সংশ্লিষ্টতা ছিল।

এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর সবুজবাগ এলাকায় এক আত্মীয়র বাসা থেকে অমিতকে গ্রেফতার করা হয়। বুয়েটের শেরেবাংলা হলের যে ২০১১ নম্বর কক্ষে রোববার রাতে নির্যাতন চালিয়ে আবরার ফাহাদকে হত্যা করা হয়, সেই কক্ষেরই আবাসিক ছাত্র অমিত।

সেদিন আবরারকে ওই কক্ষে ডেকে নেয়ার আগে অমিত মেসেঞ্জারে আবরারের খোঁজ করেন তার এক সহপাঠীর কাছে, যার স্ক্রিনশট পরে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবরার থাকতেন শেরেবাংলা হলের ১০১১ নম্বর কক্ষে। তার রুমমেট মো. মিজানুর রহমানকেও বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১২টার দিকে ওই কক্ষ থেকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

মিজান বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। এছাড়া নিহত আবরার ফাহাদ মামলার এজাহারের ১১ নম্বর আসামি হোসেন মোহাম্মদ তোহাকে বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টার দিকে গাজীপুরের মাওনা থেকে গ্রেফতার করা হয়।

যন্ত্র প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র তোহা থাকতেন শেরেবাংলা হলের ২১১ নম্বর কক্ষে। তিনিও হল শাখা ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে শিক্ষার্থীরা জানিয়েছে। বুয়েট ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন রোববার রাতে আবরারকে ডেকে নিয়ে যায় ২০১১ নম্বর কক্ষে।

ফেসবুকে মন্তব্যের সূত্র ধরে শিবির সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তাকে লাঠি ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই যে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা উঠে এসেছে ছাত্রলীগের নিজস্ব তদন্তেও।
বুয়েট ছাত্রলীগের ১১ জনকে এরই মধ্যে সংগঠন থেকে স্থায়ী বহিষ্কারও করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর সোমবারই এ মামলার দশ আসামিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মঙ্গলবার গ্রেফতার করা হয় আরও তিনজনকে। ওই ১৩ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এরই মধ্যে ৫ দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার তিনজনকে ধরার পর গ্রেফতার সংখ্যা দাঁড়াল ১৬ জনে।

এদিকে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মনিরুল ইসলাম বলেন, আবরার নৃশংসভাবে খুন হওয়ার তথ্য পেয়েই পুলিশ তৎপর হয়। এজাহার দায়েরের আগেই পুলিশ কাজ শুরু করে।

হত্যাকাণ্ডের পর বুয়েটে যখন বিক্ষোভ চলছিল, তখনই পুলিশের কয়েকটি টিম কাজ করছিল। তারা ১০ জনকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেফতার করে। তাদের ৫ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। পুলিশের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। এজাহার দায়েরের পর আরও ৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এজাহারে নাম নেই অথচ পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার হয়েছেন, এমন লোকের সংখ্যা তিনজন। এরা হচ্ছেন অমিত সাহা, মিজানুর রহমান ও শামসুল আরেফিন।

এজাহারে নাম না থাকা সত্ত্বেও প্রাথমিক তদন্তে নাম আসায় তাদের গ্রেফতার করা হয়। মনিরুল ইসলাম বলেন, অতীতেও অনেক ক্লুলেস ঘটনা গোয়েন্দা বিভাগ পেশাদারিত্বের সঙ্গে শনাক্ত করেছে।

এই ঘটনাটির ক্ষেত্রেও ডিএমপি থেকে তারা অঙ্গীকার করতে চান যে, যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত, তাদের প্রত্যেককেই চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হবে। এখন পর্যন্ত এ ঘটনায় গ্রেফতার সংখ্যা ১৬ জন। মনিরুল ইসলাম বলেন, এর আগেও ক্যাম্পাসে এ রকম হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

কিন্তু এত দ্রুত গ্রেফতার পুলিশের পেশাদারি ও নিষ্ঠার কারণেই সম্ভব হয়েছে। মোট কতজন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, তা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, এটি তারা এখনও নিশ্চিত হতে পারেননি। রিমান্ড শেষে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যাবে।

হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, ‘এটি আমাদেরও তদন্তের মূল বিষয়। প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পেয়েছি, পরবর্তী তদন্তে যদি তা না মেলে তাই আমরা এখনই মোটিভ সম্পর্কে বলতে চাচ্ছি না।’

হত্যার উদ্দেশ্যেই তাকে আনা হয়েছিল কি না, সে সম্পর্কে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারেননি। শুধুই ফেসবুক স্ট্যাটাস তাকে হত্যার মূল কারণ কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মোটিভটা আমরা পরে ক্লিয়ার করব।’ পুলিশ আগেই উপস্থিত হয়েছিল- এমন একটি বিতর্কের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এখানে কাউকে গুরুতর আহত করা হয়েছিল, এই তথ্য পুলিশের কাছে ছিল না। ফলে রেওয়াজ হচ্ছে, প্রভোস্টকে সঙ্গে নিয়ে পুলিশকে হলে ঢুকতে হয়।

টহল টিম সেখানে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের বলা হয়েছে কিছু ঘটেনি। তিনি বলেন, ‘আমরা দুঃখ প্রকাশ করছি, আমরা জানতে পারলে হয়তো এই অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটত না। কিন্তু জানার পরপরই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’ এ সময় আবদুল বাতেন পাশ থেকে বলেন, ৩৫-৪০ মিনিট বসে থাকার পর ছাত্ররাই বলেছে এখানে কিছু ঘটেনি।

৩৫-৪০ মিনিট বসে থেকেও এটা জানতে না পারা পুলিশের ব্যর্থতা বলে মনে করেন কি না, তখন মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি জানি না আপনি কখনও হলে ছিলেন কি না। হলের কোনো একটি নির্দিষ্ট রুমে যদি কোনো ঘটনা ঘটে, খুব চিৎকার-চ্যাঁচামেচি না করলে বাইরে থেকে জানার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। আমি হল, হোস্টেল এবং স্কুল বোর্ডিংয়ে থাকা মানুষ হয়ে বলছি, এটা জানা খুব ডিফিকাল্ট।

তিনি বলেন, প্রথম দফায় গ্রেফতার হওয়া দশ বুয়েট শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং ‘তথ্যপ্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে’ ওই হত্যাকাণ্ডে তাদের জড়িত থাকার বিষয়ে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। ‘যাদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

আবরার হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতি করে বলে প্রমাণিত হয়েছে’- এ প্রশ্নের জবাবে মনিরুল বলেন, ‘কে কোন দলের সঙ্গে জড়িত, পদ-পদবি কী, তা আইনে দেখার সুযোগ নেই। এটি দেখাও হচ্ছে না। পাশাপাশি সামাজিক অবস্থান তদন্তের ক্ষেত্রে যেন প্রভাব বিস্তার না করে, সে ব্যাপারে চৌকস টিমগুলো কাজ করছে।’

আবরার হত্যার বিষয়ে কোনো তথ্য থাকলেও তা পুলিশকে দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আবরার হত্যার চার্জশিট যখন বিচারে উঠবে, তখন সাক্ষ্যপ্রমাণগুলো আবার নতুনভাবে উপস্থাপিত হবে।

বিচারক নিরপেক্ষভাবে সেগুলো বিচার করবেন, তখন এই সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে বিচার কাজ সম্পন্ন হবে। কারও কাছে কোনো তথ্য থাকলে তা আমাদের জানান।’

সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার প্রধান অতিরিক্ত কমিশনার আবদুল বাতেন, ডিএমপি সদর দফতরের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) কৃষ্ণপদ রায় ছাড়াও অন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

অমিতের মা-বাবা তীর্থে আছেন, জানেন না ছেলের খবর : নেত্রকোনা প্রতিনিধি জানান, অমিত সাহা শৈশব থেকেই মেধাবী ছিল। পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছে। এলাকার মানুষ খুব শান্ত-ভদ্র হিসেবেই জানেন।

অমিতের বাবা একজন ধানের আড়তদার। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি ব্যবসা করেন। বর্তমানে থাকেন নেত্রকোনা শহরের আখড়া মোড় এলাকায় নিজস্ব বাসায়। অমিত জেলা শহরের আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও নেত্রকোনা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।

তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা সদরের ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের ঠাকুরাকোনা বাজারের স্বাস্থ্য ক্লিনিকের পাশে। অমিতের মা দেবী রাণী সাহা ও বাবা রঞ্জিত সাহা ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের তীর্থে যান।

এখনও তারা সেখানেই অবস্থান করছেন। ছোট বোন ঐশ্বরিয়া সাহাও মেধাবী। তিনি নরসিংদীর কাদের মোল্লা কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ছেন। ঠাকুরাকোনা বাজারের ব্যবসায়ী মো. কামাল মিয়া জানান, অমিতের বাবা খুব ভালো ব্যবসায়ী।
ছেলে-মেয়েদের খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন। এমন একটা খবরে খুব খারাপ লাগছে। তার মা-বাবার কষ্ট বৃথা যাচ্ছে। এলাকাবাসী হিসেবে মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার মা-বাবা এখন ভারতের তীর্থে আছেন।

ঠাকুরাকোনা বাজারে অমিতদের বাসায় গিয়ে বাসাটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। এ সময় অমিতের কাকি শিখা রানী রায় জানান, ‘অমিত শৈশব থেকে খুব মেধাবী ও শান্ত। এলাকার কেউ তাকে খারাপ প্রকৃতির বলতে পারবে না। কীভাবে এ ধরনের ঘটনায় যুক্ত হল বুঝতে পারছি না। যদি সে জড়িত থাকে, তার শাস্তি হোক, জড়িত না হলে মুক্তি দাবি করছি।’