‘আমার লেখার কেন্দ্রে থাকে ন্যায়বিচার’

0
56

বুকার পুরস্কারপ্রাপ্ত ভারতীয় লেখিকা অরুন্ধতী রায় এখন শুধু ভারত নয়, পুরো দুনিয়ায়ই পরিচিত। মানুষের অধিকার এবং আন্দোলনের পক্ষে দুনিয়ায় দৃঢ়কণ্ঠ তার লেখক পরিচয়কে ছাড়িয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় পুরস্কার বাবদ পাওয়া অর্থের সবটাই দান করেছেন বিভিন্ন আন্দোলন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং প্রকাশনার সমর্থনে। সম্প্রতি আউটলুক ম্যাগাজিনের পক্ষে অরুন্ধতী রায়ের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবা নাকভি। সাক্ষাৎকারের নির্বাচিত অংশ অনুবাদ করেছেন শানজিদ অর্ণব

প্রশ্ন : আপনি একজন লেখক। কিন্তু বিভিন্ন অধিকার এবং আন্দোলনে আপনি শক্তিশালী যুক্তি নিয়ে শামিল হয়েছেন। লিঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে নিজের এ বিবর্তনকে কীভাবে দেখবেন?

অরুন্ধতী রায় : প্রথমেই আমার বলে নেয়া উচিত যে, জেন্ডার মাত্র দুইটিই আছে- এটি আমি বিশ্বাস করি না। আমি জেন্ডারকে দেখি একটি বর্ণালির মতো, আর আমি নিজে সেই বর্ণালির মধ্যে আছি। দ্বিতীয়ত, আমি তেমন কোনো মানুষ নই যে দুনিয়াকে ‘অধিকার’ আর ‘আন্দোলন’ এর লেন্স দিয়ে দেখি, কোনো লেখকের পক্ষে দুনিয়াকে দেখার জন্য এটা খুবই সঙ্কীর্ণ এবং ভাসা ভাসা দৃষ্টিভঙ্গি। আমাকে যদি প্রশ্ন করেন, আমার লেখার মূলে আসলে কী থাকে, তাহলে জবাবে আমি বলব, না এটা অধিকার নয়, আমার লেখার কেন্দ্রে থাকে ন্যায়বিচার। ন্যায়বিচার হচ্ছে একটা বিশাল, সুন্দর এবং বিপ্লবী ধারণা। ন্যায়বিচার দেখতে কেমন? কোনো কিছুকে আমরা যদি স্রেফ ইস্যু হিসেবে দেখি, তাহলে সেগুলো শুধু ইস্যু হিসেবেই থেকে যাবে। অবশ্যই দুনিয়াতে এমন কোনো সমাজ নেই যেটা পূর্ণ ন্যায়বিচারক। কিন্তু আমরা কখনও ন্যায়বিচারের জন্য সংগ্রামকে ত্যাগ করতে পারি না। কিন্তু আজকের দিনে মনে হচ্ছে, আমরা বরং উল্টোদিকে এগোচ্ছি। আমরা এখন এগোচ্ছি অবিচারের দিকে আর এমনভাবে এই অবিচারকে স্বাগত জানাচ্ছি, এটা যেন আমাদের উপযুক্ত স্বপ্ন, একটি লক্ষ্য এবং আকাঙ্ক্ষা। ভারতের সবচেয়ে ভয়ানক দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এটা বর্ণপ্রথার মাধ্যমে অবিচারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে, এটিকে পবিত্র হিসেবে তুলে ধরেছে। ফলে এ ব্যবস্থা এবং অবিচারকে আমরা মেনে নিচ্ছি। এমন নয় যে, অন্য দেশের সমাজগুলো ন্যায়বিচারক। অন্য অনেক সমাজে যুদ্ধ ও গণহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। আমি শুধু আমাদের সমাজের কল্পনার জগৎটির সম্পর্কে বলছি। সমাজে একজ মানুষ কী করতে পারে এবং আমরা কীভাবে তার বিরোধিতা করতে পারি? কেউ আমাদের কথায় কর্ণপাত করছে না এটা জেনেও আমরা অনেকে যা করার তা করে যাচ্ছি। আমরা আমাদের লড়াইয়ে জিততে চাই; কিন্তু সেই জয় যদি কোনো দিন নাও আসে তাহলেও আমরা সামজের বর্তমান বিজয়ী ধারার অন্য পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে চাই। কারণ সমাজের এ বিজয়যাত্রা হচ্ছে আসলে মৃত্যুযাত্রা।

প্রশ্ন : আপনি আজ যেমন, তেমনটা হতে কোন কোন বিষয় প্রভাবিত করেছে?

অরুন্ধতী রায় : সবার আগে আমার মুক্ত-বন্ধনহীন, অসাধারণ মায়ের প্রভাব। মা এসেছিলেন এক সিরীয় খ্রিস্টান পরিবার থেকে, পরিবারটি তেমন টাকা-পয়সাওয়ালা ছিল না। মা বিয়ে করলেন এক বাঙালিকে, কয়েক বছরের মধ্যে বিচ্ছেদ। এরপর মা কেরালায় গ্রামে আমার নানির সঙ্গে বসবাস শুরু করলেন। বর্ণপ্রথা জর্জরিত, সম্পদ এবং জমির মালিক সমাজ আমাদের এড়িয়ে চলেছে। তখন তিনি প্রায়ই আমার এবং আমার ভাইয়ের ওপর নিজের রাগ ঝাড়তেন। আমরা বিষয়টা বুঝতাম; কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্কটি ছিল বেশ জটিল। ১৭ বছর বয়সে আমি বাড়ি ছাড়লাম এবং ফিরেছিলাম অনেক বছর পর। অনেকের কাছে পরিবার হচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়; কিন্তু যারা গড অব স্মল থিংস পড়েছেন তারা জানেন, পরিবার ছিল আমার জন্য এক বিপজ্জনক স্থান। পরিবারে আমি অপমানিত বোধ করতাম। আমরা যে গ্রামে থাকতাম সেখানে সব বড় ধর্মের মানুষ বাস করতেন- হিন্দু, খ্রিস্টান, মুসলমান, মার্কসবাদী। আমরা বিশ্বাস করতাম, বিপ্লব আসছে। সেখানে লাল পতাকা উড়ত, সেস্নাগান ছিল ইনকিলাব জিন্দাবাদ! কিন্তু তারপরও পরিবেশটা ছিল সঙ্কীর্ণ, বর্ণপ্রথার উৎপাত ছিল। খুব ছোটবেলা থেকেই আমি এ বর্ণপ্রথার সত্যটা বুঝতে পেরেছিলাম। এটা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আমি একজন ‘খাঁটি’ সিরীয় খ্রিস্টান নই এবং আমি কখনও এ বিরাট সমাজের অংশ হতে পারব না। তাই গ্রাম থেকে বের হওয়ার জন্য আমি বেপরোয়া হয়ে পড়েছিলাম। সমাজ বা পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার ছিল না। আর সমাজ বা পরিবারেরও কোনো ইচ্ছে ছিল না আমাকে কাছে টেনে নেয়ার। বাবাকে চিনতাম না, তার কয়েকটা ছবি দেখেছি শুধু। আমার বয়স যখন বিশের কোঠায় তখন প্রথমবার বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তাই আমার দেখাশোনা বা নিরাপত্তা বিধানের কোনো পুরুষ চরিত্র জীবনে ছিল না। আমি এটা দাবি করতে পারি না যে, আমার বাল্যকাল খুব ট্রাজিক ছিল; কিন্তু সেটা খুব চিন্তাশীল ছিল নিঃসন্দেহে। অনেক কিছু নিয়ে তখন প্রায় একাকী চিন্তা করেছি।

প্রশ্ন : আজকের ভারতে আমরা কোথায় আছি, কোন বিষয়টা আপনার কাছে সমস্যা মনে হয়?

অরুন্ধতী রায় : বিচার বিভাগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আজ সব প্রতিষ্ঠানের ওপর অসৎ, সাম্প্রদায়িক আঘাত আসছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আর জ্ঞানার্জনের স্থান থাকছে না, সাম্প্রদায়িক মানুষকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। পাঠ্যক্রমে বুদ্ধিবৃত্তিক খোরাকের বদলে ঢোকানো হচ্ছে মূর্খ-আহাম্মকের বিদ্যা। সব কিছু এ ফ্যাসিস্ট দৃষ্টিকোণ থেকে সাজানো হচ্ছে। এটা শুধু রাজনৈতিক দল বা ক্ষমতার বিষয় নয়। পুরো সমাজই অবস্থান বদলাচ্ছে। এটা এ দেশের আত্মা এবং কল্পনার ওপর আঘাত। সবখানেই মানুষ রুখে দাঁড়াচ্ছে। যে আঘাতের বিরুদ্ধে আমরা দাঁড়াচ্ছি সেটা অনেক বিস্তৃত এবং গভীর। মোদি সরকারকে ঘিরে তৈরি হওয়া রমরমা অবস্থা খুব দ্রুতই কেটে যাচ্ছে, এত দ্রুত এটা কাটবে তা অনেকে চিন্তা করতে পারেননি। আমরা ভয় হচ্ছে, যখন তারা সত্যিই বেপরোয়া হয়ে উঠবে তখন তারা আরও ভয়ানক হয়ে উঠবে। ইয়াকুব মেমনের ফাঁসি হচ্ছে সে যাত্রার একটি পদক্ষেপ। আগামী নির্বাচনের আগে তারা খুব সম্ভবত বড় আকারের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দেবে। ফলস ফ্লাগ সন্ত্রাসী হামলা এবং পাকিস্তানের সঙ্গে পরমাণু যুদ্ধ নিয়েও আমি উদ্বিগ্ন। সীমান্তের উভয় পাশের সরকার এবং মিডিয়া সবাই এ ধরনের আত্মঘাতী নির্বুদ্ধিতা দেখানোর যথেষ্ট যোগ্যতা রাখে। – See more at: http://www.alokitobangladesh.com/online/opinion/2015/08/23/10014#sthash.WfW2zA9Y.dpuf