ইসলামের আলোকে মাতৃভাষা ও আমাদের দায়িত্ব

0
94

মুহাম্মদ শামীম সরকার শাহীন
মা ও মাতৃভাষা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অসংখ্য নিয়ামাতের মাঝে অন্যতম নিয়ামাত। মা’ কে ভালোবাসে না পৃথিবীতে এমন কেউ আছে? আমার জানামতে এমন কাউকে খুজে পাওয়া যাবেনা। আমি মাতৃভাষাকে মায়ের মতো ভালোবাসি। মাতৃভাষা আমার প্রাণ। আমার হৃদয়ের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জুড়ে আছে মাতৃভাষার প্রেম। বাংলা বর্ণের প্রেমে আমি মুগ্ধ। আমার বলাবলি-লেখালেখিতে মাতৃভাষা বাংলা জাগৃতির জানান দেয়। মাতৃভাষা রক্তঝরা ইতিহাসের নাম। মহান আল্লাহ তাঁয়ালা মানব জাতির হেদায়েতের জন্য যুগে যুগে অসংখ্য নবী-রাসূল পৃথিবীতে প্রেরণ করেছেন। তাঁরা মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। যত নবী-রাসূল এ ধরায় এসেছেন সকলেই স্বজাতির মাতৃভাষায় কথা বলতেন। মহান আল্লাহ তাঁয়ালার পক্ষ থেকে তাদের উপর নাজিলকৃত আসমানি কিতাব এবং সহিফাগুলোও স্বজাতির মাতৃভাষায় প্রচার করতেন। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআনুল কারীমের সুরা ইব্রাহীমের ০৪নম্বর আয়াতে বর্ণিত হয়েছে- “আমি সব পয়গাম্বরকে তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করে পাঠিয়েছি যাতে তারা পরিষ্কার করে বুঝাতে পারে।” হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে, “আল্লাহ পাক পয়গাম্বরগণের প্রতি যত কিতাব নাজিল করেছেন সেগুলোর আসল ভাষা ছিল আরবি, জিব্রাঈল (আঃ) তাঁর নিজ নিজ পয়গাম্বরের জাতীয় ভাষায় অনুবাদকরে নবী রাসূলগণের কাছে বার্তা পৌছাতেন।” যেমন- তাওরাত, যাবুর ও ইনজিল প্রভৃতি কিতাব কোনোটা ইবরানি, কোনোটা হিব্রু, কোনোটা সুরিয়ানি বা ইউনানি ভাষায় রূপান্তরিত করে নবী-রাসূলগণের কাছে পৌছানো হয়েছে। নবী-রাসূল (আ)-গণও নিজ নিজ জাতীর কাছে তাদের স্বজাতীয় ভাষায় আল্লাহর বাণী যথাযথভাবে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন। অতএব হাদিস শরিফ থেকে প্রমাণিত যে, প্রত্যেক নবী-রাসূলই আপন জাতির মাতৃভাষায় আসমানি গ্রন্থাবলির নির্দেশিকা প্রচার করতেন। মূলত পয়গাম্বরদের ইসলাম প্রচারের মাধ্যম ছিল মাতৃভাষা। আমাদের রাসূল,প্রিয়নবী বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মাতৃভাষা ছিল আরবি। আর সর্বশেষ আসমানি গ্রন্থ আল-কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে তাঁর মাতৃভাষাতেই। অতঃপর তিনি মাতৃভাষাতেই কুরআনের বাণী প্রচার করে জগৎকে আলোকিত করেছেন। আল্লাহ তা’য়ালা নবীজীর মাতৃভাষাতে কুরআন নাজিল করে তা সহজ করে দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- “এটা রুহুল আমিন-জিব্রাইলের মাধ্যমে আপনার অন্তকরণে সুস্পষ্ট আরবি ভাষায় অবতীর্ণ করা হয়েছে। যাতে ভয় প্রদর্শনকারী হতে পারেন।” -(সুরা শুয়ারা: আয়াত ১১৩-১১৫)। যারা কুরআন ও হাদীস নিয়ে গবেষণা করতে আগ্রহী, তাদেরকে আরবী ভাষায় পারদর্শী হতে হবে। কুরআন ও সুন্নাহকে আরবী ভাষায় এর অন্তর্নিহিত অর্থ ও শিক্ষা উপলব্ধি করতে হবে। তবে শুধু আমল, প্রচার ও শিক্ষাদানের জন্য মাতৃভাষাই সর্বোত্তম। এ প্রসঙ্গে আল্লাহর ঘোষণা- “অতঃপর আমি এ কোরআনকে আপনার মাতৃভাষায় সহজ করে দিয়েছি, যাতে এর মাধ্যমে আপনি মুত্তাকিদেরকে জান্নাতের সুসংবাদ দিতে পারেন আর এর সাহায্যে কলহে লিপ্ত জাতিকে (জাহান্নামের) ভয় দেখাতে পারেন।” (সুরা মারইয়াম : আয়াত-৯৭)। ভারতীয় উপমহাদেশে ফার্সি, উর্দু, বাংলা ভাষায় কুরআন, হাদিসের প্রচুর গবেষণা ও বই পুস্তক রচনা করা হয়েছে। এ উপমহাদেশের উলামায়ে কেরামগণ যারা ইসলামের বাণী প্রচার করেছেন একনিষ্ঠভাবে তন্মধ্যে এক মহান ব্যক্তিত্ব মাওলানা আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)৷ তিনি ছিলেন ভাষা ও সাহিত্যের পরিপক্ষ এক মনীষী ৷ ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সফর কালে আলেম ও মাদরাসা সংশ্লিষ্টদের উদ্দেশ্যে মাওলানা নদভী এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন৷ তিনি বলেন- প্রিয় বন্ধুগণ! আমার দু’টি কথা মনে রেখো; বেশী কিছু আমি বলতে চাই না। প্রথম কথা হলো- এই দেশ ও জাতির হিফাযতের দায়িত্ব তোমাদের। সুতরাং ইসলামের সাথে এ দেশের সম্পর্ক কোন অবস্থাতেই যেন শিথিল হতে না পারে। অন্যথায় তোমাদের এই শত শত মকতব-মাদরাসা বেকার ও মূল্যহীন হয়ে পড়বে। আমি সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই। আমার কথায় তোমরা দোষ ধরো না। কেননা আমি তো মাদরাসারই মানুষ, মাদরাসার চৌহদ্দিতেই কেটেছে আমার জীবন। আমি বলছি, আল্লাহ না করুন ৷ ইসলাম যদি এ দেশে বিপন্ন হয় তাহলে মকতব-মাদরাসার কী প্রয়োজন থাকবে, বরং এগুলোর অস্তিত্বের সুযোগই বা কোথায় থাকলো? সুতরাং তোমাদের প্রথম কাজ হলো এদেশে ইসলামের অস্তিত্ব রক্ষা করা, ইসলামের সঙ্গে এ জাতির বন্ধন অটুট রাখা। দ্বিতীয় কাজ হলো, যে কোন মূল্যে দেশ ও জাতির নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নেয়া- নিতে হবে। আর তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে পূর্ণ অধিকার এবং সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধি বৃত্তিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন ছাড়া কখনো সম্ভব নয়। আমার খুবই আফসোস হচ্ছে যে, আপনাদের সাথে আমি বাংলা ভাষায় কথা বলতে সক্ষম নই। যদি আমি আপনাদের ভাষায় আপনাদেরকে সম্বোধন করতে পারতাম তাহলে আজ আমার আনন্দের কোন সীমা থাকতো না। ইসলামের দৃষ্টিতে কোন ভাষাই পর নয়, বিদেশী নয়। পৃথিবীর সকল ভাষাই আল্লাহর সৃষ্টি এবং প্রত্যেক ভাষারই রয়েছে নিজস্ব কিছুগুণ ও বৈশিষ্ট্য। ভাষা বিদ্বেষ হলো জাহেলিয়াতের উত্তরাধিকার। কোন ভাষা যেমন পূজনীয় নয়, তেমনি ঘৃণা-বিদ্বেষেরও পাত্র নয়। একমাত্রআরবী ভাষাই পেতে পারে পবিত্র ভাষার মর্যাদা। এছাড়া পৃথিবীর আর সব ভাষাই সমমর্যাদার অধিকারী। আল্লাহ মানুষকে বাকশক্তি দিয়েছেন এবং যুগেযুগে মানুষের মুখের ভাষা উন্নতি ও সমৃদ্ধির বিভিন্ন সোপান অতিক্রম করে বর্তমান রূপ ও আকৃতিতে আমাদের কাছে পৌঁছেছে। মুসলমান প্রতিটি ভাষাকেই শ্রদ্ধা ও মর্যাদার চোখে দেখে। কেননা ভাষা আল্লাহর সৃষ্টি, আল্লাহর দান এবং মনের ভাব প্রকাশে সব ভাষাই মানুষকে সাহায্য করে। তাই প্রয়োজনে যে কোন ভাষা শিক্ষা করা ইসলামের নির্দেশ। অর্থাৎ মাওলানা নদভী (রহ.) এর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ হচ্ছে “বাংলাদেশে ইসলাম ও ইসলামী উম্মাহর এই সংকটসন্ধিক্ষণে ঐক্যবদ্ধ কর্মপ্রচেষ্টায় আত্মনিয়োগ করতে হবে। প্রথমত ইসলামের সঙ্গে মুসলমানদের সম্পর্ক অটুট রাখার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত- আলিম সমাজকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। বাংলা ভাষার দক্ষতা অর্জনের সাথে গ্রহণীয় করে লিখতে হবে ৷ অন্যথায় এদেশে আলিম সমাজের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। বাংলা ভাষায় কুরআন ও হাদিসের বাণী এ দেশের মাতৃভাষার মাধ্যমে ব্যাপক চর্চার ফলে এখানকার মানুষের মধ্যে ইসলামের ব্যাপক প্রচার-প্রসার ঘটছে। বর্তমানে বাংলা ভাষায় কুরআন, তাফসির, হাদিস ও অন্যান্য বিষয়ের যে বিশাল ভান্ডার গড়ে উঠেছে তাতে মাতৃভাষায় যে গুরুত্ব বহন করে তা অবাক করার মতো। বাংলা ভাষায় ইসলাম চর্চা এ দেশে সত্যিকার অর্থে এক যুগান্তকারী অধ্যায় সূচিত করেছে। বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষায় শহীদদের সম্মানে ২১শে ফেব্রুয়ারী বিশ্বময় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। যারা সেদিন শাহাদাত বরণ করেছিলেন তারা অনেকেই মুসলিম। আর মুসলিম শহীদী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের ইসলামী তরিকা রয়েছে। সুতরাং ইসলামী তরিকায় তাদের প্রতি সম্মান জনক আচরণ করা শহীদী আত্মার মৌলিক ধর্মীয় অধিকার। অথচ ইসলামী তরিকা বাদ দিয়ে শহীদী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের নামে হিন্দু-খ্রিষ্টান ধর্মীয় তরিকায় যা কিছু করা হচ্ছে, তা শহীদী আত্মার মৌলিক ধর্মীয় অধিকারের পরিপন্থি। কোন মুসলিম ইসলামী তরিকার পরিপন্থি কোন কাজে অংশ গ্রহণ, সমর্থন বা সহযোগিতা করতে পারে না। বিষয়টি ভেবে দেখা প্রয়োজন। মাতৃভাষায় ইসলাম চর্চার নামে আমাদের সমাজে বাংলা ভাষায় জুম্মার খুতবা প্রদানের পক্ষে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বাংলা ভাষা তথা আমাদের মাতৃভাষা আজ দেশের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষাভাষী মানুষ বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুক না কেন এ ভাষাতে ইসলাম চর্চা আরো ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর করতে হবে। ইসলাম যেমন আরবীয় মরু অঞ্চল পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছিল ঠিক তেমনি বাংলা ভাষায় আলেমদের দখলে নিয় তথা বিশুদ্ধ মাতৃভাষার মাধ্যমে আমরা ইসলামের চর্চাকে আরো বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত করতে সক্ষম হবো- ইনশাআল্লাহ। তথ্যসুত্র: * মাওলানা নাদভী রহ. বাংলাদেশ সফর: মুসলানদের উদ্দেশ্যে ভাষণ। * বিভিন্ন ইসলামী বই। * মাতৃভাষার ইতিহাস। ★★লেখক:- মুহাম্মদ শামীম সরকার শাহীন কবি,সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও সংগঠক। [email protected]