প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়ে পর্যটকদের অনাবিল আনন্দ দিতে চিরসবুজ সাজে সেজেছে বান্দরবানের লামার মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স। প্রকৃতির সাজানো সুউচ্চ সবুজ পাহাড়, বনানী ঘেরা উঁচু নিচু পাহাড়ের গায়ে আঁকাবাঁকা পথ, আকাশ, নদী, উপত্যাকা আর সাড়া জাগানো টাইটানিক জাহাজের মনোরম ভাস্কর্যে বান্দরবানের লামার মিরিঞ্জা পর্যটন এনে দিয়েছে নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য। প্রকৃতি যেন তার উদার হাতে সুনিপুণ কারিগরের ন্যায় মুকুটশিখর মিরিঞ্জা পাহাড়কে মোহনীয় করে সাজিয়ে রেখেছে।
ঘন সবুজের আবরণে আবৃত মিরিঞ্জা পর্যটনে অবসরের প্রতিটিক্ষণ আপনজনকে নিয়ে কাটানোর জন্য হয়ে উঠেছে মনোরম। এই চড়াই-উৎরাইয়ে শান্ত বনতলে ঘুরে বেড়াতে কোন ক্লান্তি আসে না। পবিত্র ঈদুল ফিতরের ছুটিতে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যের সমন্বয়ে গড়া এ পর্যটন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ভ্রমণ পিপাসুদের।
সাগর পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৫শ ফুট উঁচু মিরিঞ্জা পর্যটন পাহাড়। এখানে ওঠা মাত্রই দৃষ্টি গোচর হয় লতাগুল্মের দৃশ্য শোভা, পাখ-পাখালির কল-কাকলি। এসব চোখ, কান, মন সব ভরিয়ে তোলে। মাথার উপর টুকরো নীল আকাশ আর পাহাড় মেঘের মিতালী। প্রতিনিয়ত মেঘ ছূঁয়ে যায় মিরিঞ্জা পাহাড়ের গায়। লতাগুল্মের কারুকার্যময় অনেক বড় বড় গাছের উপর আকাশ যেন ছাঁদ। এছাড়া জংগলি ফুলের ম ম গন্ধে মাখামাখি, পাহাড়ের নীচে লুকানো ঝরণা, চূড়ায় উপজাতীয় টংঘর, জুম চাষ আর অরণ্য রানীর ঐতিহ্যের পোশাক। তাদের পায়ের খারুর ঝনঝন আরও কত কি!
পর্যটন শিল্পকে আকর্ষণীয় করে তুলতে গড়ে তোলা হয়েছে সাড়া জাগানো টাইটানিক জাহাজের ভাস্কর্য। সুউচ্চ পাহাড়ের শিখর থেকে কক্সবাজার সাগর সিন্ধুর উত্তাল তরঙ্গমালার মনোমুগ্ধকর নৃত্য ও সাগরের উপর চলমান জাহাজের সম্মুখ যাত্রার দুর্লভ দৃশ্য। এছাড়া এ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে পৃথিবীর দীর্ঘতম কক্সবাজারের সাগর সৈকত ও বঙ্গোপসাগরে রাত্রিকালীন অলংকার লাইট হাউসের আলোর ঝিলিক দেখার সুযোগ।যা ভ্রমণ পিপাসুদের মনকে উদ্বেলিত করে তুলবে।
বেড়ানোর প্রবল ইচ্ছা মনের ভেতর ঘুরেফিরে। পর্যটনকেন্দ্রটির কাছেই উপজেলা সদরে আরো থাকছে, মুরং, মার্মা, ত্রিপুরাসহ ১১ ভাষার সম্প্রদায় উপজাতির সংস্কৃতি ও লোকাচারের সান্নিধ্য। শতশত বর্ষ আগের বিশাল বৌদ্ধ মূর্তি। থাকছে সুখী ও দুঃখী নামের দুটি ১ হাজার ফুট উঁচু ২টি পাহাড়ের বুকচিরে বয়ে চলা আঁকাবাঁকা মাতামুহুরী নদী। এছাড়াও মিরিঞ্জা ঘুরে ১ ঘণ্টার মধ্যে সরাসরি ডুলাহাজরার সাফারি পার্কে বা পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত দেখতে কক্সবাজার চলে যাওয়া যায়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সামসুন নাহার সুমি বাংলানিউজকে জানান, ভ্রমণ পিপাসুদের কক্সবাজারের পাশাপাশি বাড়তি আনন্দ দেবে মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্সর অপরূপ সৌন্দর্য। এখানে পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রয়েছে। কিভাবে যাবেন: রাজধানী ঢাকার ফকিরাপুল, সায়েদাবাদ, রাজারবাগ ও চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজারের চিরিঙ্গা/চকরিয়ার টিকিট কাটুন। এরপর চিরিঙ্গা/চকরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে বাস অথবা চাঁদের গাড়িতে করে চকরিয়া-লামা সড়কের মিরিঞ্জা পর্যটনে নামুন। অথবা কমলাপুর রেল স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম নামুন। চট্টগ্রাম থেকে বাস যোগে চিরিঙ্গা/চকরিয়া বাস টার্মিনালে আসুন। আর যারা ঢাকা থেকে বিমানে যেতে চান তারা ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার নামুন। সেখান থেকে চিরিঙ্গা/চকরিয়া বাস টার্মিনাল থেকে একই ভাবে যাওয়া যায়। এ জন্য সময় লাগবে ২৫ মিনিট। কোথায় থাকবেন: সারাদিন মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স ঘুরে ফিরে সন্ধ্যায় লামাবাহী বাস কিংবা চাঁদের গাড়ি করে উপজেলা সদরে যেতে পারবেন। সেখানে উন্নতমানের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। আবাসিক বোর্ডিং এর মধ্যে রয়েছে হোটেল মিরিঞ্জা, হোটেল প্রিজন ও হোটেল সি হিল। এখানে আপনি রাত্রী যাপন করতে পারেন। আর না হয় কক্সবাজার গিয়ে সূর্য্যডোবার সৌন্দর্য অবলোকন করে নিজের পছন্দসই হোটেলে রাত্রী যাপন করা যাবে। ইট-কাঠের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়া এক চিলতে আকাশ নয়। ওপরে যত দূরে তাকাই, চোখ আটকাবে শুধু সাদা মেঘে। বাকি পুরোটাই ঝকঝকে নীল আকাশ। নিচে একই রকম সবুজের ছড়াছড়ি। মাঝে মাঝে উঁকি দিচ্ছে সাদা ঝরনা, আদিবাসীদের টংঘর। নাকে আসছে বুনো ফুলের গন্ধ। দাঁড়িয়ে আছি সমতল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট ওপরে। বান্দরবনের লামায় মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্সে। পর্যটকদের বেশ নজর কেড়েছ নতুন এই কমপ্লেক্স। টাইটানিক জাহাজের আদলে এখানে বানানো হয়েছে এক স্থাপনা। লোকমুখে জায়গাটার নাম এখন চালু হয়ে গেছে টাইটানিক পাহাড়। এই পাহাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্য ডোবার দৃশ্য একবার দেখলে বারবার ফিরে আসতে চাইবেন। পরিষ্কার দিনে এখান থেকে দেখতে পাবেন কক্সবাজারে বেলাভূমি এমনকি বঙ্গোপসাগরের বাতিঘরের ঝিলিক। পর্যটকদের জন্য এখানে আছে রেস্টহাউস, বসার ছাউনি। নির্জনে সময় কাটানোর জন্য সংযোগসেতুসহ গোলঘর মালঞ্চ। নির্মাণ করা হয়েছে টেলিস্কোপ ঘর। জ্যোৎস্না রাতে চাঁদ দেখার জন্য আছে চন্দ্রিমা গোলঘর। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে মিনি শিশুপার্ক। খাওয়াদাওয়ার জন্য রয়েছে শিশুপার্ক-সংলগ্ন রেস্তোরাঁ। নিরাপত্তার জন্য রয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। সবুজ গাছ আর পাহাড়ঘেরা মাতামুহুরী নদীবেষ্টিত মিরিঞ্জায় তাই বেড়াতে আসতে পারেন নিশ্চিন্তে। শুধু দেখা নয়, কান পেতে শোনারও আছে অনেক কিছুই। গভীর ঝিরির কলকল, বনমোরগ, হরিণের ডাক, মাঝে মাঝে বুনো হাতির চিৎকার। আর দেখতে পাবেন টংঘরে আদিবাসীদের সাদামাটা জীবন। শহুরে জীবনটা ফেলে কিছুক্ষণের জন্য মিশে যেতে চাইবেন তাদের সঙ্গে। মিরিঞ্জা ঘুরে এক ঘণ্টার মধ্যেই কক্সবাজার চলে যাওয়া যায়। যাঁরা রাতে এখানে থাকতে চান না, তাঁদের জন্য আছে লামাবাজারে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মিরিঞ্জা হোটেল। অল্প খরচে মানসম্মত সেবা পাওয়া যায়। মিরিঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্সের প্রতিষ্ঠাতা লামা উপজেলার সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হেলালুদ্দিন আহমদ বলেন, ‘উপজেলায় প্রথম দায়িত্ব নেওয়ার জন্য লামায় আসার পথে রাস্তার পাশে দেখতে পেলাম বিশাল এক পাহাড়। এই পাহাড় হুবহু টাইটানিক জাহাজের মতো। তখনই ভাবলাম পর্যটনকেন্দ্র তৈরির কথা। ২০০৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৬ একর পাহাড়ি ভূমি নিয়ে এই পর্যটন কমপ্লেক্স প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিই।’ কিভাবে আসবেন চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পাশে চকরিয়া উপজেলার চকরিয়া বাসস্টেশনে নেমে আপনি বাস, জিপ অথবা মাইক্রোবাসযোগে হাঁসের দিঘি হয়ে ২০ মিনিট সময়ের ব্যবধানে লামা মিরিঞ্জা টাইটানিক পাহাড়ে চলে আসতে পারবেন। আর এখান থেকে লামা বাজারে আসতে সময় লাগবে ১০ মিনিট। লামা বাজার থেকে যেতে পারবেন সুখি-দুঃখী পাহাড়সহ অনেক দর্শনীয় জায়গায়।