একুশের চেতনা আমাদের উজ্জীবিত করেছে

0
122

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন, নিউজ চিটাগাং

একুশের চেতনা আমাদের উজ্জীবিত করেছে। আমাদের সাহস, অনুপ্রেরণা উৎসাহ যুগিয়েছে। এই একটি গান এত জনপ্রিয় যে, যাকে এখনো অন্য কোন গান জনপ্রিয়তার দিক থেকে অতিক্রম করে যেতে পারিনি। তাইতো একুশের গান বাংলা ভাষার অহংকার। প্রতি বছর বিনম্র শ্রদ্ধায় পালিত হয় একুশে ফেব্রুয়ারী। একুশ আমাদের অহংকার, একুশ আমাদের গৌরব।
গানে গানে, সুরে সুরে চেতনায় একুশ ছড়িয়ে পড়ুক বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে। বাঙালির মাতৃভাষা, রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে বাঙালির রক্তে রাঙা ‘একুশ’ এখন ‘বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস’ ইউনেস্কোর মূল্যায়নে। সর্বস্তরে আজও বাংলা চালু হয়নি। অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য, উচ্চশিক্ষা, গবেষণাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো ইংরেজির প্রাধান্য বেশি।

অমর একুশের চেতনা আজও অমলিন। সেইদিন আমাদের মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণেরা মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিয়া স্বজাত্যবোধের যেই মশাল প্রজ্বলিত করিয়াছিলেন, সেই আলো আজ দেশের সীমানা অতিক্রম করিয়া ছড়াইয়া পড়িয়াছে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও। জাতিসংঘ সেই দিনটিকেই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি প্রদান করিয়াছে। কারণ মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের এমন নজির পৃথিবীতে অতি বিরল। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনে একুশের প্রভাব এতোটাই সর্বব্যাপী যে, ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা যায় নাই—শুধু এইটুকু বলাই যথেষ্ট নহে। আমরা পথ হারাইয়া ফেলিয়াছিলাম। বিস্মৃত হইয়াছিলাম আত্মপরিচয়। একুশের দর্পণে আমরা স্বরূপের সন্ধান পাইয়াছি। একুশ আমাদের শুধু যে জাতি হিসাবে একতাবদ্ধ করিয়াছে তাহাই নহে, জোগাইয়াছে অপরিমেয় শক্তি-সাহসও। বলীয়ান করিয়াছে অদম্য এক আত্মবিশ্বাসে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত লিখিয়াছিলেন, ‘হে বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ রতন’। একুশ আমাদের আবহমান কালের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সেই রত্নভাণ্ডারের সাথে যুক্ত করিয়াছে। দিয়াছে পথের সন্ধান। একুশের পথ ধরিয়াই আমরা স্বাধীনতা ছিনাইয়া আনিয়াছি। পাইয়াছি বাংলা নামের স্বাধীন সার্বভৌম এক দেশ— যাহা বাঙালির হাজার বত্সরের ইতিহাসে অনন্য অবিস্মরণীয় এক ঘটনা।

বস্তুত একুশ আমাদের শাশ্বত এক বাতিঘর। এমনকী স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও সকল সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দুর্যোগে-দুর্বিপাকে একুশই আমাদের পথ দেখাইয়াছে। এখনও দেখাইয়া চলিয়াছে। বাঙালি ও বাংলাদেশ যতোদিন টিকিয়া থাকিবে, ততোদিন ইহার ব্যত্যয় ঘটিবে বলিয়া মনে হয় না। কারণ একুশের শিকড় আমাদের চেতনার গভীরে প্রোথিত। বরেণ্য বুদ্ধিজীবী আবুল ফজল মন্তব্য করিয়াছিলেন যে ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’। কথাটির যথার্থতা বার বার প্রমাণিত হইয়াছে। একুশ আমাদের অন্যায়-অবিচার ও অধিকারহীনতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করিতে শিখাইয়াছে। উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, এই দেশের মানুষ কখনোই কোনো স্বৈরশাসনের নিকট মাথা নত করে নাই। আপস করে নাই গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকারের প্রশ্নে। পাশাপাশি, ইহাও অনস্বীকার্য যে, একুশ ভালোবাসার এক অনন্য প্রতীকও বটে। সেই ভালোবাসা শুধু মাতৃভাষা প্রীতিতেই সীমাবদ্ধ নহে, বরং বাঙালির ঐতিহ্য-সংস্কৃতি হইতে শুরু করিয়া যাহা কিছু মহত্ ও মানবিক—সর্বত্রই বিস্তৃত তাহার মমতাময়ী ডানা। সেই কারণেই একুশের সংস্পর্শে বাঙালির প্রাণ জাগিয়া ওঠে। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়িয়া বহিয়া যায় সৃষ্টিশীলতার ঢল। কয়েক হাজার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। আবির্ভাব ঘটে অসংখ্য নূতন ও সম্ভাবনাময় লেখক-কবি-শিল্পীর। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে দীর্ঘদিন যাবত্ যে অমর একুশে গ্রন্থমেলা অনুষ্ঠিত হইয়া আসিতেছে তাহা ইতিমধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ ও গুরুত্বপূর্ণ বইমেলার স্বীকৃতি অর্জন করিয়াছে।

অর্ধশতাব্দী আগে একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের সামনে সম্ভাবনার যে বিশাল দিগন্ত খুলিয়া দিয়াছিল সেই পথ ধরিয়া দেশ আগাইয়া চলিয়াছে। উদ্বেগের বিষয় হইল, নানা ক্ষেত্রে বিস্ময়কর সাফল্য সত্ত্বেও সেই অগ্রযাত্রার পথ এখনও পুরোপুরি শঙ্কামুক্ত নহে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা ও অনৈক্যের চোরাবালি মাঝে-মধ্যেই সবকিছু গ্রাস করিতে উদ্যত হইতেছে। মাথাচাড়া দিয়া উঠিতেছে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও অঙ্গীকার হইতে পথভ্রষ্ট হইয়া পড়ার আশঙ্কাও। এমতাবস্থায়, এই কথা নিঃসংশয়ে বলা চলে যে, জাতির অবিসংবাদিত ঐক্যসূত্র হিসাবে একুশই হইতে পারে আমাদের সর্বাপেক্ষা কার্যকর সুরক্ষা বর্ম। অতএব, বত্সরের বিশেষ একটি দিনে শুধু আবেগে ভাসিয়া গেলে চলিবে না, বরং একুশের চেতনার রজ্জুকে শক্ত করিয়া ধরিতে হইবে। তাহার যথাযথ প্রতিফলন ঘটাইতে হইবে জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে।