কঠিন সমস্যায় চট্টগ্রামবাসী

0
235

কাজী আবুল মনসুর, প্রতিদিনের সংবাদ::
চট্টগ্রামকে বলা হয় দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী। দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর এই নগরীতে। অর্থনীতির জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই নগরীতে রয়েছে হাজারো সমস্যা। শুধু জলাবদ্ধতার জন্যই সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়ছে চট্টগ্রাম। এই নগরী এখন পার করছে কঠিন সময়। বর্ষার জলাবদ্ধতা, জোয়ারের পানি, বেহাল রাস্তা, হালদায় মাছের মৃত্যু, কর্ণফুলী দূষণ, গ্যাস সংকট, নগরে নানামুখী রোগ জীবাণুর বিস্তারসহ বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা করছে জনসাধারণ। নগর উন্নয়নে সমন্বয় নেই সিটি করপোরেশন ও সিডিএ (চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) এর মধ্যে। সিটি করপোরেশন প্রতি বছর নালা-নর্দমা পরিষ্কার করলেও এবার তারা হাত দেয়নি। দায় চাপিয়েছে সিডিএর ওপর। ফলে নগরবাসীর ভোগান্তি এখন চরমে।

টানা কয়েক দিনের ভারী ও মাঝারি বৃষ্টিতে শুধু জলাবদ্ধতাই সৃষ্টি হয়নি। চট্টগ্রাম নগরের বেশিরভাগ সড়কে আবার খানাখন্দ সৃষ্টি হয়েছে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে গর্ত। পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে হালিশহরে মারা গেছেন অন্তত তিনজন। আরো কয়েক হাজার অসুস্থ হয়েছেন পানিবাহিত রোগে। ঘরে ঘরে সংযোগ থাকলেও নিয়মিত মিলছে না গ্যাস। শিল্পবর্জ্যরে দূষিত পানি পড়ছে হালদা ও কর্ণফুলী নদীতে। ব্যাহত হচ্ছে নদী তীরবর্তী ফসলের আবাদ।

এদিকে, চট্টগ্রাম নগরীতে বিভিন্ন সংস্থার তিন হাজার কোটি টাকার অধিক কাজ চলমান রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। সংস্কারের জন্য গতকাল বুধবার থেকে চট্টগ্রাম নগরের অন্যতম ব্যস্ততম পোর্ট কানেকটিং ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোডের একপাশ বুধবার থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে। এই বর্ষার মৌসুমে চলছে ওয়াসা, পিডিবি, টিঅ্যান্ডটিসহ বিভিন্ন সংস্থার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতায় পরিকল্পিত উন্নয়ন হচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, জাইকার অর্থায়নে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা ব্যয়ে পোর্ট কানেকটিং ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোডকে ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে। এ জন্য নিমতলা থেকে বড়পুল, বড়পুল থেকে নয়াবাজার এবং আগ্রাবাদ বাদামতল মোড় থেকে বড়পুল-নয়াবাজার পর্যন্ত সড়কের একপাশ বন্ধ রাখা হবে। অন্যপাশ দিয়ে উভয়মুখী যানবাহন চলাচল করবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পোর্ট কানেকটিং ও আগ্রাবাদ এক্সেস রোডে প্রতিদিন হাজার হাজার গাড়ি চলাচল করে। ইপিজেড, বন্দর, কাস্টমস ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মজীবীদেরকে প্রতিনিয়ত এ সড়ক দুটি দিয়ে চলাচল করতে হয়। বন্দরকেন্দ্রিক ট্রাক, ট্রেইলর, কাভার্ড ভ্যানেরও চলাচল এ রোড দুটিতে। দীর্ঘদিন ধরে এ সড়ক দুটি চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে সড়ক দুটির এক পাশ বন্ধ রাখার ফলে যানজট আগের চেয়ে বেড়েছে।

চট্টগ্রামের সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন কর্মকান্ডে সমন্বয় করা গেলে নগরবাসীর ভোগান্তি ও বিভ্রান্তির অবসান ঘটবে। এজন্য সিডিএ, ওয়াসা, পিডিবি, টিঅ্যান্ডটিসহ অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় থাকা দরকার।

এদিকে, হালিশহরে পানিবাহিত রোগ জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে তিনজনের মৃত্যুর ঘটনায় চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্ষা মৌসুমে হালিশহরের অনেক এলাকা পানির নিচে তলিয়ে যায়। জলাবদ্ধতায় বাসাবাড়ির আন্ডারগ্রাউন্ড রিজার্ভারে নোংরা পানি প্রবেশ করে। সেই পানি ফুটিয়ে পান করলেও জীবাণুর সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।

এদিকে, গত এপ্রিলের শেষের দিকে হালিশহরে পানিবাহিত রোগ জন্ডিস ও ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। শুধু সীতাকুন্ডের ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডিতে তিন শতাধিক ডায়রিয়া ও জন্ডিস আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা নেন তখন। হালিশহরের বাসিন্দাদের দাবি ওয়াসার পানির কারণে এলাকাবাসী জন্ডিস, ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছেন। কিন্তু ওয়াসার কর্মকর্তারা এসব অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না, তারা বলছেন, তাদের পানিতে কোনো সমস্যা নেই। পানির ট্যাংকি পরিষ্কার না করায় জীবাণু সংক্রমিত হচ্ছে। এ ছাড়া ওয়াসার পানির পাইপ লাইন ছিদ্র হয়ে নালা-নর্দমার সঙ্গে যুক্ত হতেও পারে। সঠিক কারণ অনুসন্ধান করে এই সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা চলছে।

সূত্র মতে, নগরীর এক সময়ের অভিজাত এলাকা বলে পরিচিত আগ্রাবাদ সিডিএ এলাকা ও হালিশহর এলাকার মানুষ এক কঠিন সময় অতিক্রম করছেন। অনেকে জায়গা-জমি বিক্রি করে এসব এলাকা ত্যাগ করছেন। বাকিরা অসহায়ের মতো দিনযাপন করছেন। এখানে কেউ আর বাসা ভাড়া নিতে আসে না। এখানে জোয়ারের পানির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে ওয়াসার পানি। পানি ফুটিয়েও কাজ হচ্ছে না। নানা রোগ-জীবাণু বিস্তার লাভ করছে। চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে প্রতিদিন বাড়ছে পানিবাহিত রোগীর ভিড়।

চট্টগ্রাম ওয়াসার তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, হালিশহর থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। কয়েকটি বাসার আপহেড পানির ট্যাংক ও আন্ডারগ্রাউন্ড পানির ট্যাংকে সেই সময় ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া যায়।

এদিকে, দেশে মিঠা পানির মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী শিল্পবর্জ্যরে কারণে দূষিত হয়ে পড়েছে। রুই, কাতলা, মৃগেল অর্থাৎ কার্প জাতীয় মাছের ডিম ও পোনা এই হালদা থেকে সংগ্রহ করে কয়েক হাজার মৎস্যজীবী জীবিকা নির্বাহ করে। জাতীয় অর্থনীতিতে বছরে হালদার প্রত্যক্ষ অবদান প্রায় ৮০০ কোটি টাকা এবং পরোক্ষ অবদান প্রায় চার হাজার কোটি টাকা।

বর্তমানে কল কারখানার নিষ্কাশিত বর্জ্য, বালি উত্তোলন, নদী দখল, নালা-নর্দমার দূষিত পানির সংমিশ্রণ এবং দূষণের কারণে হালদায় মাছের জীবন ধারণ দুরূহ হয়ে পড়ছে। এর ফলে মা-মাছ মরে ভেসে ওঠার দৃশ্য এখন নিত্য ঘটনা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে অচিরেই প্রকৃতি প্রদত্ত এই সম্পদ চিরতরে ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। হালদার দূষণে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে নদীটিকে জাতীয় নদী ঘোষণার দাবি জানিয়ে মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমানের কাছে চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম।

এদিকে, পাইপ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ কাজের কারণে গত কয়েকদিন ধরে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি এলাকায় গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে। ফলে গ্রাহকরা দুর্ভোগে পড়েছেন। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রামে ৬ লাখের ওপরে গ্রাহক আছে। বর্তমানে চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা ৪৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। এ ছাড়া নতুন করে গ্যাস সংযোগ পাওয়ার জন্য আবেদনকারীদের ধরলে এ চাহিদা ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এই বিপুল পরিমাণে গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ হচ্ছে ১৭৯ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ঘনমিটার।

কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড (কেজিডিসিএল)-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী খায়েজ আহম্মদ মজুমদার বলেন, বাখরাবাদ প্রধান পাইপ লাইন থেকে শুরু করে বিভিন্ন লাইনের প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া চাহিদার তুলনায় গ্যাস সংকট তো আছেই।