কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশি গুলিতে নিহত ২

0
64

কারফিউবন্দি ঈদে যেন নিজের জীবন উৎসর্গ করলেন দুই ‘স্বাধীনতাকামী’ কাশ্মিরি। প্রভাবশালী অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম হাফিংটনপোস্টের ভারতীয় সংস্করণে খবরটি নিশ্চিত করা হয়েছে। পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডন-এর খবরেও দুই কাশ্মিরির নিহত হওয়ার খবর দেওয়া হয়েছে। তারা জানিয়েছে, ঈদের দিনে কারফিউ ভেঙে বিক্ষোভ করতে গিয়ে পুলিশি গুলিতে নিহত হয়েছেন তারা। সংঘর্ষে আরও ২২ জন আহত হওয়ার খবর দিয়েছে পুলিশ।

.

ভারতীয় বাহিনীর চলমান দমনপীড়নের বিরুদ্ধে কাশ্মিরি তরুণের অভিনব প্রতিবাদ

১৯৯০ সালেল ২৬ বছর পর প্রথমবারের মতো ঈদের দিনটিতে সমগ্র উপত্যকাজুড়েই কারফিউ জারি করা হয়েছে। নিষিদ্ধ করা হয়েছে জামাত। সেই সঙ্গে বন্ধ রাখা হয়েছে মোবাইল পরিষেবা। নজরদারির জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সিসিটিভি, হেলিকপ্টার এবং ড্রোন। ফলে উৎসবের দিনেও কার্যত গৃহবন্দি থাকতে হচ্ছে কাশ্মিরিদের। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সঙ্গের সাক্ষাৎকারে একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা দাবি করেন, “ঈদে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীরা’ বড় ধরনের সহিংসতা চালানোর চেষ্টা করবে বলে খবর পেয়েছেন গোয়েন্দারা। সে জন্যই আবারও কারফিউ জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মোবাইল পরিষেবাও বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। কাশ্মিরের বিভিন্ন স্থানে সিসিটিভি লাগানো হয়েছে।” এদিকে  নজরদারির জন্য হেলিকপ্টার এবং ড্রোনও ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ভারতীয় বার্তা সংস্থা পিটিআই। কাশ্মিরজুড়ে সেনাবাহিনীসহ সকল নিরাপত্তাবাহিনীকে তৎপর থাকার নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার।

.

কাশ্মিরে মুক্তিকামী প্রতিরোধের আগুন

উল্লেখ্য, কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইরত সমস্ত মানুষকেই বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা সন্ত্রাসী হিসেবেই দেখে ভারত রাষ্ট্র। যদিও কাশ্মিরে পাকিস্তানপন্থীদের তৎপরতা থাকলেও সেখানে সরাসরি কাশ্মিরের স্বাধীনতার দাবিতে লড়াইকারীরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে ভারতের দাবি, কাশ্মিরে যারা লড়াই করছেন তারা আসলে জঙ্গি। বিচ্ছিন্নতাবাদী। কাশ্মির প্রশ্নে সমগ্র ভারতীয় স্টাবলিশমেন্টের দৃষ্টিভঙ্গিতেই সেখানকার সমস্যাকে ‘বিচ্ছিন্নতা আর জঙ্গিবাদের’ সমস্যা আকারে দেখা হয়ে থাকে। বিপরীতে কাশ্মিরিদের কাছে সেখানকার লড়াই আদতে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াই। কাশ্মিরের স্বাধীনতার প্রশ্নে সরব খোদ ভারতীয় বুদ্ধিজীবীরাও। ভূবনখ্যাত বুদ্ধিজীবী অরুন্ধতি রায় স্পষ্ট করে বলেন, সেখানে আসলে ভারতীয় বাহিনীর আগ্রাসন চলছে। অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে কাশ্মিরবাসীকে। কাশ্মির সমস্যার একমাত্র সমাধান স্বাধীনতা।

ঈদের দিনে সেই স্বাধীনতার দাবি নিয়েই কার্ফিউ ভেঙে বের হয়ে আসে কাশ্মিরি জনতা।  বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন স্থানে জমায়েত হন। এর মধ্যে অন্তত তিনটি স্থানে প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয় পুলিশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, কাশ্মিরের প্রধান নগরী শ্রীনগরসহ উত্তরাঞ্চলীয় বান্দিপোরা ও দক্ষিণাঞ্চলীয় শোপিয়ান শহরে বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে টিয়ার গ্যাস ও শটগানে ছররা গুলি নিক্ষেপ করে পুলিশ।

.

আবদুল কাইয়ুম নামের বেসামরিক এই কাশ্মিরিকে পিটিয়ে মেরেছে পুলিশ

কাশ্মিরে কর্তৃপক্ষ জামাতে ঈদের নামাজ আদায় করার অনুমতি না দিলেও ছোট পরিসরে নিজ নিজ এলাকায় নামাজ আদায় করেছেন মুসলিমরা। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯০ সালের পর ২৬ বছরে এই প্রথম ঈদের দিনে কারফিউ জারি করা হলো কাশ্মিরে। এই বছর ঈদগাহ ও হজরতবাল মাজারে কোন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়নি।

প্রসঙ্গত, গত সপ্তাহে হুরিয়তের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ৭১তম সাধারণ অধিবেশনকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ঈদগাহ এবং জেলা পর্যায়ের ঈদগাহে জড়ো হয়ে সবাইকে ‘আজাদি মার্চ’-এ শামিল হয়ে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকের দফতরের দিকে মিছিলের আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ হুরিয়তের এক মুখপাত্র তখন জানান, ‘ঈদের নামাজের আগে ইমাম এবং খতিবরা আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে অধিকৃত পার্টি, তাদের নেতা, নির্বাচন, নির্বাচনি প্রচারণা এবং নির্বাচনি ব্যবস্থাকে বর্জনের আহ্বান জানাবেন।’ আগামি ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হরতালের ডাক দেয় হুরিয়াত। সেই সঙ্গে ভারত থেকে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামী ঈদ পালনেরও আহ্বান জানিয়েছে তারা। ঈদে ‘আজাদি মার্চ’ ও জাতিসংঘ পর্যবেক্ষকের দফতরের দিকে মিছিলেরও ডাক দেয় কাশ্মির-মুক্তির পক্ষে আন্দোলনরত সংগঠনগুলোর ওই জোট হুরিয়ত কনফারেন্স। সেই মিছিলের প্রতিক্রিয়ায় অবরুদ্ধ উপত্যকায় কার্ফিউ আরোপ করে ভারত সরকার।

.

কাশ্মিরি নারীর কণ্ঠে ধ্বনিত স্বাধীনতার আকুতি

মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মিরে ঈদুল আযহার তিন দিন সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিরতা কমে আসে কাশ্মিরে। হাজার হাজার মানুষ ঈদের নামাজ পড়েন ও নবী ইব্রাহিমের স্মরণে পশু কুরবানি দিয়ে থাকেন। তবে এ বছরের বাস্তবতা ভিন্ন।  গত ৮ জুলাই অনন্তনাগের কোকেরনাগ এলাকায় সেনা ও পুলিশের বিশেষ বাহিনীর যৌথ অভিযানে হিজবুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানিসহ তিন হিজবুল যোদ্ধা নিহত হন। বুরহানের নিহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে কাশ্মির জুড়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষুব্ধ কাশ্মিরিদের দাবি, বুরহানকে ‘ভুয়া এনকাউন্টারে’ হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে প্রথমে পুলওয়ামা ও শ্রীনগরের কিছু অঞ্চলে কারফিউ জারি করা হয়। পরবর্তীতে বিক্ষোভের মাত্রা বেড়ে গেলে কাশ্মিরের দশটি জেলা, এমনকি দূরবর্তী গ্রামেও কারফিউ জারি করা হয়। সেই থেকে এই পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে ৭৮ জনের প্রাণহানি হয়েছে। আগত হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সূত্র: ডন, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, হাফিংটনপোস্ট