গৌতম বুদ্ধের পাঁচটি ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয় আষাঢ়ী পূর্ণিমা

0
237

সুবল বড়ুয়া

আজ (মঙ্গলবার-১৬ জুলাই) শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা। এইদিন বৌদ্ধদের পরম কল্যাণময় ও পুণ্যময় তিথি। মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম ও তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধের জন্মপূর্ব এবং জন্মোত্তর জীবনের পাঁচ ঐতিহাসিক ঘটনার সমন্বয় এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা। ‘সিদ্ধার্থ গৌতম বা তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ মানবকুলে জন্ম নেয়ার জন্য তাঁর মাতৃগর্ভে (রাণী মহামায়া) প্রতিসন্ধি গ্রহণ, সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগ, সর্বপ্রথম গৌতম বুদ্ধ কর্তৃক ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা বা বৌদ্ধ ধর্মমত প্রচার, প্রাতিহার্য ঋদ্ধি তথা আধ্যাত্মিক শক্তি প্রদর্শন এবং গৌতম বুদ্ধের পরলোকগত মা (রাণী মহামায়া) কে অভিধর্ম দেশনা’ এই পাঁচ ঘটনাপুঞ্জির জন্য বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর কাছে দিনটি অত্যন্ত পূণ্যময়। এই পূর্ণিমা তিথিতেই তথাগত গৌতম বুদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রতের নিয়মও প্রবর্তন করেন।

বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, বৌদ্ধ জীবন নানা কারণে ঐতিহাসিকভাবে অর্থবহ এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ সিদ্ধার্থ রূপে মায়াদেবীর গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, মহাপুরুষেরা যথাসময়ে উপযুক্ত, ভৌগোলিক সীমায়, কাম্য স্থানে উত্তম বংশের পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। এক্ষেত্রে মহামানব সিদ্ধার্থ গৌতম যথানিয়মে তাঁর পিতা রাজা শুদ্ধোধনের ঔরশে রাণী মহামায়ার গর্ভে জন্ম নিয়ে ধরাধামে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন। জন্ম, জরা, ব্যাধি, মৃত্যু, সন্ন্যাসী এই চার নিমিত্ত দৃশ্য দর্শন করে রাজকুমার সিদ্ধার্থ এ তিথিতে সংসারের মায়া মোহ ছিন্ন করে বুদ্ধত্ব লাভের প্রেরণায় গৃহত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ছয় বছর কঠোর তপস্যার মাধ্যমে বুদ্ধত্ব লাভ করে তিনি আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে তার নবধর্ম (বৌদ্ধ ধর্ম) ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র দেশনা করেন। পরবর্তীতে মায়ের মৃত্যুর পর একই পূর্ণিমা তিথিতে তিনি মায়াদেবীকে সদ্ধর্ম দেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। এ পূর্ণিমাতেই বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত বা ওয়া অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন।

উপবসত শব্দ থেকে ‘উপোসথ’ শব্দের উৎপত্তি। পালি শব্দ ‘উপোসথ’ থেকে উপবাস শব্দের উৎপত্তি। এখানে উপ একটি উপসর্গ। এর অর্থ হল নিকটে বা পাশাপাশি এবং বসত অর্থ হলো বাস করা। সুতরাং উপবসত শব্দের বুৎপত্তিগত অর্থ হল পাশাপাশি বসে ধর্ম শ্রবণ করা। অষ্টমী, অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে উপোসথিকগণ এই আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার সময় দান, শীল, ভাবনা করে আধ্যাত্মিক জীবন গঠন করে। বৌদ্ধমতে উপোসথ চার প্রকার। তা হল- প্রতিজাগর উপোসথ, গোপাল উপোসথ, নির্গ্রন্থ উপোসথ এবং আর্য উপোসথ। উপোসথিকগণ প্রাণিহত্যা করেন না। অপ্রদত্তবস্তু গ্রহণ করেন না। মিথ্যা ভাষণ করেন না। মাদকদ্রব্য সেবন করেন না। ব্রহ্মচর্য আচরণ করেন। কামাচার করেন না। রাতে আহার গ্রহণ করেন না। মালাধারণ ও সুগন্ধদ্রব্য ব্যবহার করেন না। কোনো উঁচু আসনে শয়ন কিংবা উপবেশন করেন না। এগুলো অষ্টাঙ্গ উপোসথিকের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। উপোসথ আত্মশাসন, আত্মসংযম ও চিত্ত-সাধনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বৌদ্ধজীবনে এটি হচ্ছে প্রজ্ঞা ও ধ্যান সাধনার জন্য মহৎ কাজ। দুঃখের নিবৃত্তির জন্য এ উপোসথ বৌদ্ধজীবন পদ্ধতিতে অত্যন্ত কার্যকর।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা ও বর্ষাবাসের কার্যক্রমের সঙ্গে উপোসথ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৌদ্ধ ধর্মে উপোসথের গুরুত্ব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মীয় জীবনযাপনের লক্ষ্যে তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ স্বয়ং উপোসথের প্রবর্তন করেন। উপোসথ হল ধর্মীয় অনুশাসন বা জীবনযাপনের প্রশিক্ষণ শিবির। তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ কর্তৃক বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বা ওয়ার নিয়ম প্রবর্তন আষাঢ়ী পূর্ণিমার একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ধর্ম প্রচারের প্রথমাবস্থায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সারা বছরই নিয়োজিত থাকতেন। তখন বর্ষাব্রতের কোন বিধান ছিল না। যেহেতু বর্ষাকালে ভিক্ষুদের গৈরিক বসন বা চীবর বৃষ্টিতে ভিজে ও মাটি-বালি লেগে নোংরা হয়, রাস্তাঘাট কর্দমাক্ত হয়ে পিচ্ছিল হলে পথ চলায় বিঘœ ঘটে। সবুজ ঘাস, লতা, ক্ষেতের আইল, জমির ফসল ইত্যাদি ভিক্ষুদের পদাঘাতে বিনষ্ট হয়। এ ছাড়া এ সময় পদতলে পিষ্ট হয়ে পোকামাকড়, কীট-পতঙ্গ ও অন্যান্য ছোট ছোট প্রাণীর জীবন নাশেরও যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে তথাগত গৌতম বুদ্ধ আষাঢ়ী পূর্ণিমার দিন ভিক্ষুদের জন্য বর্ষাকালীন বষাব্রতের নিয়ম প্রবর্তন করেন। এটি অবস্থার প্রেক্ষাপটে গৃহিত একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ভিক্ষুরা প্রধানত আষাঢ়ী পূর্ণিমার পরদিন থেকে একটি উপযুক্ত স্থানে তিন মাস ব্যাপী বর্ষাব্রতের অধিষ্ঠান করেন। বর্ষাব্রত পালনের মাধ্যমে ভিক্ষুদের আত্মশুদ্ধি ঘটে ও তাঁদের পারস্পরিক সৌহার্দ্যবোধ বিকশিত হয়। দীর্ঘ সময় ব্যাপী সংযম সাধনা ও বিশ্রামের ফলে তাঁদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধিত হয়, দুঃখ-নিবৃত্তির পথ প্রশস্ত হয়। এছাড়া বর্ষাব্রতোত্তর ধর্ম প্রচারে মনোবল বৃদ্ধি পায়। ভিক্ষু সংঘের পাশাপাশি বর্ষাব্রত বা ওয়ার তিন মাস সময়ে গৃহীরা উপোসথ পালনসহ দান, শীল ও ভাবনায় অধিকতর নিয়োজিত থাকার পরিবেশ লাভ করে। অধিকন্তু ভিক্ষুর বর্ষাব্রত পালনের মধ্য দিয়ে ‘প্রবারণা’ উদযাপনের সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং প্রবারণার ধারাবাহিকতায় ‘কঠিন চীবর দান’ সম্পাদনের সুবর্ণ সুযোগ লাভ করা যায়। এখানে স্মরণীয় এই, সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহত্যাগের পর নিজের চুল কেটে সত্যক্রিয়া করে সেগুলো আকাশে উড়িয়ে দিলে দেবতারা সেই চুল নিয়ে স্বর্গে চৈত্য তৈরি করেন।

এটি স্মরণে বৌদ্ধরা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমা পর্যন্ত তিনমাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠানের পর আকাশ প্রদীপ বা ফানুস উত্তোলনের মধ্য দিয়ে জগতের সকল প্রাণীর সুখ-শান্তি কামনা করা হয়।

লেখক : স্টাফ রিপোর্টার, দৈনিক দেশ রূপান্তর, চট্টগ্রাম ব্যুরো।