চট্টগ্রামে আম চাষের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে

0
284

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন, নিউজচিটাগাং:: চট্টগ্রামে আম চাষের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। শৌখিন আম চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও আম চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন জাতের ফল আছে বাংলাদেশে। তবে আমের মতো এত সুস্বাদু ফল আর নেই। আমের যেমন ঘ্রাণ, তেমনি মজাদারও বটে। তাই তো বলা হয়, ফলের রাজা আম। আম আঁটিযুক্ত ফল। আম দিয়ে বানানো হয় চাটনি, আচার, আমসত্ত্ব, জুস। গ্রীষ্মকালে আমের সঙ্গে দুধ-কাঁঠাল মিশিয়ে মজাদার খাবার তৈরি হয়। দেখতে গোলাকার, ডিম্বাকার, হূৎপিণ্ডাকার, লম্বা বা সরু নানা আকৃতিতে হয়ে থাকে। আম খুব রসাল ফল। কাঁচা আমের রং সবুজ। পাকলে অনেকটা হলদেটে এবং কমলা মিশ্রিত লাল আভাযুক্ত। কোনো কোনো জাতের আম আছে, যা পাকলেও সবুজ দেখা যায়। আকারভেদে একেকটি আমের ওজন ৭৫০ গ্রাম থেকে প্রায় এক কেজি হয়ে থাকে। এসব আমের বিভিন্ন রকম নাম আছে। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষীরশাপাত, কাঁচা মিষ্টি, হিমসাগর, আম্রপালি, খিরসাগর, ফজলি, কিষাণভোগ, মোহনভোগ, মিছরিভোগ, গুঁটি, লখনা, আশ্বিনা, নানা জাতের বারীসহ আমাদের দেশে কয়েক শ প্রজাতির আম রয়েছে।

রাউজানের টিলা ভূমিতে আম
রাউজানের টিলা ভূমিতে রাজশাহীর আম এখন । টিলাগুলোতে এখন সারি সারি আম গাছ। বিশাল বিশাল টিলা ভূমির সারি সারি আম গাছে ঝুলছে হরেক প্রজাতির আম। বাগানের প্রতিটি গাছের উচ্চতা পাঁচ থেকে সাত ফুট। গত মৌসুমে দেখা গেছে বাগানের সব গাছের ডালপালা নিচের দিকে ঝুলে আছে আমের থোকা নিয়ে। গাছ ভর্তি ফলন দেখে বাগান মালিকরা এখন আনন্দে আত্মহারা। কৃষকরা আশায় বুক রেঁধেছেন আগামী মাসে বাগানের আম পাকা শুরু হবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে পরিশ্রমের ফল ঘরে উঠানো যাবে। রাউজানের পৌরসভা এলাকার ৭নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাওলানা মোহাম্মদ এনাম সখের বশে পার্শ্ববর্তী হলদিয়া ইউনিয়নের রাধামাধবপুর এলাকায় আম বাগান করেছেন তার মালিকানাধীন পরিত্যক্ত দুই একর নেঁড়া টিলা ভূমিতে। ২০১১ সালে তিনি গাছের চারা লাগালেও এখন প্রতিটি চারা গাছে ঝুলছে থোকা থোকা আম। বাগানে আমের ফলন দেখে এনামের মুখে এখন সাফল্যের হাসি। বাগান পরিদর্শনকারীদের মধ্যে তিনি যাকে পাচ্ছেন তাকেই পরিচয় দিচ্ছেন তার বাগানের গাছে গাছে ঝুলন্ত আমের সাথে। এনামের বাগানে এখন ঝুলছে আম্রপালি, হাড়িভাঙ্গা আর রূপালী জাতের আম।

মাওলানা এনাম জানিয়েছেন, তিনি দুই একর টিলায় আম বাগান করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন রাউজান উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জসিম উদ্দিনের কথায়। তার ব্যবস্থাপনায় সংগ্রহ করা হয় তিনশ’ চারা। প্রথম বছরে গাছে মুকুল এলেও কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে মুকুল ভেঙ্গে দেয়া হয়। তৃতীয় বছরে সাফল্যের হাসি হেসে গাছে গাছে আসে আবার মুকুল। সেই মুকুল থেকে এখন আমের কাংঙ্খিত ফলন। তবে এনামের মনে ক্ষোভ প্রকৃতির উপর। হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ায় তার গাছের অনেক আম ফুলের মধ্যে ঝড়ে পড়েছে। আবহাওয়ার এই বিরূপ প্রভাব না পড়লে বাগানের ফলের সৌন্দর্য্য আরো বৃদ্ধি পেতো বলে তার ধারণা।
সফল এই আম চাষী এনাম তার আম বাগানের পাশে আরো একটি বাগান সৃষ্টি করেছেন।

দক্ষিণ চট্টগ্রামে আম চাষ

সবুজ অরণ্যবেষ্টিত দক্ষিণ চট্টগ্রামের পাহাড় ও পাহাড়ের পাদদেশে উচ্চফলনশীল আম্রপালি আম চাষে জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। শৌখিন আম চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতেও আম চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চন্দনাইশে কমরুদ্দিনের মতো অনেকেই আম চাষ করে সাফল্যের মুখ দেখছেন। দেশী জাতের আমের চেয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত আঁশবিহীন সুস্বাদু উচ্চফলনশীল আম্রপালির (বারি-৩) চাষের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। দেশী জাতের আমে প্রতি বছর ফলন না আসা ও রোগ প্রতিরোধ মতা না থাকায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত উন্নতমানের উচ্চফলনশীল আম চাষের প্রতি ঝুঁকেছেন চাষিরা। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবেও গড়ে উঠছে আম্রপালি বারি-৩ উচ্চফলনশীল আমের বাগান। এ ছাড়া কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত আরো কয়েকটি উচ্চফলনশীল জাত বারি-১ মহানন্দা, বারি-২ লণ ভোগ, বারি-৪ হাইব্রিড, বারি-৮ (বহু ক্রনিক) বারি-১০ কালিয়া জাতের উচ্চফলনশীল আমও এক সাথে চাষ করা হচ্ছে। তবে বাণিজ্যিকভাবে উচ্চ ফলনশীল আম্রপালি বারি-৩ বেশ জনপ্রিয়। শৌখিন আমচাষিদের পাশাপাশি এখন বাণিজ্যিকভাবেও আম চাষ করে যারা সফলতা পেয়েছে তাদের মধ্যে মেরিডিয়ান কোম্পানি অন্যতম। তারা বান্দরবানের লামায় ১২৫ একর বাগানে বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ করছে। মিশ্র আম চাষের মধ্যে মেরেডিয়ান কোম্পানি আম্রপালি বারি-৩ আম চাষ করে সফলতা পেয়েছে। মেরিডিয়ান কোম্পানির ব্যবস্থাপক আমবাগানি আবুল হোসেন বলেন, ২০০৪ থেকে মেরিডিয়ান কোম্পানি আম চাষ করছে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে আমের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। গত বছর ১৬০ টন আম উৎপাদন হয়েছে। চলতি বছর তারা ২৫০-৩০০ টন আম উৎপাদনের আশা করছেন। আম্রপালি একটি উন্নত জাতের উচ্চফলনশীল আঁশবিহীন সুস্বাদু আম। সর্বপ্রথম উত্তর ভারতের (লèৌ) আম দুসেহরি ও দণি ভারতের নীলম জাতের আমের মধ্যে শঙ্করায়ণ করে আম্রপালির জন্ম হয়। স্থানীয় ফল বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন নিলম জাতের পুরুষ মুকুল এবং দুসেহরি আমের স্ত্রী মুকুলকে একসাথে পরাগায়ন করে আম্রপালি জাতের উদ্ভাবন করা হয়। আঞ্চলিক কৃষি ইনস্টিটিউট হাটহাজারীর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মনরঞ্জন ধর বলেন, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ১৯৯০ থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ আম গবেষণাকেন্দ্র ১০৮ ধরনের বিডিং মেটেরিয়ালস ব্যবহার করে বাছাই পদ্ধতির মাধ্যমে দেশীয় বারি-৩ আমের উদ্ভাবন করে এবং ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশ বীজ বোর্ড কর্তৃক তা অনুমোদিত হয়। এ ছাড়া ১৯৯৮ সাল থেকে বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে আম্রপালি বারি-৩ আম চাষ স্থানীয়দের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এর আগে ১৯৯৩ সালে জাতীয় আম প্রদর্শনীতে সর্বপ্রথম আমের গুণগত মান দেখে আম্রপালি আম চাষের প্রতি সবার দৃষ্টি পড়ে। সরেজমিন চন্দনাইশ উপজেলা ছৈয়দবাদে কমরুদ্দিনের আম বাগানে গিয়ে দেখা গেছে এটি মিশ্র জাতের আমের বাগান। তবে আম্রপালি বারি-৩ তার বাগানের প্রতিটি গাছে থোকায় থোকায় শোভা পাচ্ছে। তিনি ২৩ বছর প্রবাস জীবন কাটিয়ে ব্যবসার পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে আমবাগান গড়ে তুলেছেন। তার ১৫ একর আমবাগানে বর্তমানে সাত শতাধিক আম গাছ রয়েছে। গত বছর তিনি দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন। এবার ফলন কম হলেও তিনি দুই লাখ টাকার বেশি আম বিক্রির আশা করছেন। হাশিমপুর বাগিচাহাট এলাকার সাহাব উদ্দিন একাধারে সাত বছর মলোয়েশিয়ায় প্রবাস জীবন কাটিয়েছেন। বর্তমানে তিনি ১০ একর পাহাড়ি জায়গায় আম্রপালি বারি-৩ আমের বাগান গড়ে তুলেছেন। গত বছর তিনিও প্রায় দুই লাখ টাকার আম বিক্রি করেছেন। এবারো ফলন মোটামুটি হলেও আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার আম বিক্রির আশা করছেন তিনি। বর্তমানে দণি চট্টগ্রামে চন্দনাইশে ১৫০ হেক্টর, পটিয়ায় ১২৫ হেক্টর, আনোয়ারায় ১৪০ হেক্টর, বাঁশখালী ৩০০ হেক্টর, বোয়ালখালিতে ১০০ হেক্টর, লোহাগাড়ায় ১৫০ হেক্টর ও সাতকানিয়ায় ১০০ হেক্টর বাগানে মিশ্র জাতের আমের ফলন হয়। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর চট্টগ্রাম অঞ্চলের উপপরিচালক আমিনুল হক চৌধুরী বলেন, দক্ষিণ চট্টগ্রামসহ পুরো চট্টগ্রাম জেলাতে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত বিভিন্ন জাতের উচ্চফলনশীল বারি আমের চাষ হয়। তবে আম্রপালি বারি-৩ আমের চাষ তুলনামূলকভাবে বেশি জনপ্রিয় হয়েছে এলাকার কৃষকদের কাছে। বর্তমানে বাণিজ্যিকভাবে অনেকেই আমের বাগান

পার্বত্য চট্টগ্রামে আম্রপালী আম চাষের হিড়িক

চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উন্নতজাতের আম্রপালী আম চাষ করে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়েছেন স্থানীয় আমচাষীরা। কৃষি কর্মকর্তা সাবজালউদ্দীন জানান, আম্রপালী প্রধানত ভারতীয় জাতের আম। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বারী আম-৩ জাত হিসেবে আম্রপালীকে অবমুক্ত করে। কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর ভারত থেকে ‘৯৬ সালের দিকে প্রথম এই আম্রপালী আমের চারা আমদানি করে এবং কৃষক পর্যায়ে বিনামূল্যে বিতরণ করে।

আম্রপালী আমের চাষ চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে বান্দরবান, লামা, খাগড়াছড়ি, রামগড়, কাপ্তাই, চন্দ ঘোনায় বেসরকারি উদ্যোগে আম্রপালী আমের চাষ করা হচ্ছে। মার্চ-এপ্রিল মাসের দিকে আম্রপালী আমের মুকুল আসে। জুন-জুূলাই মাসের দিকে ফলন আসে। সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে চারা রোপণের তিন বছরের মধ্যে গাছে ফল আসা শুরু করে। প্রথম পর্যায়ে গাছ ছোট থাকায় গড়ে গাছ প্রতি পাঁচ থেকে ছয় কেজি আম উত্পন্ন হয়। পর্যায়ক্রমে গাছের বর্ধনের পর গাছপ্রতি ৫০ থেকে ৬০ কেজি আম উত্পন্ন হয়। আম্রপালী আম উত্পাদনের জন্য চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলের মাটি এবং আবহাওয়া খুবই উপযোগী। ইতিমধ্যে আম্রপালী পার্বত্য চট্টগ্রামে সাড়া জাগিয়েছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে আমের মৌসুমে ১৫ থেকে ২০ হাজার টন আম্রপালী আম উত্পন্ন হচ্ছে। এই পার্বত্য অঞ্চলে ব্যাপকভিত্তিতে আম্রপালী চাষ করলে দেশে আমের সংকট দূর হবে এবং বিদেশে আম রপ্তানি করা সম্ভব হবে।

পার্বত্য অঞ্চলে আমচাষ সম্পর্কে আলাপ হয় ‘নিজামপুর এগ্রো প্রোডাক্টস’-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ কামালউদ্দীনের সাথে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে পার্বত্য অঞ্চলের লামায় বিভিন্ন জাতের আমের চাষ করে আসছেন। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে ছোট-বড় সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০ আমের বাগান রয়েছে। এসব বাগানে প্রায় ১০ হাজার লোক কর্মরত আছে। ‘৯৭ সাল থেকে পার্বত্য অঞ্চলে উত্পাদিত আমের মধ্যে রয়েছে- আম্রপালী, মল্লিকা, রাংগুয়াই, থাই কাঁচামিঠা, থাইনামডাকমাই, ফনিয়া, থাই বানানা জাতের আম। পার্বত্য অঞ্চলে উত্পাদিত আমগুলো সংগ্রহ করে আমের মৌসুমে চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর এলাকায় ‘কৃষক খামার’ নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এতে আমচাষীরা কিছুটা লাভবান হচ্ছে। ক্রেতারা এই ‘কৃষক খামার’ থেকে সুুলভে সম্পূর্ণ কেমিক্যাল মুক্ত আম ক্রয় করতে পারছেন।

পার্বত্য অঞ্চলে উন্নতজাতের আম উত্পাদনে আমচাষীদেরকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এসব সমস্যার মধ্যে রয়েছে আম উত্পাদনে প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব, দুর্গম পাহাড়ে যাতায়াতের অসুবিধা, বিদ্যুত্ সমস্যা, কৃষিঋণের দুষ্প্রাপ্যতা, বাজারজাতকরণ সমস্যা, সংরক্ষণ ব্যবস্থার অভাব, প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থার অভাব আম সংরক্ষণের যথাযথ ব্যবস্থাপনা না থাকায় উত্পাদিত আম পচে নষ্ট হয়ে যায়। এতে আমচাষীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হন। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উন্নতজাতের আম উত্পাদনে সরকারের পক্ষ থেকে কারিগর সহযোগিতা প্রদান, স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা, উন্নত যোগাযোগ ও বিদ্যুতের ব্যবস্থা এবং আম সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশ আম উত্পাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে উঠবে।

বারি-১১ জাতের এই আম গাছে বছরব্যাপী ফুল ও ফল

চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয়েছে নতুন উদ্ভাবিত বারি জাতের আমের চাষ। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, কম খরচ ও স্বল্প পরিসরে নতুন এই জাতের চাষ করা সম্ভব। পতিত জমির পাশাপাশি, চাষ করা যাবে বাড়ির ছাদেও। আর নতুন উদ্ভাবিত বারি জাতের আম পাওয়া যাবে সারা বছর। নতুন উদ্ভাবিত এ’সব জাত শিগগিরই কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামের পাহাড়তলি কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মাঠে লাগানো হয়েছে নতুন উদ্ভাবিত বারোমাসি বারি-১১ জাতের আমের চারা।

বারি-১১ জাতের এই আম গাছে বছরব্যাপী ফুল ও ফল পাওয়া যায় বলে জানান কৃষি কর্মকর্তারা।

 

নতুন উদ্ভাবিত বারি-১১ জাতের আম কৃষকদের মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার কথা জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

পাহাড়ে বার্মিজ বুকসেলাই রাংগোয়াই আম চাষ

বুকসেলাই নামটা একটু অদ্ভুত শুনালেও আমের এ জাতটি গত কয়েক বছরে দেশের অন্যত্রও পরিচিতি পেয়েছে। আমটি খেতে বেশ সুস্বাদু ও পোকার আক্রমণও কম হয়। পাহাড়ি এলাকায় সহজে চাষ করা যায় বলে জুমচাষের পরিবর্তে অনেক চাষি পাহাড়ে বুকসেলাই আম চাষ করছেন। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান জেলাতেই বুকসেলাইয়েরর চাষ সবচেয়ে বেশি।

বুকসেলাই স্থানীয় জাত নয়। মায়ানমারের জাত হিসেবে পরিচিত এ আমের অন্য নাম রাংগোয়াই। বার্মিজ ভাষায় রাংগোয়াই অর্থ বুকে শিরধারার মতো সেলাই। একে রাংগোয়াইসিও বলা হয়, বার্মিজ ভাষায় ‘সি’ অর্থ হলো ফল। ধারণা করা হয় জেলার নাইক্ষ্যংছড়ি-থানচি সীমান্ত হয়ে জাতটি এদেশে এসেছে। স্থানীয় সূত্র জানায়, প্রায় ১৫/২০ বছর আগে পাহাড়িরা এ আম মায়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে পার্বত্য জেলা বান্দরবান নিয়ে আসে। তবে কৃষি বিভাগের কাছে কখন থেকে চাষ শুরু হয়েছে তার তথ্য পাওয়া যায়নি।

কৃষি বিভাগ জানায়, বান্দরবানে চার ধরনের বুকসেলাই আমের চাষ হচ্ছে। একটি আগাম জাত হিসেবে পরিচিত, আরেকটি শাঁস আঁশযুক্ত। অন্য দুটির একটির মাংস লালচে-হলুদ ও আরেকটি নাবি জাত- এটি সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত বাজারে পাওয়া যায়।

জেলা শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ আলতাফ হোসেন জানান, স্থানীয় জাতগুলোর তুলনায় বুকসেলাইয়ে পোকার আক্রমণ অনেক কম। যার কারণে পাহাড়ি চাষীরা আমটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তারা বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভবান হতে পারছেন। মায়ানমারের আমের এ জাতটি বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় স্থানীয়ভাবে বার্মিজ নাম অক্ষুণ্ন রেখে রাংগোয়াইসি বললেও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোতে ভোক্তাদের কাছে এটি বার্মিজ ও বুকসেলাই রাংগোয়াই আম নামে পরিচিত। খেতে খুবই সুস্বাদু, পোকার আক্রমণ কম ও স্বল্প সময়ে অধিক লাভজনক হওয়ায় এ আমের চাষ বান্দরবানসহ তিন পার্বত্য জেলায় দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে।

কৃষি বিভাগ সূত্রে আরও জানা গেছে, গত মৌসুমে জেলার ৩ হাজার ৬৫০ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে আমের চাষ হয়েছে। তার মধ্যে বুকসেলাই আমের চাষ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। উৎপাদনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার মেট্রিক টন। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ফলন আশানুরূপ হয়নি। খুচরা ব্যবসায়ীরা প্রতি কেজি ৬০/৭০ টাকায় কিনে বাজারে ১০০/১২০ টাকায় বিক্রি করছে।

বান্দরবান জেলার হাট-বাজারগুলোতে এখন চোখ পড়ছে বুকসেলাই আম। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য স্থানেও যাচ্ছে। আমচাষি লাললিয়াম বম ও চষা থোয়াই মারমা জানান, পাহাড়ে স্বল্প সময়ে বুকসেলাই আম চাষ দ্রুত বেড়েছে। কিন্তু পোকার আক্রমণের কারণে এবার দাম পাওয়া যাচ্ছে না। ফলনও অন্যান্যবারের তুলনায় কম হয়েছে। ফলে চাষিরা লাভের মুখ দেখছে না। সরকারিভাবে পোকা দমনে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়নি। এ কারণে অনেক চাষি জানেই না পোকা কিভাবে দমন করতে হবে।

আম ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সিরাজ জানান, ছয় লাখ টাকায় নয়টি আম বাগান কিনে নিয়েছি। এ আম চট্টগ্রাম ও কুমিল্লায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করছি। স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করেও মোটামুটি লাভ পাওয়া যাচ্ছে।

আম নিয়ে গল্পকথা

মহাভারতে আম নিয়ে মজার এক গল্প রয়েছে। সীতাকে রাবণ অপহরণ করে নিয়ে যায় লঙ্কায়। বন্দী অবস্থায় সীতাকে ফল খাওয়ানো হয়। নাম না-জানা ফল খেয়ে খুব মজা পায় সীতা। নিজের ভাগের অংশ থেকে সীতা কয়েকটা ফল রাম, লক্ষ্মণ ও হনুমানের জন্য রেখে দেয়। কদিন পর সীতার খোঁজে হনুমান গেল লঙ্কায়। ঠিক ঠিক হাজির হয় বন্দী সীতার কাছে।

সীতা হনুমানকে ওই ফল দিয়ে বলে, এগুলো তোমার, রাম ও লক্ষ্মণের জন্য। তোমরা খেয়ো।

হনুমান সেই ফলগুলো থেকে একটা ফল খেয়ে আর লোভ সামলাতে পারেনি। সব ফল একাই খেয়ে ফেলে।

ফিরে যায় সীতার কাছে। বলে, মা, আমি অপরাধ করেছি। ফলগুলো রাম ও লক্ষ্মণকে না দিয়ে একাই খেয়েছি। এখন বলো এই ফলের নাম কী? কোথায় পাওয়া যায়?

সীতা বলে, আমি তো এখানে বন্দী। কোথায় কী আছে আমি বলতে পারব না। এই ফলের কী নাম, তা-ও জানি না। তবে আশপাশেই পাওয়া যাবে হয়তো। খোঁজ করে দেখতে পারো।

হনুমান ফলের সন্ধানে বের হয়।

এত স্বাদের ফল, কী নাম এর? খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যায় আমবাগান। গাছ থেকে একটি আম খেয়ে হনুমান বুঝতে পারল, সীতার দেওয়া ফলের মতো এই ফলেরও একই রকম স্বাদ। আমগাছে উঠে হনুমান ইচ্ছেমতো খেতে থাকে আর আমের আঁটি এদিক-সেদিক ছুড়ে মারতে থাকে। কথায় বলে, হনুমানের ছুড়ে দেওয়া আমের আঁটি থেকেই এই ভারত উপমহাদেশে জন্ম হয়েছে আমগাছের।

 

আমগাছের ইতিহাস

আমগাছ নিয়ে প্রচলিত গল্পে বলা হয়, ৬৩২-৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে চীন দেশের পর্যটক হিউয়েন সাং ভারতবর্ষে বেড়াতে আসেন। সেই সময় তিনি ফল হিসেবে আমকে পরিচিত করে তোলেন। এরপর জানা যায় যে মোগল সম্রাট আকবর (১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিষ্টাব্দ) তাঁর শাসন আমলে ভারতের লাখবাগের দারভাঙা এলাকায় প্রায় এক লাখ আমগাছ রোপণ করেছিলেন। এটিকে বলা হয় ভারতীয় উপমহাদেশে সবচেয়ে বড় আমবাগান। মূলত মোগল সম্রাটদের আমলে ভারত উপমহাদেশে বিভিন্ন জাতের আমের উদ্ভাবন হয়েছে। আমের ইংরেজি নাম Mango। বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাংগিফেরা ইন্ডিকা।

 

উন্নত জাতের আম

বাংলাদেশের সব অঞ্চলে আমের চাষ হলেও উন্নত জাতের আম হয় চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নওগাঁ ও দিনাজপুর এলাকায়। চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাট বাজারকে আমবাজারের রাজধানী বলা হয়। এ ছাড়া শিবগঞ্জ, ভোলাহাট, আলীনগর, রহনপুর এলাকায় আমের বড় বাজার বসে। এখান থেকে আম ব্যবসায়ীরা আম কিনে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করেন।

 

আমের পুষ্টিগুণ

আমের অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। উচ্চমাত্রার চিনি, ভিটামিন ‘এ’ এবং ভিটামিন ‘সি’ রয়েছে এই ফলে। আমে রয়েছে ভিটামিন ‘বি’ কমপ্লেক্স। এই ভিটামিন শরীরের স্নায়ুগুলোতে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়িয়ে দেয়। শরীরকে রাখে সতেজ। ঘুম আসতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে আঁশ। আঁশ-জাতীয় ফল কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মুখের ব্রণ প্রতিরোধ করে। চিকিৎসকদের মতে, আমে খনিজ লবণের উপস্থিতিও রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। দাঁত, নখ, চুল, মজবুত করার জন্য আমের খনিজ লবণ উপকারী ভূমিকা পালন করে। বুদ্ধি ও শরীরের শক্তি বাড়ানোর জন্য আম ভীষণ জরুরি ফল।

 

জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় ঘটে ব্রিটিশদের হাতে পলাশীর আমবাগানে।

বাংলাদেশের যেদিকে তাকানো যায়, চোখে পড়ে আমগাছ। কি শহরে, কি গ্রামে! সহজলভ্য এই আমগাছ তাই জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

২০১০ সালের ১৫ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কেন আমগাছকে জাতীয় বৃক্ষ হিসেবে ঘোষণা করা হলো এর কয়েকটি কারণও আছে।

আমগাছ দেশের সর্বত্রই সহজে জন্মায়।

আমাদের জাতীয় সংগীতে আমগাছের কথা আছে। ‘ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…’

মহান ভাষা আন্দোলনের সময় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সমাবেশ হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে। এটি মেহেরপুর জেলায় অবস্থিত।

 

আমগাছের কাঠ দিয়ে আসবাব বানানো যায় ও জ্বালানি হিসেবেও কাজে লাগে।

আম সবচেয়ে উৎকৃষ্ট ফল। খেতে সুস্বাদু।

দেশের প্রায় সব এলাকায় আমগাছ দেখা যায়।