দুর্নীতির শৃঙ্খলে আবদ্ধ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ত্ব

0
107

অতি ব্যয়ে বৈদেশিক ঋণ এবং দুর্নীতির শৃঙ্খলে আটকা পড়ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্ব।

দুর্নীতি ও লুটপাটের কারণে নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুন থেকে তিনগুন হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার প্রকল্প ৫০০০ কোটি টাকা হলে সেগুলো হয়ে যায় লুটপাটের অবাধক্ষেত্র; ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের অর্থনীতি ও জনগন সরকার নীরব থাকলে জনগনকেই সোচ্চার হতে হবে। রক্ষা করতে হবে দেশ ও অর্থনীতি

বর্তমানে বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ ব্যয় বিশ্বের অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক বেশি। এমনকি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান ও চীনের চেয়ে বাংলাদেশে এই নির্মাণ খরচ অনেক বেশি। এমনকি দেশের মধ্যেই এক প্রকল্প থেকে অন্য প্রকল্পের নির্মাণ ব্যয়ও বেশি। এখন দেখা যাচ্ছে, সড়কের পাশাপাশি রেলপথেও একই চিত্র। গতকাল প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা গেছে, বি-বাড়িয়ার আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত রেলপথটি মিটারগেজ থেকে ডুয়েলগেজ করা হবে। এ কাজে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ছে ৬৭ কোটি টাকার বেশি। এতে যে ব্যয় ধরা হচ্ছে তা অন্য যেকোনো রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি ব্যয়ের তিন গুণেরও বেশি। দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুরের কাউনিয়া পর্যন্ত ৫৭ কিলোমিটার লাইনকে ডুয়েলগেজ চলমান প্রকল্পেই প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হচ্ছে ১১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা বলে প্রকল্পের ব্যয় বিশ্লেষণ থেকে তা জানা গেছে।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের মতে, বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশ্বমানের রেলপথে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ৩১ কোটি টাকা। আর দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে বৈদ্যুতিক সিঙ্গেল ট্র্যাকের লাইন, সিগন্যালিং ও অন্যান্য অবকাঠামোসহ কিলোমিটারপ্রতি রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হয় সর্বনিম্ন ২৩ থেকে সর্বোচ্চ ৩১ কোটি টাকা। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রেলপথ নিয়ে শতাধিক প্রকল্প রয়েছে। এতে প্রতি কিলোমিটারে খরচ পড়ে ১২ থেকে ১৭ কোটি টাকা। আর চীনে সিঙ্গেল লাইনের সাধারণ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারে ব্যয় হয় প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা। পাকিস্তানে রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটার প্রতি গড় ব্যয় হয় ১৫ কোটি টাকা। যেখানে বাংলাদেশে কিলোমিটার খরচ প্রায় ৬৭ কোটি টাকা।
বাংলাদেশে ফ্লাইওভার নির্মাণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৩৫০ কোটি টাকা, কিন্তু পরবর্তীতে সে ব্যয় বেড়ে দাড়ায় প্রায় ২৩০০ কোটি টাকায়, মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভারের প্রাথমিক ব্যয় প্রথমে ৭৫০ কোটি টাকা থাকলেও পরবর্তীতে সেই ব্যয় গিয়ে দাড়ান ১ হাজার ২০০ কোটি টাকায়। চার লেনের এক কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করতে বাংলাদেশে খরচ হচ্ছে গড়ে ১২৩-২৫০ কোটি টাকা। প্রতিবেশী দেশ ভারতে এ দূরত্বের ফ্লাইওভার নির্মাণে করতে খরচ হচ্ছে ৯০ থেকে ১৫০ কোটি টাকা। অন্যদিকে, সড়ক নির্মাণেও বাংলাদেশে ব্যয় এশিয়া মহাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। প্রতি কিলোমিটার রাস্তায় বাংলাদেশে খরচ করা হয় প্রায় ৬০ কোটি টাকা। যেখানে ভারত, পাকিস্তান, চীনে খরচ হয় মাত্র ১২-১৫ কোটি টাকা।
খোদ দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার (গুলিস্তান-যাত্রাবাড়ী ফ্লাইওভার) নির্মাণে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, ফ্লাইওভার নির্মাণে বিনিয়োগের সঙ্গে কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের (ডিসিসি)। তারপরও পাঁচ অর্থবছরে তারা এ প্রকল্পে ব্যয় দেখিয়েছে ২ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। যদিও এ ব্যয়ের কোনো তথ্য-প্রমাণ সংস্থাটির কাছে নেই। কোন খাতে কত ব্যয় হয়েছে, সে হিসাবও নেই তাদের কাছে। অন্যদিকে, সরকার রেললাইনের ডুয়েলগেজের রূপান্তরের যে প্রকল্প গ্রহন করেছে সেটাতেও দুর্নীতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কারণ, এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন ওই ব্যয় প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক বলে আপত্তি জানিয়েছে। জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকার ওই প্রকল্পে ১০ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৫ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। অথচ ওই প্রকল্প ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েই বাস্তবায়ন সম্ভব। মূলত ওই প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখিয়ে টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর সেজন্যই দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হচ্ছে। ঋণের টাকায় ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোনো লাভ হবে না বলে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা মনে করছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সরকার এইসব প্রকাশ্য মহা লুটপাটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেনা। উল্টো সরকারের মধ্যেই ঘাপটি মেরে থাকা বেশ কিছু মহল এই অতিব্যয় থেকে নিজেদের পকেট ভারী করছে। আর বিপরীত দিকে এইসব প্রকল্পগুলোতে দুর্নীতির কারণে যে আর্থিক ব্যয় বাড়ছে সেই ব্যয় সরকার পূরণ করছে ঋণ থেকে। আর এই ঋণের বোঝা গিয়ে পড়ছে দেশের জনগনের উপর। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সদ্য জন্মগ্রহণকারী দেশের একটি শিশুও ৪৬ হাজার টাকার ঋণের বোঝা নিয়ে ভুমিষ্ট হচ্ছে।
অন্যদিকে, উন্নয়নের নামে যে মহালুটপাট সংগঠিত হচ্ছে তার বিরুদ্ধে জনগনের কোন চেতনা লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। জনগন একেবারেই নীরব ভূমিকা পালন করছে। এহেন দুর্নীতি সম্পর্কে জনগন কোন খবরই রাখছে না। খবর রাখার প্রয়োজনও মনে করছেনা। জনগনকে জানালেও কর্ণপাত করছে না। অথচ ধীরে ধীরে এসব অতি ব্যয়ে বৈদেশিক ঋণ এবং দুর্নীতির শৃঙ্খলে আটকা পড়ছে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ত্ব।
এক্ষেত্রে সরকার যদি সচেতন না হয় তাহলে জনগনকেই সক্রিয় হয়ে প্রতিরোধ করতে হবে। কারণ দেশ বা দেশের সম্পদ খোয়া গেলে সরকারের কিছু আসে যায়না। সরকার আসে, যায় কিন্তু জনগণ ছিল, আছে এবং থাকবে। ইনশাআল্লাহ! তাই সংবিধান মতে, দেশের মালিক সরকার নয়- মালিক জনগন। যারা মালিক তাদেরকেই তাদের মালিকানা রক্ষা করতে হবে।
মূলত, এসব অনুভূতি ও দায়িত্ববোধ আসে ইলম ও জজবা থেকে। আর তার জন্য চাই নেক ছোহবত মুবারক তথা মুবারক ফয়েয-তাওয়াজ্জুহ।