নতুনের আবাহন!

0
111

দক্ষিণ আফ্রিকাবিশ্বকাপ ক্রিকেটে চিরন্তন সত্যির একটা তালিকা করুন তো দেখি! করে ফেলেছেন? কী কী রাখলেন, জানতে খুব কৌতূহল হচ্ছে। আপনার তালিকা এক রকম হবে, আমারটা হয়তো আরেক রকম। একেক জনের একেক রকম হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। তবে একটা চিরন্তন সত্যি বোধ হয় সবারই ‘কমন’ থাকবে—দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ জেতে না।
আরও সুনির্দিষ্ট করেও বলা যায়। নকআউট পর্ব শুরু হওয়া মানেই দক্ষিণ আফ্রিকার দৌড় শেষ। আপনিও দেখি মাথা ঝোঁকাচ্ছেন। ঝোঁকানোরই কথা। গত ৬টি বিশ্বকাপ তো আমাদের এ-ই শিখিয়েছে।
কেন যেন মনে হচ্ছে, সেই ‘চিরন্তন’ সত্যিকে ছুটি দিতে আসছে এবারের বিশ্বকাপ। এটিই হয়তো দক্ষিণ আফ্রিকার শাপমোচনের বিশ্বকাপ। এই যা, এটা তো ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে গেল! যা করব না বলে রীতিমতো প্রতিজ্ঞা করেছিলাম।
বিশ্বকাপ নিয়ে বিশেষ সংখ্যায় ‘কে জিতবে বিশ্বকাপ’–জাতীয় একটা লেখা নাকি থাকতেই হয়। জ্যেষ্ঠতা অথবা বিশ্বকাপ কাভার করার ‘অপরাধ’-এর কারণে এই লেখার ‘শাস্তি’টা বরাবরই আমাকে ভোগ করে আসতে হচ্ছে। প্রায় দুই মাসের সফরের প্রস্তুতি নিয়ে ব্যস্ততা ঢাকায় সেটি সেরে ফেলতে দেয়নি। লিখতে হচ্ছে তাই প্রায় ৪০ হাজার ফুট উঁচুতে উড্ডীয়মান মেলবোর্নগামী প্লেনে বসে। প্লেন কি এসব লেখার জায়গা নাকি! শরীরে ক্লান্তি, চোখে ঘুম। সেসব তাড়াতে সামনের পর্দায় বিনোদনের হরেক আয়োজনে চোখ রাখা যেতে পারে। তাই বলে লেখা? শুরুই করতে পারছিলাম না। শেষ পর্যন্ত শুরুতেই কি না আগুন নিয়ে খেলা! বিশ্বকাপ নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী তো তা-ই।
বিশেষ করে এবারের বিশ্বকাপ। যেটি কে জিতবে ভবিষ্যদ্বাণী করা মানে হাড়িকাঠে গলা বাড়িয়ে দেওয়া। বলা হচ্ছে, ইতিহাসের সবচেয়ে উন্মুক্ত বিশ্বকাপ এবং আসলেও তা-ই। এমনই উন্মুক্ত যে, ‘কে জিতবে’ না বলে ‘কে জিতবে না’ বলাটাই এবার নিরাপদ। সহজও। জিম্বাবুয়ে জিতবে না, আইসিসির চার সহযোগী সদস্য দেশের জেতার তো প্রশ্নই ওঠে না। বাংলাদেশও যে জিতবে না, লাল-সবুজের আবেগে টইটম্বুর থেকেও আপনার তা অজানা থাকার কথা নয়। গত পাঁচটি বিশ্বকাপের ইতিহাস এবং ওয়ানডেতে নিজেদের হারিয়ে খোঁজার কথা মনে রাখলে ইংল্যান্ডকেও এই দলে ফেলে দেওয়া যায়। বাকি থাকে সাতটি দল এবং আপনিই বলুন, সেই সাত দলের কোনটি জিতলে আপনি বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে ফেলবেন?
রংধনুর সাত রং। ওই সাতটি দেশকে প্রতিনিধিত্বকারী রংগুলো পাশাপাশি সাজিয়ে ‘বেনীআসহকলা’র মতো সহজে উচ্চারণযোগ্য কিছু বানানো না গেলেও রঙে রঙে একটা রংধনু-মতো তো হয়ই। সেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের রংটাই একটু বিবর্ণ দেখাচ্ছে। প্রথম দুটি বিশ্বকাপজয়ীদের পরাক্রমের গল্প অনেক দিনই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই নিয়েছে। সাম্প্রতিক বিতর্ক আর অনভিজ্ঞ তরুণ এক অধিনায়ক মিলিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপ জিতলে চোখ কপালে না উঠুক, একটু বিস্ফারিত তো হবেই। বাকি ছয় দলের কোনোটি জিতলেই যা হওয়ার কথা নয়।
ওই ছয় দেশের মধ্যে শুধু দুটিই এখনো বিশ্বকাপ জেতেনি। চৌকাঠে গিয়ে হোঁচট খেয়েছে, এটাও বলা যাচ্ছে না। কারণ, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার কখনো ফাইনালেই ওঠা হয়নি। যাদের হিসাব থেকে বাদ দিয়ে দিচ্ছি, সেই ইংল্যান্ড এখানে এগিয়ে। কিন্তু তা নিয়ে গর্ব করার মতো অবস্থা নয়। তিন-তিনবার ফাইনালে উঠেও যে ট্রফিটা ছোঁয়ার সুযোগ মেলেনি। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২—চারটি বিশ্বকাপের তিনটিতেই ফাইনালে ছিল ইংল্যান্ড। ফাইনালে পরাজয়ের হ্যাটট্রিক করে ফেলার পর আর সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি। এবারও না পারলে সেই ব্যর্থতার ডাবল হ্যাটট্রিক হয়ে যাবে।
নিউজিল্যান্ডের ঘটনা উল্টো। মাঝের চার বছর ফর্ম যেমনই থাকুক, বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলাটা যাদের জন্য এক রকম নিয়মে পরিণত। সেখান থেকে ব্যর্থ মনোরথে বিদায় নেওয়াটাও। এটিকে কি ভবিতব্য বলে মেনেই নিয়েছে কিউইরা?
সেমিফাইনালে না হেরেও ফাইনালে উঠতে না পারার একমাত্র ‘কীর্তি’টি দক্ষিণ আফ্রিকার। এজবাস্টনে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ‘টাই’-এ শেষ হওয়া সেই সেমিফাইনাল বিশ্বকাপ ইতিহাসে স্মরণীয়তম ম্যাচ হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভোট পায়। এর আগে-পরে আরও দুবার সেমিফাইনালে শেষ হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকার অভিযাত্রা। এর মধ্যে প্রথম সেমিফাইনালটি তো বিশ্বকাপ আবির্ভাবেই। ১ বল ২২ রানের ভুতুড়ে সমীকরণ সেই ম্যাচেই।
ভুতুড়ে গল্প দক্ষিণ আফ্রিকা অনেকই লিখেছে। বিশ্বকাপ থেকে যতভাবে বিদায় নেওয়া সম্ভব, সবই মোটামুটি সম্পন্ন। এবার কি তাহলে নতুন গল্প?
পুরোনো গল্পটা সবারই জানা। শুধু ক্রিকেট কেন, কোনো খেলাতেই কোনো দলের গায়ে ‘চোকার্স’ শব্দটা এমন আঠার মতো লেগে নেই। অবস্থাটা এমন হয়েছে যে, দক্ষিণ আফ্রিকা ব্যাট-বলের দক্ষতায় প্রতিপক্ষের কাছে হার মানলেও সেটি ‘চোকিং’ হয়ে যায়, যা শুনতে শুনতে দক্ষিণ আফ্রিকার গা-সওয়া হয়ে যাওয়ার কথা। আসলেই যে হয়ে গেছে, তা জানা যাচ্ছে জ্যাক ক্যালিসের কল্যাণে। দক্ষিণ আফ্রিকান দলে ‘চোকার্স’ কথাটা নিয়ে নাকি হাসি-তামাশাও হয়। সমস্যা হলো, একটা বিশ্বকাপ না জেতা পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকা দলকে নিয়ে হাসি-তামাশা চলতেই থাকবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা বা নিউজিল্যান্ড জিতলে বিশ্বকাপ নতুন চ্যাম্পিয়নের দেখা পাবে। আগের ১০টি বিশ্বকাপ ভাগ করে নিয়েছে মাত্র পাঁচটি দেশ। এতে আসলে অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের চিত্রটা একদমই ফুটে ওঠে না। শতাংশের হিসাবে বরং সেটি পরিষ্কার হয়। দশবারের চারবারই চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া অর্থাৎ সাফল্যের ৪০ শতাংশই তাদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও ভারত দুবার করে জিতে মিলিতভাবে বিশ-বিশ ৪০ শতাংশ। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা মিলে বাকি ২০ শতাংশ।
বিশ্বকাপের ‘চিরন্তন সত্যি’ দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল। একসময় চিরন্তন সত্যি বলে বিবেচিত অনেক কিছুই কিন্তু মিথ্যা বলে প্রমাণিত। যেমন—স্বাগতিকেরা কখনো বিশ্বকাপ জেতে না। শ্রীলঙ্কার ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ের পরও এটিকে অসার বলা কঠিন ছিল। শ্রীলঙ্কা তিন স্বাগতিকের একটি ছিল বটে, কিন্তু নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সেখানে না যাওয়ায় লঙ্কানরা নিজের দেশে সেভাবে আর খেলল কোথায়! সত্যিকার অর্থে ‘মিথ’টা ভেঙেচুরে চৌচির করার কাজটা করেছে আসলে ধোনির ভারত।
এবারের স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়াকে প্রেরণা খুঁজতে তাই চার বছর পেছন ফিরে তাকালেই চলছে। ২৩ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডে সর্বশেষ বিশ্বকাপে হট ফেবারিট হিসেবে শুরু করে সেমিফাইনালেও উঠতে পারেনি অ্যালান বোর্ডারের দল। আততায়ী হয়ে এসেছিল প্রত্যাশার চাপ। তা সেটি ২০১১ বিশ্বকাপে ভারতীয় দলের চেয়ে কোন দলের ওপর কোনকালে ছিল!
স্বাগতিকের ভূমিকায় সাফল্য দিয়ে না হোক, বিশ্বকাপের আরেকটি ‘মিথ’ কিন্তু অস্ট্রেলিয়াই ভেঙেছে। সেটি কী? ফেবারিটরা কখনো বিশ্বকাপ জেতে না। প্রথম বিশ্বকাপে সেভাবে কোনো ফেবারিটই ছিল না। ওয়ানডেতে কে ভালো, কে খারাপ সেটিই তো তখনো পরিষ্কার নয়। বিশ্বকাপ শুরুর আগে ওয়ানডেই হয়েছিল মাত্র ১৮টি। পরের বার অবশ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ মোটামুটি ফেবারিট হিসেবেই শুরু করেছিল। কিন্তু এর পর থেকে ফেবারিট মানেই যেন মৃত্যু পরোয়ানা।
২০০৩ ও ২০০৭ বিশ্বকাপে উল্টো এই ‘মিথ’কেই কবর দিয়ে দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া। দুবারই ফেবারিট হয়ে শুরু করেছে এবং সেটির মর্যাদা রেখে জিতেছে দোর্দণ্ড প্রতাপে। টানা তিনবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিশ্বকাপটাকে একটু একঘেয়েও বানিয়ে ফেলেছিল। সেই একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতেই ২০১১ বিশ্বকাপ নিয়ে প্রথম আলোর বিশেষ সংখ্যায় লেখার শিরোনাম দিয়েছিলাম—অস্ট্রেলিয়া যেন না জেতে!
অস্ট্রেলিয়া জেতেনি। এবার কী চাইব? কী আর, দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী তো করেই ফেলেছি! চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই দল। আর একটা বিশ্বকাপ ওদের পাওনাও। নতুন গল্পে হোক না নতুনের আবাহন!