নতুন করে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে রোহিঙ্গা শরণার্থী

0
70

মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অপেক্ষায় থাকার যে খবর শোনা গিয়েছিল, তা-ই সত্য হলো।  আরো হামলার আশংকায় নতুন করে দলে দলে বাংলাদেশে ঢুকছে তারা। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসতে উত্সাহিত করেছে শরণার্থীদের ব্যাপারে বাংলাদেশের নমনীয় অবস্থান। রোহিঙ্গারা পথে পথে জিরিয়ে নিয়ে নিরাপদ এলাকাগুলো দিয়ে (যেখানে সৈন্যদের আনাগোনা কম) দীর্ঘ পথ হেঁটে মিয়ানমার উপকূলের নাইক্ষং দ্বীপে পৌঁছান। সেখান থেকেই তারা শাহ পরীর দ্বীপ হয়ে টেকনাফে ঢুকেন।

নতুন করে আসা রোহিঙ্গারা বলছেন, তারা মংডু বুচিদংয়ের কিছুটা নিরাপদ এলাকাগুলোতে থাকতেন। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার আশায় প্রথমদিকে আসেননি। তবে শেষ পর্যন্ত আসতে বাধ্য হচ্ছেন। এদের বেশিরভাগই দলে দলে ভাগ হয়ে আসছেন। এক একটি পাড়া কিংবা গ্রামের লোকজন দল বেঁধে আস্তে আস্তে এদিকে অগ্রসর হয়েছেন। তবে এদের মধ্যে হতাহত কিংবা সহায় সম্পদ হারানো শরণার্থীর সংখ্যা কম। তারা মূলত পাশের এলাকাগুলোতে মিয়ানমার বাহিনীর নৃশংসতা দেখে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসছেন।

দাবনখালী নামের এক জায়গা থেকে এক দলে এসেছেন ১৬০ জনের বেশি রোহিঙ্গা। তাদের একজন মোহাম্মদ জুলফিকার। গতকাল শনিবার শাহপরীর দ্বীপে তিনি বলছিলেন, তারা  ১৮টি পরিবার এক হয়ে বাংলাদেশ আসতে প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। যদি সহিংসতা থেমে যায় তাহলে না আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মিয়ানমার সৈন্যদের অব্যাহত পীড়নে চলে আসতে বাধ্য হন। খাবার দাবার, স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী নিয়ে গত ৭ সেপ্টেম্বর রাতে তারা দল বেঁধে রওয়ানা দেন। দিনের বেলা সুযোগ বুঝে অল্প অল্প করে বাংলাদেশের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। রাতে কখনো পাহাড়ের আড়ালে, কখনো ঝোপ জঙ্গলে বিশ্রাম নিয়েছেন। ভোর হলে আবার যাত্রা শুরু। এভাবে করে নাইক্ষং দ্বীপে পৌঁছান।

কোনকারপাড়া থেকে আসা হাফিজা খাতুন জানান, তারা ৯ সেপ্টেম্বর ৭৬ জনের একটি দল নিয়ে রওয়ানা হন। দুইদিন পথ অতিক্রম করার পর কিছু রাখাইন তাদের জানায় কিছু হবে না, বাড়ি ফিরে যেতে। ওইদিন রাতে তারা আবার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর রোহিঙ্গাদের আরেকটি দলের সাথে দেখা হয়। তারা জানায়, কানকারপাড়ার পাশের গ্রা গোজদিয়ায় ওইদিন আগুন দেওয়া হয়েছে। আতঙ্কিত হয়ে তারা পুনরায় বাংলাদেশের দিকে হাঁটতে শুরু করেন।

এদিকে বুচিদংয়ের উকিল পাড়া থেকে আরেকটি দলের সাথে এসেছেন হোসেন মিয়া। বাড়িতে তার ৫ একর জমি ছিলো। বড় মুদির দোকানও ছিলো। ভিটেমাটি সহায় সম্পদ রেখে যখন পরিবার নিয়ে তারা বাংলাদেশে আসছিলেন তখন তারা প্রাণ হারানোর ভয়ে ছিলেন। সেই ভয় যে অমূলক ছিলো না তা দেখলেন একদিন পর। সীমান্তের খুব কাছের একটি এলাকায় আসার পর সৈন্যরা তাদের ঘিরে ধরে। আবার কিছু সৈন্য তাদের চলে আসার সুযোগ দিতেও বলে। এসময় কেউ কেউ হাঁটা শুরু করলে পেছন থেকে তিনজনের গায়ে গুলি লাগে। একজন সেখানেই মারা যায়। বাকি দুজনকে অনেক কষ্টে সাথে করে নিয়ে আসেন তারা।

গতকাল শনিবার শাহ পরীর দ্বীপে এমন অনেক রোহিঙ্গার সাথে দেখা হয়েছে যারা ৭-৮ দিন সময় নিয়ে পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে ঢুকেছেন। সকাল সাতটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত ১৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেখা গেছে। এদের বেশিরভাগই বুচিদংয়ের উকিলপাড়া, শীলখালী, ডনখালী, দাবনখালী, মংডু সদর, উত্তর মংডুর কুয়াঞ্চিবন, সাহেব বাজার, কোনকারপাড়া, গোজদিয়া ও রাথিডংয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন।

স্থানীয়রা বলছেন, সারাদিনে এই সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি হবে। এ ছাড়াও উখিয়ার তমব্রু, ঘুমধুম, বালুখালী, কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের শাপলাপুর হয়েও বেশকিছু রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের খবর পাওয়া গেছে।

শরণার্থীরা বলছেন, দীর্ঘ পথ হেঁটে আসতে গিয়ে তারা অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেউ কেউ পিছিয়ে পড়েন। বাকিরা তাদের অনেক কষ্টে এগিয়ে নিয়ে এসেছেন। তারা বলছেন, সৈন্যরা এখনো সেখানে নৈরাজ্য চালাচ্ছে। কখনো তাদের বাড়ি গিয়ে চলে যেতে হুঁশিয়ার করে যাচ্ছে, কখনো আবার বাড়ি ছাড়তে নিষেধও করছে। মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপের কারণেই সৈন্যরা এমন করছে বলে দাবি করেন কেউ কেউ। তবে বাড়ি খালি পেলে সাথে সাথে পুড়িয়ে দিচ্ছে বলে জানান তারা।

সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকাদান: মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা শিশুদের মাঝে নানা সংক্রামক ব্যাধি থাকার আশঙ্কায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে টিকাদান কর্মসূচি শুরু হয়েছে। গতকাল সকাল ৯টায় কক্সবাজারের সিভিল সার্জন ডা. আবদুল সালাম এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

তিনি জানান, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেক শিশু স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধিও থাকতে পারে। এ সব রোগ বাংলাদেশেও ছড়াতে পারে। তাই রোহিঙ্গা শিশুদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে এবং স্থানীয়দের মাঝে যাতে সংক্রমণ না হয় সে জন্য ইউনিসেফের সহায়তায় বিশেষ টিকাদানের এ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এতে ৬ মাস থেকে ১৫ বছরের সকল শিশুকে হাম রুবেলা (এমআর) এবং শূন্য থেকে ৫ বছরের সকল শিশুকে পোলিও টিকা ও ভিটামিন এ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে।

টাকা আদায়ের অভিযোগে সাবেক ইউপি মেম্বার আটক: টেকনাফের শাহ পরীর দ্বীপের সাবেক ইউপি মেম্বার মোঃ ইসমাইলকে আটক করেছে কোস্টগার্ড। তার বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের অভিযোগ আছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

টেকনাফের ওসি মাইন উদ্দিন জানান, ইসমাইল প্রতি রোহিঙ্গার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে আদায় করছিল। আর যারা টাকা দেয়নি তাদের মালামাল ছিনিয়ে নেয় তার লোকজন।

ডকুমেন্ট ছাড়াই রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রি: কোনো ধরনের কাগজপত্র, দলিলাদি ছাড়াই রোহিঙ্গাদের কাছে মোবাইল সিম বিক্রি করছে টেকনাফ ও উখিয়ার খুচরা সিম বিক্রেতারা। অভিযোগ উঠেছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্থানীয়রাই রোহিঙ্গাদের কাছে উচ্চ মূল্যে সিম বিক্রি করছেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশপাশের এলাকায় কোনো ধরনের কাগজপত্র ছাড়াই সিম বিক্রি করতে দেখা গেছে।

ভুরুঙ্গামারীতে একই পরিবারের চার রোহিঙ্গা আটক

ভুরুঙ্গামারী (কুড়িগ্রাম) সংবাদদাতা জানান, ভুরুঙ্গামারীর দিয়াডাঙ্গা সীমান্তে একই পরিবারের চার রোহিঙ্গা সদস্যকে আটক করেছে এলাকাবাসী। এরা হলেন— আবুল কালাম (৩০), তার স্ত্রী সফিকা বেগম (২০), মেয়ে রোজিনা (৪) ও  রোকেয়া (২) । প্রায় ৩ মাস আগে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেঘুরে উপজেলা সদরের বাসস্ট্যান্ডের জনৈক  মজির উদ্দিন হাজীর বাড়িতে আশ্রয় নেয়।