নদী, পাহাড়, খালবিল আর সমতলের বহুমাত্রিক জগতে

0
201

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে চলতো ছোট ছোট লঞ্চ, সাম্পান। নদী পথেই চলাচল বেশি ছিল ওই অঞ্চলের মানুষের। কালুরঘাট ব্রিজের নিচ থেকে ছেড়ে গোমদ-ী, শাকপুরা, চরনদ্বীপ, খরনদ্বীপ, আমুচিয়া হয়ে লঞ্চ গিয়ে ভিড়তো বোয়ালখালীর জ্যৈষ্ঠপুরা গ্রামের ভা-ারজুড়ি ঘাটে। এটি শেষ ঘাট। এখান থেকে পুবে দৃষ্টি দিলেই চোখ আটকে যায় পাহাড়ে। গাছপালাগুলো পাহাড়ের গায়ে এমনভাবে লেগে আছে, দেখে মনে হবে সবুজ ভেলভেটের চিত্রকর্ম। পাহাড়ের ওপাশে বার্মা।
এখন আর লঞ্চ সার্ভিস নেই কর্ণফুলীতে। সভ্যতার ছোঁয়া লেগেছে ওই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায়। চালু হয়েছে গোমদ-ী-বোয়ালখালী বাস সার্ভিস। তবে জ্যৈষ্ঠপুরা পর্যন্ত বাস যায় না। কানুগেরপাড়া থেকে সিএনজিতে করে যেতে হয় নদী, পাহাড়, খালবিল আর সমতল ভূমির বহুমাত্রিক ধারার স্বর্গরাজ্যে। আধুনিকতার কিছুটা ছোঁয়া লাগলেও জ্যৈষ্ঠপুরা এখনো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে অনিন্দ্য।
বোয়ালখালী উপজেলার উত্তরে সমুদ্রকন্যা কর্ণফুলী নদী। পুবে রাঙ্গুনিয়া ও বান্দরবান। দক্ষিণে পটিয়া উপজেলা। এক কথায় দুপাশ নদী বেষ্টিত বোয়ালখালী প্রাকৃতিক লীলার বিস্তীর্ণ জনপদ। কর্ণফুলী নদী নিয়ে কবি নজরুল ইসলাম বলে গেছেন, ‘ওগো ও কর্ণফুলী/ তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি/ তোমার ¯্রােতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী, কে জানে সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে।’
পাহাড় গড়িয়ে নামছে জল। তাতে ভাসছে ছোট মাছ, জলজ প্রাণী। আরশির চেয়েও স্বচ্ছ জলে একবার চোখ পড়লে আর কি ফেরাতে মন চায়? স্বচ্ছ জলের নিচে পাহাড় ঢলে নেমে আসা বালুতে হাঁটতে গেলে যে কোমলতা পা ছুঁয়ে দেবে তার তুলনা করা সহজ হবে না। মনে হবে অনাধিকাল হেঁটে বেড়ালেও আশা মিটবে না। জ্যৈষ্ঠপুরার পুবের চিত্র এটি। বোয়ালখালীর ৩৬.৭৮ বর্গকিলোমিটারের বিশাল এলাকায় আছে করলডেঙ্গা ও জ্যৈষ্ঠপুরা পাহাড়ি বনাঞ্চল। এ অঞ্চলের মানুষের জীবিকার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাহাড়, গাছপালা, বন। এখনো এখানকার মানুষ ভোরে ছুটে যায় বনে। সারাদিন গাছের ডালপালা কেটে লাকড়ির বোঝা কাঁধে চাপিয়ে বাড়ি ফেরেন সন্ধ্যায়। দিনান্তে কাঠুরিয়ার দিন কাটে এভাবেই। আবার একদল মানুষের জীবিকা চলে পাহাড়ের ঢালে লেবু, পেয়ারা, তরমুজ, ঝিঙ্গা, করলা, শসার চাষ করে। এসব সবজি চট্টগ্রাম জেলার অনেক এলাকার মানুষের চাহিদা মেটাচ্ছে। লালসালুতে লেবুর বোঝা বাঁশের দুপাশে বেঁধে ছুটে চলা মানুষজনকে দেখে মনে হবে এখনো সভ্যতার বাতি এখানে আলো ছড়ায়নি। বেশ কয়েকটি পাহাড়ে ও পাহাড়ি ঢালুতে বেসরকারিভাবে গড়ে তোলা হয়েছে বড় বড় রাবার বাগান। যেখান থেকে প্রতিদিন শত শত লিটার উন্নতমানের কাঁচা রাবার উৎপাদন হচ্ছে। পাশাপাশি কিছু বনায়নও শুরু হয়েছে।
পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছে বসতি। কোথাও কোথাও ছোট টিলা কেটে গড়া হয়েছে সারি সারি ডেরা। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ছিন্নমূল মানুষের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে। এখানকার মানুষের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এখনো বন্যহাতির পালের আক্রমণের শঙ্কায় রাত ভোর হয় তাদের। পাহাড়ে এখনো বন্যহাতির দেখা মেলে। নিশুতি রাতে শেয়ালের ডাক এখনো এই জনপদবাসীর কানে আসে। তবে শান্ত মানুষের এই জনপদে দুর্বৃত্তদের আনাগোনাও কম নয়। রাতের আঁধারে বন থেকে গাছ কেটে নেওয়া, পাহাড় কেটে মাটি নিয়ে যাওয়ার ঘটনা প্রায়ই ঘটে এখানে। প্রশাসনের একশ্রেণির অসাধু চক্রের সহযোগিতায় এসব অপকর্ম করেই পার পেয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। এই অভিযোগ স্থানীয়দের।
ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্তও জ্যৈষ্ঠপুরা। ভা-ারজুড়ি ঘাট লাগোয়া বৌদ্ধমন্দিরে চলছে উপাসনা। একটু এগোলেই পাকা দালানের মসজিদ। হিন্দুদের মন্দিরই বলে দেয় এখানকার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে কতটা সহিষ্ণু। যে যার উপাসনালয়ে ধরনা দিচ্ছেন সৃষ্টিকর্তার কাছে। ধর্মীয় বাড়াবাড়ির ধার ধারেন না এই জনপদবাসী। জ্যৈষ্ঠপুরার শ্রীপুর-খরনদ্বীপ ইউনিয়নে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্রাচীন একটি মন্দির আছে। এটি বৌদ্ধদের তীর্থস্থান হিসেবেও পরিচিত। পাহাড়ি বনাঞ্চলের পাদদেশেই আছে বিখ্যাত দরবেশ হযরত বো-আলী কালন্দর শাহের মাজার। একটু দূরে পাহাড় চূড়ায় চ-ীর উদ্ভবস্থান বলেখ্যাত মেধস মুনীর আশ্রম। এই আশ্রম থেকেই সর্বপ্রথম তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশসহ সারা বিশ্বে দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছে বলে কথিত আছে।
জ্যৈষ্ঠপুরা বাজারের দিকটা দেখে মনে হবে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে নদী বেষ্টিত এই অঞ্চলে। এখনো এখানে প্রতি বিকালে হাট বসে। হরেকরকম শাক-সবজি, নদীর মাছের পসরা সাজিয়ে বসা ব্যস্ত বিক্রেতার সময় হয় না কথা বলার।
জ্যৈষ্ঠপুরা থেকে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা মাত্র তিন কিলোমিটারের পথ। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে তা হবে সাত কিলোমিটার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এ সড়কটি নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিল ছয় বছর আগে। সড়কের নকশাও পাস হয়েছে। কিন্তু এখনো শেষ হয়নি নির্মাণ কাজ। স্থানীয়রা জানান, সড়কটি হয়ে গেছে পাহাড়ে উৎপাদিত শাক-সবজি দ্রুত পৌঁছানো যাওয়া শহরে। এতে দাম পাবেন চাষিরা।
সুযোগ পেলে ঘুরে আসতে পারেন আপনিও। চাইলে নদী পথেই পৌঁছতে পারেন জ্যৈষ্ঠপুরায়। লঞ্চ সার্ভিস বন্ধ হয়ে গেলেও ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকা তো আছে। চাইলে এগুলোতে চড়ে উপভোগ করতে পারেন রমণীয় কর্ণফুলীর অকৃত্রিম সৌন্দর্য।