নারীদের অর্জনগুলো আরো দৃঢ় হোক

0
161

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন, নিউজচিটাগাং২৪.কম::
নারীআমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদের বিরোধী দলীয় নেত্রী, জাতীয় সংসদের স্পিকার, সরকারের বাইরে থাকা প্রধান রাজনৈতিক দলের নেত্রী, এ চারজনই নারী। নারী সমাজের উন্নয়নে এর চেয়ে বড় ইতিবাচক আর কী হতে পারে? এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বিচারপতি, পাইলট, ডাক্তার, ট্রেনচালক হিসেবে নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছেন নারীরা। আমাদের সমাজের দৃষ্টি ভঙ্গি বদলালে আমরা আরো অর্জন চোখে দেখবো।

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ। জাতিসংঘ ঘোষিত ২০১৫ সালে এই দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘নারীর ক্ষমতায়নেই মানবজাতির ক্ষমতায়ন’। এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে নিয়ে নানা আয়োজনে উদযাপিত হবে দিনটি।

১০৪ বছর আগে ১৯১৯ সালের এই দিনটিকে নারী দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেন প্রগতিশীল জার্মান নারীনেত্রী ক্লারা জেটকিন। তারপর থেকে দিনটি ঘটা করে পালন করা হতো সমাজতন্ত্রী শিবিরে। সোভিয়েত বিপ্লবের পর নারী দিবস সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের নারী মুক্তি আন্দোলনের প্রত্যয়দীপ্ত দিন হয়ে দাঁড়ায়।

১৮৫৭ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে একটি সেলাই কারখানায় নারী শ্রমিকরা ভোটাধিকার, শ্রমঘন্টা দৈনিক ৮ ঘণ্টা, ন্যায্য মজুরিসহ বেশ কয়েকেটি সুনির্দিষ্ট দাবিতে আন্দোলন করে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।

প্রথম নারী শ্রমিক ইউনিয়নও গঠিত হয় ১৮৬০ সালের এই দিনে। পরে ১৯০৮ সালে পোশাক ও বস্ত্রশিল্প কারখানার প্রায় দেড় হাজার নারী শ্রমিক একই দাবিতে আন্দোলন করেন। অবশেষে আদায় করে নেন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজ করার অধিকার। ১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক সম্মেলনে জার্মানির নেত্রী ক্লারা জেটকিন ৮ই মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালনের প্রস্তাব করেছিলেন। পরে ১৯৭৭ সাল থেকে ৮ই মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ । এরপর থেকেই সারা বিশ্বের সঙ্গে বাংলাদেশেও দিবসটি পালন করে আসছে। বাংলাদেশে ১৯৯১ সাল প্রথমবার এ দিবস পালন করা হয়। একইসঙ্গে এ দিন অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয় নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, সমঅধিকার এবং তাদের মর্যাদার বিষয়ে।

বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের নারীরা আজ শুধু গার্মেন্ট শিল্পেই নন, রাজনৈতিক নেতৃত্ব, তথ্যপ্রযুক্তি, ব্যবসা, উদ্যোক্তা, সাংবাদিকতা, এভারেস্ট জয়, খেলা, সৃষ্টিশীল এমনকি যুদ্ধ বিমান চালনাতেও একে একে নিজেদের দক্ষতা, যোগ্যতা আর গ্রহণযোগতার প্রমাণ রেখে চলেছেন। সদ্য বাংলাদেশ সফরে আসা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, মানবসূচক উন্নয়নে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের নারীরা অনেক এগিয়ে গেছে। এটি জাতীয় অর্থনীতিতে এক ধরনের ইতিবাচক প্রভাব আনবে। তাছাড়া দেশের শীর্ষ কর্মপদে বাংলাদেশ নারীদের ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। এটিরও একটি শুভ প্রভাব অনিবার্য। আমর্ত্য সেনের কথার রেশ ধরে বাংলাদেশের নারীদের এমন অগ্রযাত্রার উদাহরণ বিশ্ব সমাজকে চমকে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। এদিকে আন্তর্জাতিক নারী দিবসের পেছনের ইতিহাস অনেক সমৃদ্ধ।

রেওয়াজ অনুযায়ী এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে দিয়েছে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ইউএন উইমেন। এ বছর ২০১৫ সালে এসে দেখতে হবে নারীর অর্জন কী হয়েছে, কতটুকু হয়নি। কারণ ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত চীনের বেইজিং শহরে যে বিশাল আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল, এবার তার ২০ বছর পূর্ণ হয়েছে। সে সম্মেলনে ঐতিহাসিক বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা (Beijing Declaration and Platform for Action) গ্রহণ করা হয়েছিল, যাতে ১৮৯টি দেশ স্বাক্ষর করে এ অঙ্গীকার করেছিল, তারা নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করবে, সেটাই হবে তাদের এজেন্ডা। এখন ২০১৫ সালে এসে দেখার বিষয় কী পেয়েছি আর কী পাইনি, সমস্যাগুলো কোথায়? তাই প্রতিপাদ্য দেয়া হয়েছে এভাবে- ‘নারীর ক্ষমতায়ন করাই হচ্ছে মানবতার ক্ষমতায়ন। দৃশ্যমান কর! ‘Empowering Women, Empowering Humanity : Picture it! http://www.unwomen.org/en/news/ stories/2015/02/as-the-beijing-declaration-turns-20

এখন সময় হয়েছে নারীর অর্জনকে আরও বাড়ানো, আবার কোথায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সেটা চিহ্নিত করা এবং নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা ও সমতা অর্জনে সবার অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। সাধারণত নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সহজ; তাদের চাহিদা খুব কম, তারা চায় শিক্ষা, কাজের সুযোগ, আয় করা, নিজের জীবন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া এবং নির্যাতন ও বৈষম্যমুক্ত পরিবেশে থাকা। মানুষের সাধারণ জীবনযাপনের জন্য এ চাহিদা খুব বেশি কিছু নয়; এরপরও একজন মানুষ হিসেবে তার রাজনৈতিক অধিকার, রাজনীতিতে অংশগ্রহণ দুটোই চাইতে পারে। সব মানুষই চায় তার রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে। নারী তার ব্যতিক্রম হবে কেন? প্রশ্ন হচ্ছে নারী কি সেসব অধিকার পেয়েছে?

হতাশার কথা দিয়ে শুরু করতে চাই না, তাই আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দেশের সব নারী-পুরুষকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ক্লারা জেৎকিন ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজকের নারী দিবস পালন সে দিক থেকে অনেক সরে এলেও জাতিসংঘের কাছে এ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে; এটা আমাদের জন্য কম প্রাপ্তি নয়। তবে আমরা এখন শুধু জাতিসংঘের এজেন্ডা নিয়ে দিবসটি পালন করতে চাই না। আমাদের জন্য দিবসটির উৎপত্তি নারী আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, অর্থাৎ ১৯১০ সালে বিশ্ব নারী দিবসের ঘোষণার সঙ্গে, যাতে জড়িত ছিল শ্রমিক নারীদের সংগ্রাম, সেটা আমাদের মনে রাখা জরুরি। আজ শ্রমিক নারীদের আন্দোলন এ দিবসের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হয় না। ‘সকল’ নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এখন আমরা নারী আন্দোলনের ওপর নয়, সরকারের অঙ্গীকার ও কাজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। তারা কতটুকু করছে বা করতে চায় সেটা নিয়েই আমরা খতিয়ান নিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। নারী আন্দোলন রাস্তা থেকে ঢুকে পড়েছে সচিবালয়ে। আর সচিবালয়ে গিয়ে পুরুষতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের বেড়াজালে পড়ে যায়। জাতিসংঘের আমলাতন্ত্রও খুব জটিল। এখানে নারী সংগঠনের ভূমিকা আগের তুলনায় কমে গেছে। ইংরেজি বলতে ও লিখতে না পারলে সেই নারী সংগঠনগুলো ইউএন উইমেনের ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারে না। তাই তাদের কথাও সেখানে পৌঁছায় না। প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে সাধারণ নারীদের সুযোগ নেই। তাই ক্লারা জেৎকিনের নারী দিবস আর বর্তমানের নারী দিবসের পার্থক্য অনেক। আমরা এখনও ক্লারা জেৎকিনকেই আগে স্মরণ করছি।

তবুও জাতিসংঘের দৃষ্টিতেই বিশ্বের নারীদের অবস্থান দেখা যাক। মার্চের ৯ থেকে ২০ তারিখ পর্যন্ত ৫৯তম কমিশন অন দ্য স্ট্যাটাস অব উইমেন বেইজিং কর্মপরিকল্পনার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সব দিক থেকে কতটুকু অর্জিত হলো তার একটি খতিয়ান নেবে। http://www. unwomen.org/en/news/stories/2015/02/as-the-beijing-declaration-turns-20#sthash.XcqBF6dO.dpuf তাদের ফল খুব আশাব্যঞ্জক নয়। রাজনৈতিকভাবে সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের প্রতি পাঁচ জনের মধ্যে মাত্র একজন নারী পাওয়া যায়। কর্মসংস্থানের দিক থেকে ৫০ শতাংশ নারী এমন কাজে আছেন, যেখানে বেতন বা মজুরি পাওয়া যায়। ২০ বছর আগে এ পরিসংখ্যান ছিল ৪০ শতাংশ, তার মানে মাত্র ১০ শতাংশ বেড়েছে। মজুরিবৈষম্য এখনও ঘুচেনি। হিসাব করে দেখা গেছে, এ গতিতে কর্মসংস্থান (বেতন-মজুরিসহ) বাড়তে থাকলে আরও ৮১ বছর লাগবে পুরুষের সমান অবস্থানে আসতে। আগামী শতাব্দীতে। বিনা মজুরিতে নারীদের কাজের অংশগ্রহণ অনেক বেশি। নারীর প্রতি সহিংসতা ঘটেই চলেছে। প্রতি তিনজনের একজন নারী সহিংসতার শিকার হয়, যা বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে দেখা হয়। বিশ্বে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অশান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু জাতিসংঘের শান্তি চুক্তির আলোচনায় নারীর অংশগ্রহণ আছে মাত্র ৯ শতাংশ।

জাতিসংঘের সভায় অংশগ্রহণের জন্য স্বাক্ষরকারী ১৬৬ দেশ নিজ নিজ অবস্থার পর্যালোচনা করে প্রতিবেদন দিয়েছে। বাংলাদেশেও হয়েছে, তবে সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কতটুকু আলোচনা হয়েছে তা আমরা জানি না, কারণ সে ধরনের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি। ধনী দেশগুলো তাদের সিভিল সোসাইটির সঙ্গে মতবিনিময় করেই প্রতিবেদন দিয়েছে। আঞ্চলিক পর্যায়েও অনেক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বেইজিংয়ের পর আর একটি বড় সম্মেলন হতে যাচ্ছে এবারে নিউইয়র্কে। এখানে ১ হাজার ১০০ এনজিও প্রতিনিধিসহ সরকারি ও বেসরকারিভাবে ৮ হাজার ৬০০ প্রতিনিধি এরই মধ্যে নিবন্ধন করেছে। সরকারিভাবে ২০০টি সাইড ইভেন্ট ও সিভিল সোসাইটির ৪৫০টি সমান্তরাল কর্মসূচি থাকবে। দেখা যাক কী হয়!

জাতিসংঘ মহাসচিবের বাণী এরই মধ্যে এসে গেছে। তিনি জাতিসংঘের দৃষ্টিকোণ থেকেই তার বক্তব্য দিয়েছেন। তার বাণীতে নারী ও মেয়েদের সন্ত্রাসী এবং জঙ্গিদের হাত থেকে মুক্ত করার কথা রয়েছে। কিন্তু কোথাও বলেননি কী করে উন্নয়নের মডেল, নারী শ্রমিকদের প্রতি বৈষম্য, গ্রামীণ নারীদের এবং কৃষক নারীদের উৎখাতের জন্য কীভাবে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো উঠেপড়ে লেগেছে এবং তাতে কত ক্ষতি হচ্ছে! এসব কিছু বাদ দিয়ে পশ্চিমা দেশের মতবাদকে কেন্দ্র করে যে বাণী তিনি দিয়েছেন তা বাংলাদেশের নারীদের হতাশ করেছে।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। এ প্রতিবেদন নিয়ে খুব আলোচনা হয়নি। তথ্যসূত্রগুলোও বেশিরভাগ বড় বড় এনজিও থেকে নেয়া বা বলা যায়, দাতা সংস্থার চাহিদামাফিক দেয়া তথ্য। সেখান থেকেও বাংলাদেশে নারীর সমতা অর্জনের যে চিত্র উঠে আসে তা খুব সুন্দর নয়। কর্মসংস্থানে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে মনে হয়, কিন্তু স্বীকৃত শ্রমজীবী হিসেবে নারীর অংশগ্রহণ আছে মাত্র ৩৬ শতাংশ, পুরুষের অংশগ্রহণ যেখানে ৮২.৫ শতাংশ। নারী রয়েছে অর্ধেকেরও কম। শ্রমিক হিসেবে (২০১০ শ্রম জরিপ) পুরুষরা সেবা খাতেই সবচেয়ে বেশি ৪১.১১ শতাংশ, নারীরা সেখানে মাত্র ২১.৮৯ শতাংশ। পুরুষরা কৃষিতে ৪০.১৮ আর নারী ৬৮.৮৪ শতাংশ। শিল্প খাতে পুরুষ ১৯.৬ আর নারী ১৩.৩২ শতাংশ। কৃষিতে নারীর এ বাড়তি অংশগ্রহণ কৃষক নারীর কাজের স্বীকৃতি নয়, বরং নতুন কৃষি প্রযুক্তি এনে নারী কৃষি শ্রমিক বাড়ানো হয়েছে। তারা কৃষি উৎপাদনে, বীজ সংরক্ষণের মতো স্বাধীন কাজে নয়, বাণিজ্যিক উচ্চফলনশীল ফসল উৎপাদনে মাঠে কাজ করা এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। এরা কৃষি পরিবার থেকে নয়, ভূমিহীন পরিবারের গরিব নারীরা এ কাজে সস্তা শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছেন। পুরুষরা কৃষিতে কমে যাচ্ছেন কারণ তারা প্রবাসী শ্রমিক হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছেন। তারা যখন ফিরেও আসেন তখন কৃষি কাজে যুক্ত হন না, ব্যবসা বা অকৃষি কাজেই যুক্ত হয়ে পড়েন।

উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, কোনো ধরনের মজুরি ছাড়া পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে কাজ আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। এ শতাব্দীর শুরুতে মাত্র ৪৭ লাখ নারী-পুরুষ বিনা মজুরিতে পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত ছিল, ২০১০ সালে এসে (মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে) তা হয়েছে ১ কোটি ১৮ লাখ। এ বৃদ্ধি ঘটেছে প্রধানত নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে (২৩৭%), পুরুষদের বৃদ্ধি ঘটেছে ৩৫ শতাংশ। নারীরা কোন ধরনের কাজে বিনা পারিশ্রমিকে নিয়োজিত আছেন তা বিস্তারিত বলা হয়নি, কিন্তু আমরা কিঞ্চিত যা দেখতে পাই তা ভয়াবহ। দেশে তামাক চাষ ও তামাক প্রক্রিয়াজাতের কাজে (বিশেষ করে বিড়ি কারখানায়) নারীদের পারিবারিক শ্রমিক হিসেবে পুরুষের মজুরির অংশে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। তেমনি ফুলচাষ ও অন্যান্য তথাকথিত অর্থকরী ফসলে নারীর অংশগ্রহণ কোনো মজুরিভিত্তিক হয় না, পরিবারের অংশ হিসেবে হয়। অথচ তাকে অনেক বেশি শ্রম দিতে হয়।

নারী কি দারিদ্র্যের অবস্থা থেকে উন্নতি করতে পেরেছে? সরকারিভাবে দাবি করা হয়, দারিদ্র্য এবং ক্ষুধা নিরসনের জন্য সরকার অনেক এগিয়েছে। প্রবৃদ্ধির হার ৬ শতাংশ হয়েছে, যদিও আমরা খুব ভালো করে জানি, প্রবৃদ্ধি বেশি হলেই গরিব মানুষের উন্নতি, বিশেষ করে গরিব নারীদের উন্নতি হয়েছে দাবি করা যাবে না। আগে নারীপ্রধান পরিবার (Female Headed Households) দরিদ্র নারীর সংখ্যা নিরূপণের ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল, এখন সেই পরিসংখ্যান কমে গেছে। এর কারণ এ নয়, দরিদ্র নারীপ্রধান পরিবারের অবস্থা ভালো হয়েছে; বরং অনেক নারী এখন আর নিজেদের সেভাবে পরিচয় দিতে চান না বলে পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। এখন যে পরিসংখ্যান তাতে দেখা যায়, ২০০৫ সালে নারীপ্রধান পরিবার গরিব ছিল ২১.৯ শতাংশ, ২০১০ সালে হয়েছে ১৪.৬ শতাংশ। দারিদ্র্য মাপার জন্য যে মাপকাঠি, জমির মালিকানা ইত্যাদি দরকার সে তথ্য নারী-পুরুষকে ভাগ করে দেয়া হয়নি এখনও। ফলে সম্পদের মালিকানার দিক থেকেও নারীকে আলাদাভাবে দেখার সুযোগ কম।

রাজনৈতিকভাবে নারী এগিয়েছে সংখ্যাগতভাবে। এমপিদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের (আইপিইউ) বরাতে ২০ বছরের অবস্থা থেকে জানা গেছে, বিশ্বে ১৭৪টি দেশের জাতীয় সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব ১১.৩ থেকে ২২.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দৃশ্যত বেড়েছে। এ বৃদ্ধি ঘটেছে আফ্রিকার চারটি দেশে, ইউরোপ ও আমেরিকার তিনটি দেশে। রুয়ান্ডায় নারী প্রতিনিধিত্ব ৬০ শতাংশের বেশি। কিন্তু এশিয়ার পার্লামেন্টগুলোতে এ বৃদ্ধি ঘটেছে ১৮.৫ শতাংশ। তবে পূর্ব তিমুরে নারী সংসদ সদস্যের সংখ্যা ৩৮.৫ শতাংশ। সেদিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার নেপাল ২৯.৫ শতাংশ এবং আফগানিস্তান ২৭.৭ শতাংশ। ছোট দেশ হিসেবে মঙ্গোলিয়া ও ভুটানো এগিয়ে রয়েছে। (প্রথম আলো, ৬ মার্চ ২০১৫)। বাংলাদেশের সংসদে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নির্বাচিত সদস্য মিলে নারী প্রতিনিধি রয়েছে ১৯.৭ শতাংশ। দশম সংসদে উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে প্রার্থীবিহীন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনে নারীদের অংশগ্রহণ নবম সংসদের তুলনায় কমে গেছে। ৫৪০ প্রতিদ্বন্দ্বীর মধ্যে মাত্র ২৭ জন নারী ছিলেন। অগণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যায় না, এটাই বোঝা যায়।

বাংলাদেশের প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, নবম সংসদে ৬৬ নারী ৩০০ সাধারণ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১৯ জন জয়ী হয়েছিলেন। এ তথ্য দেখে খুব উল্লসিত হতে পারছি না, কারণ নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার কারণে রাজনীতিতে সাধারণ নারীর কণ্ঠ সোচ্চার হচ্ছে এমন ঘটনা আমরা দেখিনি। দশম সংসদে প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার, সংসদ উপনেতা, মন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নারী থাকা সত্ত্বেও নারীর অধস্তন অবস্থা থেকে মুক্তি মিলছে না। সংসদের বাইরে বৃহৎ দলের প্রধানও নারী। অথচ বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে এখানে দুই বিবদমান (Battling Begums) নারীনেত্রী বা বেগম রয়েছেন। এটা নিশ্চয়ই নারীর অগ্রগতির পরিচয় নয়, বরং আগামীতে নারীদের রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে আসতে না দেয়ার ক্ষেত্র তৈরি করা। ৫০ জন নারী জাতীয় সংসদে পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হয়ে এমপি উপাধি ধারণ করে আছেন। সংসদে তাদের প্রতি ‘সেকেন্ড ক্লাস’ এমপি হিসেবে আচরণ করা হয়, তারা কথা বললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নেতানেত্রীদের প্রশংসায় সময় ব্যয় করতে হয়। অথচ ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বললে বোঝা যায়, তারা জনগণের প্রতিনিধি হয়ে কাজ করার জন্য কত উদগ্রীব। তবে তারা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে কিছু দায়িত্ব পালনের চেষ্টা অবশ্যই করেন।

নবম জাতীয় সংসদের ৪৩ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদে ছয় জন নারী মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন কৃষিমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী। দুঃখজনক হচ্ছে, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে পরে আর রাখা যায়নি। অন্যদিকে কৃষিমন্ত্রী নারী কৃষকদের জিএমও প্রযুক্তির প্রতি বেশি ঝুঁকে গিয়ে নারী কৃষকদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

স্থানীয় সরকার পর্যায়েও নারীরা এগিয়ে এসেছেন। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে সিটি করপোরেশন পর্যন্ত অনেক নারী সংরক্ষিত আসনে সরাসরি নির্বাচন করে এসেছেন। উপজেলা পরিষদে ৪৮০ নারী ভাইস চেয়ারম্যান আছেন, (১৯৩৬ জন প্রতিযোগিতা করেছিলেন)। নির্বাচন কমিশনের তথ্য (২০০৮) অনুযায়ী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে ৩৯টি সংরক্ষিত আসনের জন্য ১৯৪ জন প্রতিযোগিতা করেছিলেন। পৌরসভার ২৭টি সংরক্ষিত আসনে প্রতিযোগী ছিলেন ১২০ জন নারী। এতে বোঝা যায়, নারীদের মধ্যে প্রার্থী হয়ে প্রতিযোগিতা করার আগ্রহ আছে। তাহলে জাতীয় পর্যায়েও থাকার কথা; কিন্তু সেখানে সে সুযোগ রাখা হয়নি।

বেইজিং ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া, আর এবার ২০ বছরের হিসাব মেলাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কী পেলাম আর কী পেলাম না, এ দুজনের সম্পর্কের ওঠানামা দিয়েও বোঝা যায়। ইতিহাস নারীদের পক্ষে থাকতে পারে সে চেষ্টাই যেন থাকে।

সর্বোপরি নিজেদের সভ্য সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করতে চাইলে নারীর অধিকার এবং মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় যত্নবান হতে হবে।

দিনটি উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব, রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।
দিবসটি উপলক্ষে সংবাদপত্র বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। সরকারি টেলিভিশন ও বেতার এবং বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানের প্রয়োজন করেছে। অনলাইন পত্রিকাগুলো নারী সংক্রান্ত বিশেষ সংবাদ প্রকাশ করেছে।