পর্দার নায়ক হয়ে উঠেন জনতার নায়ক

0
110

রূপালী পর্দার সুদর্শন নায়ক। আশি ও নব্বই দশকে সিনেমাপ্রেমীদের মুখে মুখে ছিল তার নাম। জনপ্রিয়তা যখন তুঙ্গে তখনই মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় হারান প্রিয়তমা স্ত্রীকে। দুঃখ-যন্ত্রণায় মুষড়ে পড়লেও সেখানে থেমে যাননি তিনি। যে সড়কে হারিয়েছেন স্ত্রীকে সে সড়ক নিরাপদ করার লড়াইয়ে নামলেন একা। ধীরে ধীরে তার সঙ্গী হলেন অনেকে। দেশব্যাপী সাড়া জাগানো পর্দার নায়ক হয়ে উঠেন জনতার নায়ক। তিনি ইলিয়াস কাঞ্চন।সময় ১৯৯৩।

ইলিয়াস কাঞ্চনের জীবন ওলট-পালট করে দেয়া ঘটনাটি ঘটে তখন। তার স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চন নিহত হন সড়কে।

এর আগে ১৯৮৯ সালে দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় তার জীবন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর সিনেমার এ নায়ক অন্যভাবে বাস্তবের প্রতিবাদী নায়ক হয়ে দাড়িয়ে যান রাস্তায়। গড়ে তোলেন নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচা। প্রায় ২৫ বছর ধরে তিনি সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ সড়কের জন্য। সিনেমার ক্যারিয়ারও বিসর্জন দেন অনেকটা। নানা প্রতিকূলতা, চাপ, হুমকি কোনো কিছুই পরোয়া করেননি তিনি। সব চাপ উপেক্ষা করে চালিয়ে গেছেন তার লড়াই। চেয়েছেন নিরাপদ সড়ক। নিরাপদ সড়কের আন্দোলনকে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র।

চষে বেড়িয়েছেন গোটা দেশ। নিরাপদ সড়কের দাবিতে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়েছেন রাজপথে। করেছেন মিছিল, জনসভা। বলতে গেলে দেশে নিরাপদ সড়কের দাবিতে প্রথম সোচ্চার হন তিনিই। এখনও রাজপথে হ্যান্ড মাইক হাতে নিয়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর কাজ করেন মাঝে মধ্যেই। জনতার হৃদয়ে তার স্থান অম্লান।

জনতার নায়ক হয়ে উঠলেও পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বরাবরই তার নিন্দা করে আসছেন। বিভিন্ন সময় ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি তারা করেছেন অবমাননাকর আচরণ। তার ছবি দিয়ে ব্যাঙ্গাত্মক পোস্টার ছড়িয়ে দিয়েছেন সর্বত্র। গত বছর দুই স্কুল শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার পর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেয়া হয়। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সেই আইন সংসদে পাশও হয়েছে। এখন পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের চাপে সেই আইন আবার অনেকটা অকার্যকর হয়ে উঠেছে। এ আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময় শ্রমিকরা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করেন। সেসময় ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবিকে অবমাননার দৃশ্য দেখা যায়। সে ছবি আবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ইলিয়াস কাঞ্চনকে অবমাননার নিন্দা জানিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নানা মন্তব্য করে ইলিয়াস কাঞ্চনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন তারা। তবে বাস ও ট্রাক মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের সদস্য সচিব তাজুল ইসলাম বলেন, সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে নানা মন্তব্য এবং দাবি তোলার কারণে শ্রমিকদের কেউ কেউ তাকে নিয়ে ক্ষুব্ধ হতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীরা বলছেন, ্তুএদেশে কেউ যখন ভালো কাজ করতে চায় তখন তার কপালে জুটে অপমান, লাঞ্চনা, হামলা আর মামলা। কামরুল হাসান মামুন নামে একজন লিখেছেন, ইলিয়াস কাঞ্চন, ভাই আপনি পালান! এই দেশ আর আপনাদের মতো মানুষদের জন্য নয়! এটা এখন রাঙ্গাদের জন্য। আর আসুন আমরা সবাই বালুর ভেতরে মুখ লুকিয়ে কিছু না দেখার ভান করে চুপ করে থাকি। ইলিয়াস কাঞ্চনের মতো দ্বিতীয় আরেকজন বাংলাদেশিকে খুঁজে পাবেন না যিনি সড়ক দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়ক নামক একটি অহিংস আন্দোলন এককভাবে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে পেরেছেন। এরকম একটি আন্দোলন বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে তাৎক্ষণিক লাভ ছাড়া কাউকে পাওয়া যায় না, খুব কঠিন। লীনা পারভীন লিখেছেন, আমাদের দেশে যখন ডেডিকেশন আর কমিটমেন্টের অভাব তখন এই একজন ব্যক্তি নিজের জন্য নয়, সকলের জন্য নিরাপদ জীবনের লড়াইয়ে রাস্তায় আছেন। হারিয়ে যাননি তিনি। আপনার আমার মত হঠাৎ বা স্বল্পমেয়াদী বিপ্লবী নয় তিনি। লেগে থেকে এনেছেন পরিবর্তন। সরকারকে বাধ্য করেছেন আইন নিয়ে ভাবতে। আপনার শত্রু থাকাটাই স্বাভাবিক। গুজব আর আজবের দেশে আপনার একাগ্রতা ও সততার প্রতি অবিচল চলাতে শ্রদ্ধা জানাই। সম্মান জানাই আপনার ত্যাগকে। আমরা আছি পাশে।

এসব বিষয় নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, আমি নিজের জন্য তো এই আন্দোলন করিনি। আমি দেশের মানুষের জন্য নিরাপদ সড়ক চেয়েছি। কখনো-কখনো খারাপ লাগে। এতোটাই খারাপ লাগে যে যাদের জন্য আমি এতো কিছু জলাঞ্জলি দিয়েছি। কোন কিছু পাওয়ার আশায় নয়। আমি আমার সিনেমার ক্যারিয়ার শেষ করেছি নিরাপদ সড়কের জন্য। আমার সঞ্চিত অর্থ ব্যয় করেছি নিরাপদ সড়কের জন্য। তিনি বলেন, কে কি বললো তা ভাবলে সামনে এগুতে পারবোনা। সাংবাদিক আহমেদ আল আমিন লিখেছেন, তথাকথিত নায়কেরা যা করছেন তা করলে তিনি হয়ত এমপি হতেন, বড় ব্যবসায়ীও হতেন। ওই পথে যাননি। নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সত্যিকারের সংগ্রাম তিনিই করছেন। ইলিয়াস কাঞ্চনের পাশে আছি। এদিকে নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার নিন্দা জানিয়েছে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

তাদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সড়ক পরিবহন আইন বাতিলের দাবিতে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট চলাকালে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সামাজিক আন্দোলনের চেয়ারপারসন ও অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চনের কুশপুত্তলিকা বানিয়ে ও গলায় জুতার মালা পরানোসহ তার বিরুদ্ধে নানা বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দেয়া হয়, যা অগ্রহণযোগ্য ও নিন্দনীয়। এ ছাড়া ইলিয়াস কাঞ্চনের ছবি ব্যবহার করে বিভিন্ন স্থানে নানা প্ল্যাকার্ড-ব্যানার প্রদর্শন করা হয়েছে, যেখানে বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর বক্তব্য ছিল। এমন একজন সচেতন নাগরিকের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়ে একটি পক্ষ পরিবহন শ্রমিকদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন হলে পরিবহন শ্রমিকরাও যে লাভবান হবেন সে বিষয়টি তারা উপলব্ধি করছেন না, বরং ইলিয়াস কাঞ্চনের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াচ্ছেন।