পর্যটন সম্ভাবনার সবগুলো উপকরণ সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম

0
444
নিউজচিটাগাং:: বন্দর নগরী চট্টগ্রামসহ বৃহত্তর চট্টগ্রামে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন, পার্বত্য তিন জেলার নৃতাত্ত্বিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চট্টগ্রামকে বিশ্ব মানচিত্রে পর্যটন সম্ভাবনার সবগুলো উপকরণে সমৃদ্ধ করেছে। পাহাড়, সাগর-নদী, বনানী, প্রাকৃতিক হ্রদ, পতেঙ্গা ও পারকি সমুদ্র সৈকতের সমন্বয়ে চট্টগ্রাম নগরীতেও আছে দেশি-বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের অফুরান সম্ভাবনা।
কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ, পরিবহন অব্যবস্থাপনা এবং পর্যটন শিল্পের প্রতি সরকারি-বেসরকারি অবহেলা চট্টগ্রামের বিশাল পর্যটন সম্ভাবনা বরাবরই অবহেলিত হয়ে পড়ে আছে। অথচ শুধুমাত্র পর্যটন খাত থেকে চট্টগ্রাম তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামের অব্যবহৃত সম্ভাবনা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
মায়াবতী পাহাড়, অবিরাম ছুটে চলা র্ঝণা, সাপের মতো আঁঁকাবাকা নদ-নদী, লেক, সমুদ্রের উন্মাদনা, ঐতিহাসিক স্থাপনা- কী নেই রূপবতী চট্টগ্রামে। পর্যটনের জন্য যেসব উপাদান আবশ্যক সবই আছে ; শুধু নেই সমন্বিত উদ্যোগ। তিন পার্বত্য জেলা, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে শতাধিক দর্শনীয় স্থান থাকলেও সরকারি ও বেসরকারি দৃষ্টি শুধু কক্সবাজারে। আবার সেখানেও রয়েছে নানা সীমাবদ্ধতা।
 
পর্যটন শিল্পকে গতিশীল করে ১০ লাখ পর্যটক আনার লক্ষ্যে চলতি বছরকে পর্যটন বর্ষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিলো। কিন্তু পর্যটন বর্ষ প্রায় শেষের দিকে হলেও তার খুব একটা প্রভাব চট্টগ্রাম অঞ্চলে পড়েনি। তবে সাবাবিশ্বের সাথে আজ বাংলাদেশেও পর্যটন দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য, ‘সকলের জন্য পর্যটন :সর্বজনীন পর্যটন অভিগম্যতা’। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
 
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পর্যটন কর্পোরেশনের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা পর্যটন বর্ষ পালন করছি। কিন্তু হাস্যকর বিষয় হচ্ছে- পর্যটন শিল্প সরকারের অগ্রাধিকার খাতে নেই। তাহলে কিভাবে এই শিল্পের উন্নয়ন হবে। কীভাবে বিদেশি পর্যটক আসবে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুন্নত অবকাঠামো, পর্যটন স্পটগুলোকে বিশ্বমানে রূপান্তর না করা, স্পট সংলগ্ন এলাকায় অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বাড়তি আকর্ষণ তৈরি না করা, সাংস্কৃতিক আয়োজন না থাকা, পরিচালনে রাজনৈতিক প্রভাব, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব ও সর্বোপরি সরকারের সুনজর না থাকায় এই অঞ্চলের পর্যটনের কাঙ্খিত বিকাশ ঘটছে না। তবে এসব ক্ষেত্রে নজর দিতে পারলে দেশের পর্যটন খাতের আয়কে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে পারে চট্টগ্রাম অঞ্চলের স্পটগুলো।
 
বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের ঊর্দ্ধতন কর্মকর্তা এস এম মিজানুর রহমান বলেন, যেসব বিদেশি পর্যটক আসেন তারা পর্যটন স্পটগুলোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাড়তি আকর্ষণও খোঁজেন। এক্ষেত্রে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। তবে চট্টগ্রাম ও তিন পার্বত্য জেলায় যেসব দর্শনীয় স্থান আছে সেগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশকে পর্যটকদের একক গন্তব্যে পরিণত করা সম্ভব বলে মত দেন তিনি।
চট্টগ্রামের পর্যটন স্পট ও বর্তমান চিত্র : কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পর্যটনের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে পিছিয়ে আছে। সৈকতকে পরিচ্ছন্ন রাখাসহ ছোটখাট কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও তার সুফল মিলছে না। ফলে এই স্পটে বিদেশি পর্যটকের আগমন হাতে গোনা। একই অবস্থা সেন্টমার্টিনেও। গত বছর ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা হলেও কক্সবাজার সদর, রামু, চকরিয়ায় বৌদ্ধ ধর্মের ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে বিদেশি পর্যটক খুব একটা চোখে পড়েনা বলে জানান স্থানীয়রা।
কক্সবাজারের পরই এই অঞ্চলে সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্পট আছে বান্দরবানে। পাহাড়ি এই জেলার নীলাচল পর্যটন কেন্দ্র সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এক হাজার ৬০০ ফুট উঁচুতে। এছাড়াও নীলগিরি, ডিম পাহাড়, থানছি-আলীকদম সড়ক, বগা লেক, কেওকারাডংয়ের চুড়া, নাফাখকুম, সাঙ্গু নদী, ধর্মীয় স্থাপনা ও বেশকিছু ঝর্ণা আছে সেখানে। এখানকার পাহাড়ের ভাঁজে বর্ষা ও শরতে মেঘের মিতালি দারুণ আকর্ষণীয়। বিশ্বের খুব কম দেশেই এমন দর্শনীয় স্থান রয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের আঞ্চলিক সংকট ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায় সেখানে বিদেশিদের আনাগোনা কম বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে প্রচুর দেশীয় পর্যটক এই জেলা ভ্রমণে আসেন।
 
পাহাড়ের অন্য দুই জেলার মধ্যে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই লেক, শুভলং, অপরূপ সাজেক উপত্যকাসহ বেশকিছু দর্শনীয় স্পট আছে। এরমধ্যে সাজেক উপত্যকা পর্যটকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠার পরও সেখানে সরকারি কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে সল্পখরচে থাকা খাওয়া ও যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হয়নি। খাগড়াছড়িতে আলুটিলার গুহা, টেরেং, রিচাং ঝর্ণাসহ বেশকিছু অপরূপ দর্শনীয় স্থানের অবস্থাও প্রায় একই। পর্যটন কর্পোরেশনের বিভিন্ন হোটেল মোটেল থাকলেও সেগুলো পর্যটকদের কাছে তুলে ধরার ক্ষেত্রে সংস্থাটির ব্যর্থতা রয়েছে বলেও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়।
চট্টগ্রাম শহরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, কর্ণফুলী নদী, আনোয়ারার পারকি সমুদ্র সৈকতসহ শহরে অনেক দর্শনীয় ও ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু এখানকার বিচ ম্যানেজম্যান্ট কমিটি গত দুই বছরে দুটি সভা ছাড়া তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নিতে পারেনি। এছাড়াও উপজেলাগুলোতে কয়েকটি ইকোপার্ক, এভিয়ারি পার্ক, ঝর্ণা, লেকসহ স্থানীয় পর্যটন কেন্দ্র রয়েছে। যেগুলোর কোনো কোনোটি পর্যটকদের কাছে জাতীয়ভাবেও পরিচিতি লাভ করছে।
 
এরমধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে পর্যটকদের নতুন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে মিরসরাই। এখানকার নাপিত্তাছড়ার তিনটি ও খৈয়াছড়ার সাতটি ঝর্ণা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ওইসব এলাকায় অবকাঠামো ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এছাড়া মহামায়া লেক ও সেচ প্রকল্পকে আকর্ষনীয় স্পটে পরিণত করার সুযোগ থাকলেও সেখানে প্রাকৃতিক লেক ছাড়া তেমন কিছু গড়ে উঠছেনা।
 
গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন, খৈয়াছড়া ঝর্ণায় যেতে সড়ক নির্মাণ ও নিরাপত্তা জোরদার করতে সরকার ইতিমধ্যে ১২ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। শিগগিরই এই প্রকল্পের কাজ আরম্ভ হবে।
পর্যটন শিল্পের প্রতি সর্বোচ্চ মনোযোগ দিলে এই খাত থেকে শুধুমাত্র বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে বছরে পাঁচ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব। চট্টগ্রাম নগরসহ সৈকত নগরী কক্সবাজার, তিন পার্বত্য জেলায় রয়েছে বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের বিপুল সম্ভাবনা। কক্সবাজার সমুদ্র্র সৈকতকে থাইল্যান্ডের পাতাইয়া বিচ মডেলে সাজিয়ে নানামাত্রিক বৈশ্বিক প্রচারণার মাধ্যমে বছরে কোটি পর্যটক টেনে আনা যায়। বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন, বিদেশি পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধা সম্পন্ন বিশেষায়িত পর্যটন জোন গঠনের মাধ্যমে এটা সম্ভব। পর্যটন শিল্পের প্রতি পর্যাপ্ত মনোযোগ দিলে অন্য সব খাতের তুলনায় অনেক সহজে দেশ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারে।
ইতিহাস-ঐতিহ্য, নৃতাত্ত্বিক ও প্রাকৃতিক বৈচিত্র সর্বোপরি বহুমাত্রিক রূপ চট্টগ্রামকে এই অবস্থানে তুলে এনেছে। যথাযথ মনোযোগ, পরিচর্যা, পর্যটক আকর্ষণের উপকরণে বৈচিত্র জড়ো করা গেলে চট্টগ্রাম থেকে বছরে বিলিয়ন ডলার পর্যটন খাতে আয় সম্ভব। চট্টগ্রাম নগরীর উপকণ্ঠে হাটহাজারী-সীতাকুন্ডের পাহাড় মালায় সহজ যোগাযোগের জন্য ক্যাবল কারসহ স্বল্প খরচে তৈরি করা যায় বড় বড় লেক। যেখানে নৌ-বিহার, সাঁতার, গ্লাইডার বা বেলুন উড্ডয়নসহ বিনোদনের সব আধুনিক উপকরণ যোগান দিয়ে গড়া যায় অতিকায় আধুনিক প্রাকৃতিক রিসর্ট। নগরীর বাটালি পাহাড় কাছাকাছি রেলের পাহাড়সহ ঘন পাহাড় শ্রেণিতেও ক্যাবল কার সংযোগ তৈরি করা যায়। দরকার শুধু পর্যটনবান্ধব সৃজনশীল আইডিয়া, নতুন প্যাকেজ বা প্রোডাক্ট সংযোজন। পাশাপাশি পুরো চট্টগ্রামের যোগাযোগ নেটওয়ার্ক সহজতর করে পর্যটন শিল্পে বিপ্লব আনা সম্ভব। এর জন্য হাজার হাজার কোটি টাকার দরকার নেই। দরকার শুধু পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, আমলাচক্রের মগজে আটকে থাকা বৃটিশ বেনিয়া ধারণার শিকড় উপড়ে ফেলার পাশাপাশি কূমন্ডুকতার বাধা ছিঁড়ে ফেলা। সামাজিক ও ধর্মীয় কূপমন্ডুকতা ছুঁড়ে ফেলে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া পর্যটন শিল্প থেকে বছরে কয়েক বিলিয়ন ডলার আয় করতে পারলে বাংলাদেশ পারবেনা না কেন? ২০২০ সালে পর্যটন শিল্পে ৫ লাখ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করতে হলে পর্যটন খাত বিশেষ করে চট্টগ্রামকে নিয়ে বাড়তি মনোযোগ দিতেই হবে।

কথা হচ্ছে, বিপিসি (পর্যটন কর্পোরেশন) শুধু সুন্দর োগানের লোগো ঝুলিয়ে বছরে একবার বিশ্ব পর্যটন দিবস পালনের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করলে চলবেনা। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রতিটি পর্যটন সম্ভাবনা এবং জাতিতাত্ত্বিক ও নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস, ঐতিহ্য বিশ্বব্যাপী বহুমাত্রিক আধুনিক প্রচারণা কৌশলের মাধ্যমে তুলে ধরার ব্যাপারে তাদের সর্বোচ্চ যোগ্যতার প্রমাণ দিতে হবে। দেশিবিদেশি বিনিয়োগকারীরা যাতে পর্যটন খাতে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়, এ’ব্যাপারে দেশিয় উদ্যোক্তা ও আমাদের দূতাবাসগুলোর সংশ্লিষ্ট বিভাগকে সক্রিয় করতে হবে। চলতি বছরের জুলাই মাসে গুলশানের হলি আর্টিজান ট্র্যাজেডির পর দেশি বিদেশি পর্যটকদের আগমন একেবারে কমে গেছে। রাজধানীসহচট্টগ্রাম এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজার, রাঙামাটি, বান্দরবানের পর্যটন স্পটগুলোতে বিদেশি পর্যটক আগমন আশঙ্কাজনকভাবে কমে গেছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তা, যোগাযোগ দুর্ভোগ ও বিদেশি পর্যটকের কাঙিক্ষত সুবিধা না থাকার কারণে তাদের আগ্রহে ভাটার টান ধরেছে। দেশের জঙ্গি তৎপরতাও বিদেশি পর্যটক আকর্ষণে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। তা’ছাড়া পৃথিবীর সকল মুসলিম দেশে পর্যটকদের জন্য আলাদা সুযোগসুবিধাসহ বিশেষ জোন থাকলেও আমাদের দেশে নেই। পর্যটন শিল্পের মত সম্ভাবনাময় খাতের জন্য ক্ষতিকর বিষয়গুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। পর্যটন এমন একটি শিল্প, যাতে ন্যূনতম বিনিয়োগে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের সহজ সুযোগ রয়েছে। স্বাভাবিক কারণে এ শিল্পটিকে অবহেলিত অবস্থায় ফেলে রাখা, আত্মহননের চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধ। আশা করি, দায়িত্বশীল মহল এটা বিবেচনায় রাখবেন।