পানির জন্য হাহাকার কুতুবদিয়ার হাজার হাজার মানুষ

0
102

পানির হাহাকার
লিটন কুতুবী, কুতুবদিয়া:
নোনা জলে ভরপুর কুতুবদিয়া দ্বীপের হাজার হাজার পুকুর। বৈশাখ জৈষ্ঠ মধুর মাসে মানুষের আনন্দপূর্তি ম্লান করে দিয়েছে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। রোয়ানু আর মধু পূর্ণিমা একত্রিত হয়ে সাগরের জোয়ারের নোনা পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৪/৫ ফুট উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। গত দুই যুগ ধরে কিছু কিছু অংশে পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়িবাঁধ মেরামত না করায় ২০ কিলোমিটার বাঁধ ভাঙা ছিল। রোয়ানু আর পূর্ণিমার জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় সহজেই নোনা জল ঢুকে পড়ে লোকালয়ে। গত ২১ মে দিন দুপুরে চোখের সামনে ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, মালামাল পানি ¯্রােতে ভেসে গেলেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় কান্না ছাড়া আর কোন পথ ছিল না ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর। রোয়ানুর আঘাতে কুতুবদিয়া দ্বীপের চারিপাশে বেড়িবাঁধ লন্ডভন্ড হয়ে গেলে হাজার হাজার পরিবার জোয়ারের নোনা পানিতে প্লাবিত হয়। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসে স্বাভাবিক পুকুর, খাল, বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। ঐ সময়েই জোয়ারের নোনা জল লোকালয়ে ঢুকে পড়ে গত ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু আঘাতে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ছাড়াও অধিকাংশ পরিবারের পুকুরে নোনা জল ঢুকে ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বর্তমানে ঐসব পুকুরগুলো নোনা জলে দূর্গন্ধ ছড়িয়ে বায়ু ও পানি বাহিত রোগ ডায়েরিয়া, শিশু মিউমিনিয়া,ভাইরাস জ্বরসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় গভীর আর অগভীর নলকূপ থাকায় কোন প্রকারে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ প্রাণে রক্ষা পাচ্ছে। আবার যে সব এলাকায় নলকূপ নেই ঐ এলাকার মানুষ মারাতœক পানীয় জলের হাহাকারে ভোগছে। এ ব্যাপারে কুতুবদিয়া উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) সালেহীন তানভীর গাজীর সাথে কথা হলে তিনি জানান, দূর্যোগের কবলে পড়ে নোনা জলে ভর্তি পুকুরগুলো স্ব-স্ব এলাকার পরিষদের অর্থায়নে নিস্কাশনের ব্যবস্থা করার জন্য প্রত্যেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান,মেম্বারদের নিদের্শ দেয়া হয়েছে। এদিকে কুতুবদিয়া দ্বীপের বড়ঘোপ ইউপির চেয়ারম্যান এডভোকেট ফরিদুল ইসলাম চৌধূরী জানান, আজম কলোনী, নয়াপাড়া, মিয়ারঘোনা, দক্ষিণ অমজাখালী গ্রামে গভীর নলকূপ না থাকায় বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকট চরমে। কৈয়ারবিল ইউপির চেয়ারম্যান জালাল আহমদ বলেন, তার ইউনিয়নে মলমচর, কলস্যাঘোনা, বিন্দাপাড়া, মিজ্জিরপাড়া ছাড়াও দক্ষিণ লেমশীখালী, সতর উদ্দিনসহ ১০ গ্রামে নলকূপ না থাকায় ঐসব এলাকার মানুষ বিশুদ্ধ পানীয় জলের সংকটে রয়েছে। এসব এলাকার লোকজন এক কিলোমিটার দুরে গিয়ে বিশুদ্ধ পানির জন্য যেতে হয়। জরুরী ভিত্তিতে গভীর নলকূপ স্থাপন করার জন্য সংশ্লিষ্ট জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের প্রতি দাবী জানান। পানীয় সংকট মোকাবেলার জন্য যুগের পর যুগ ধরে এসব গ্রামের হাজার হাজার মানুষ সংগ্রাম করে এলেও তার প্রতিকার পায়নি। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অফিস বলছে এসব এলাকায় টেষ্ট টিউবওয়েল (গভীর নলকূপ) বসানোর জন্য কর্তৃপক্ষের নিকট চাহিদাপত্র প্রেরণ করা হয়। জনপ্রতিনিধিরা গ্রামের সহজ সরল লোকজনকে মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিয়তই পানীয় জলের সংকট নিরসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে যায় শুধু। জনপ্রতিনিধিদের র্স্বাথ আদায় হয়ে গেলে এ গ্রামবাসীর আশা পূরণ করার জন্য এলাকায় আর তাদের দেখা মিলে না। যুগ যুগ ধরে এ প্রতারণার শিকার হচ্ছে কুতুবদিয়া উপজেলা সদর ইউনিয়নের আজম কলোনী, মিয়ার পাড়া, নয়া কৈবত্য জেলে পাড়া, রেইজ্যারপাড়া, সাইটপাড়ার হাজার হাজার মানুষ । আজম কলোনীর স্থানীয় বাসিন্দা শামসুল ইসলাম (৭৫) জানান, গেল শতাব্দির ৬০ দশকের পর থেকে মিয়ারঘোনা, আজম কলোনী, নয়া কৈবত্য জেলে পাড়া, সাইট পাড়া, রেইজ্যাপাড়া, এলাকায় জনবসতি গড়ে উঠে। তখন থেকেই এসব গ্রামে বসবাসরত মানুষ পুকুরের পানি পান করে আসছে। যুগের পর যুগ গ্রাম বাসিরা পানীয় জলের সংকট নিরসনের জন্য জনপ্রতিনিধি থেকে গুরু করে প্রশাসনের নিকট ধর্ণা দিয়েও কোন ধরণের প্রতিকার পায়নি এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী আরো জানান, বড়ঘোপ আজম কলোনী,নয়াপাড়া গ্রামে সরকারি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান উপজেলা খাদ্য গুদাম অফিস, কুতুবদিয়া উপজেলা বনবিভাগ অফিস, উপজেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস রয়েছে। এসব অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ এলাকার হাজার হাজার মানুষ পানীয় জলের সংকট কাটছে না যুগের পর যুগ ধরে। এ ছাড়াও রয়েছে সরকারি বে-সরকারি ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ।
কুতুবদিয়া উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তা মোরশেদ আলম জানান, খাদ্যগুদাম এলাকায় গভীর অগভীর নলকূপ না থাকায় পানীয় জলের পিপাসা মিটাতে প্রতি কলসি খাবার পানি ১০ টাকায় ক্রয় করে পান করতে হচ্ছে। একই কথা বনবিভাগ ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্মকর্তা কর্মচারীদের। এছাড়াও ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় শত শত শিক্ষার্থী পানীয় জলের সংকটে থাকলেও দেখার কেউ নেই বলে জানায় উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধানগণ।
কুতুবদিয়া ফিশিং ট্রুলার মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদিন বলেন, শুস্ক মৌসুমে আজম কলোনীর পূর্ব পাশে চরে পিলট কাটা খালের সম্মুখে ৮/১০টি শুটঁিক মাছের কিল্লা গড়ে উঠে। এসব কিল্লার শ্রমিক থেকে শুরু করে মাছ ব্যবসায়ী দৈনিক তিন হাজার মানুষের মিলন মেলা ঘটে। খাবার পানির জন্য এলাকা এবং গ্রামবাসীকে উপজেলা সদর তিন কিলোমিটার দুর থেকে কলসি অথবা ড্রাম ভর্তি করে গভীর নলকূপের পানি এনে পিপাসা নিবারন করতে হয়।
বড়ঘোপ ইউপির সদস্য আশরাফ আলী জানান, মিয়ারঘোনা, আজম কলোনী, নয়া কৈবর্ত্য জেলে পাড়ার রেইজ্যাপাড়া ,সাইটপাড়া, প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস । এসব গ্রামে গভীর ও অগভীর নলকূপ না থাকায় পানীয় জলের সংকটে রয়েছে চরমে। বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি খাবার জল হিসেবে পান করলেও গ্রীস্মকালে পুকুরের পানি খাবার জল হিসেবে পান করতে হয়। তাই এসব এলাকায় মানুষের মাঝে পানিবাহিত রোগ লেগেই থাকে।