পাহাড়ি জুমের সোনালি ফসল

0
85

পাহাড়ে শুরু হয়েছে জুম ফসল (পাকা ধান ও অন্যান্য ফসল) ঘরে তোলার মহোৎসব। পার্বত্যাঞ্চলের পাহাড়ে পাহাড়ে এখন জুম কাটার ভরা মৌসুম। পাহাড়ি জুমের সোনালি ফসল তুলতে এখন ব্যস্ত স্থানীয় জুমিয়ারা। একইসাথে পাকা ধানসহ অন্যান্য ফসল তোলার ধুম লেগেছে পার্বত্য জেলা বান্দরবানেও।
দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর জুমের সোনালি ফসল উঠছে বলে জুমচাষীদের মুখে ফুটেছে নির্মল হাসি। এ আনন্দে ঘরে ঘরে নবান্ন উৎসবে মেতে উঠেছে জুমচাষীরা। তাছাড়া পাহাড়িদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ‘প্রবারণা পূর্নিমা’ কে ঘিরেও চলছে নানান প্রস্তুতি। ফসল ঘরে তোলার আনন্দ ও প্রবারণা উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়েছে পুরো পার্বত্য অঞ্চলজুড়ে।
বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি এই তিন পার্বত্য জেলাতেই একমাত্র জুমচাষ হয়ে থাকে। পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির জীবিকার আদিম ও প্রধান উৎস জুম চাষ। এ বছর আবহাওয়া পাহাড়ে জুমের ধান ঘরে তুলতে ব্যস্ত পাহাড়ীরা৩অনুকূল থাকায় ধানসহ জুমের বাম্পার ফলন জুমচাষীদের মুখে হাসি ফুটিয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জুমের পাকা ধান ছাড়াও মারফা, বেগুন, মরিচ, ঢেঁড়শ, কাকরোল, কুমড়াসহ বিভিন্ন ফসল ঘরে উঠছে। জুমে মিশ্র প্রজাতির শস্যবীজ বপন করে প্রায় পাঁচ মাস পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের পর ভাদ্র-আশ্বিন মাসে ফসল ঘরে তোলে চাষীরা।
এদিকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুম চাষের লক্ষ্যে জুমচাষীদের প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম তিন পার্বত্য জেলায় সাস্টেইনেবল ল্যান্ড ম্যানেজমেন্ট কম্পোনেন্ট-২ নামে একটি প্রকল্প শুরু করে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন ।
তারই ধারাবাহিকতায় আনুষ্ঠানিকভাবে বান্দরবানে ২শ’ একর জমিতে ৫শ’ কৃষককে নিয়ে গবেষণা শুরু হয় ২০১৬ সালের শুরুতে। এরপর জেলার রামারি পাড়া, ম্রংলংপাড়া ও পর্যটন চাকমাপাড়া এলাকায় কৃষি-কার্যক্রম শুরু করা হয়। এতে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিমিত সার ও কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে একই জমিতে শুরু করা হয় আধুনিক জুম চাষ প্রক্রিয়া। এর ফলে তারা লাভবান হচ্ছেন বলে জানালেন স্থানীয় জুমিয়ারা। এ পদ্ধতিতে প্রথমে বান্দরবান জেলায় জুম চাষ করা হলেও পর্যায়ক্রমে রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়িতে শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
রামারিপাড়ার জুম চাষী পাই হ্লা ম্রো জানান, পুরাতন পদ্ধতিতে জুম চাষে অধিক সময়ের প্রয়োজন। এতে জুমের ফসল ঘরে তুলতে অনেক সময় ব্যয় হয়। তবে কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে প্রশিক্ষণ গ্রহনের পর জুমচাষীরা লাভবান হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরমিত মাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করে একই জমিতে বিভিন্ন ফসলের চাষ করা যাচ্ছে। এতে খরচ কম হয়। ফলে সহজে লাভবান হচ্ছে স্থানীয় জুমিয়ারা।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে বান্দরবানের সাতটি উপজেলায় ৫ হাজার ২০১ হেক্টর পাহাড়ি জমিতে জুমচাষ হয়েছে। এর মধ্যে বান্দরবান সদর উপজেলায় ৪৮৭ হেক্টর, রোয়াংছড়িতে ৫৩০ হেক্টর, রুমায় ১ হাজার ৪৫৫ হেক্টর, লামায় ১ হাজার ৩২১ হেক্টর, আলীকদমে ৯১৫ হেক্টর ও নাইক্ষ্যংছড়িতে ৭১৫ হেক্টর জমিতে জুমচাষ করা হয়। এতে প্রায় ৭ হাজার ৪৮৫ মেট্রিক টন ফলন পাওয়া গেছে।
জেলার বিভিন্ন এলাকার জুমচাষীরা জানান, এ মৌসুমে অনুকূল আবহাওয়ার কারণে জুমের ফলন খুবই ভালো হয়েছে। ইঁদুরের উৎপাতও কমেছে অনেকাংশে। তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস জুমচাষীদের মনে। জুম চাষীরা পৌষ-মাঘ মাসে পাহাড়ের ঢালে জঙ্গল কাটার পর ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে আগুনে পুড়িয়ে টিলা-পাহাড়কে জুম চাষের উপযোগী করে তোলেন। এরপর বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে পাহাড়ে ধান, কাউন, ভুট্টা, ফুটি, তুলা, আলু, কচু, হলদি, সুগন্ধি সাবারং পাতা, তিল, চীনার যব ইত্যাদি ফসলের বীজ বপন করে। এ ফসল পেতে অপেক্ষা করতে হয় আষাঢ়-শ্রাবণ মাস পর্যন্ত। প্রথম দিকে মারফা, মরিচ, চিনার, ভুট্টা তোলা হয়। এরপর ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্তিক মাসে পাকতে শুরু করে ধান। শেষের দিকে তুলা, তিল, যব ঘরে তোলা হয় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাসজুড়ে।
বান্দরবানের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের কর্মকর্তা আলতাফ হোসেন জানান, কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সর্বদা কৃষকদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সম্প্রতি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে জুমচাষ পদ্ধতি শুরু হওয়ায় ফলন ভালো হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ পদ্ধতিতে জুম চাষ করা গেলে ফলন বাড়ার সাথে সাথে পরিবেশের ভারসাম্যও রক্ষা করা সম্ভব হবে।