পেকুয়া-চকরিয়া উপকূলে বনবিভাগের ৬হাজার একর জমি বেদখল

0
97

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, কক্সবাজার প্রতিনিধি
কক্সবাজারের পেকুয়া-চকরিয়ায় উপকুলীয় বনবিভাগের সৃজিত প্যারাবন নিধন করে চলছে চিংড়ি ঘের তৈরীর হিড়িক। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জনবল সল্পতার সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে দিনের পর দিন অবৈধভাবে দখলে নিচ্ছে এসব প্যারাবন। পরে তাঁরা নির্বিচারে সৃজিত রকমারী বৃক্ষরাজি নিধণের পর প্যারাবনের জমিতে গড়ে তোলছে চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ। এভাবে গত ২২বছরে উপকুলীয় বনবিভাগের প্রায় ৬হাজার একর জমি বেদখল হয়ে পড়েছে। বন বিভাগ প্যারাবন নিধন ও দখলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ইতোপুর্বে ক্ষতিপুরণসহ বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় ৪০টি মামলা রুজু করেছে। তারমধ্যে আদালতে বর্তমানে চলমান রয়েছে ক্ষতিপুরণের অভিযোগে ৫টি ও জমি উদ্ধারসহ অন্যান্য অভিযোগে ১৭টি মামলা।

বন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চকরিয়া উপজেলার রামপুর ও চরনদ্বীপ মৌজায় সুন্দরবন এলাকায় উপকুলীয় বনবিভাগের ৭হাজার একর প্যারাবন থাকলেও বিগত সময়ে বিপুল পরিমাণ জমি জেলা প্রশাসকের এক নম্বর খাস খতিয়ানে অর্ন্তভুক্ত হয়। ফলে বর্তমানে উপকুলীয় বনবিভাগের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে মাত্র ১২শত একর জমি। প্রশাসন থেকে লীজ মুলে ও ক্ষেত্র বিশেষে স্থানীয় প্রভাবশালীরা অবৈধ পন্থায় দখলে নিয়ে ১৯৯১সালের পর ২০১৩সাল পর্যন্ত সময়ে উপকুলীয় বনবিভাগের প্রায় ৬হাজার একর প্যারাবন নিধন করে তৈরী করেছেন চিংড়ি ঘের ও লবণ জমি।

জানা গেছে, ২০০৯সালে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার আগে থেকে চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের চিলখালী এলাকায় উপকুলীয় বনবিভাগের মালিকানাধীন ৩১৫একর প্যারাবন অবৈধ ভাবে দখলে নেন পৌরসভার কাহারিয়াঘোনা গ্রামের বাসিন্দা আওয়ামীলীগ নেতা সেকান্দার বাদশা নাগু ও বদরখালীর মাহামুদুল হক মাঝিসহ তাদের লোকজন। পরে তাঁরা প্যারাবন নিধণ করে এখানে তেরী করেন চিংড়ি ঘের। প্রতিবছর ওই চিংড়ি ঘের থেকে মাছ উৎপাদন করে তারা হাতিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। এখনো বহাল তবিয়তে ভোগ দখলে রয়েছেন ওই চিংড়ি ঘেরে।

বদরখালী ইউনিয়ন পরিষদের এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার সর্তে বলেন, শুধু নাগু সওদাগর, মাহামুদুল হক মাঝি নয়, এখানে উপকুলীয় বনবিভাগের প্যারাবন নিধন করে আরো অনেকে অবৈধ ভাবে চিংড়ি ঘের ও লবণ জমির মালিক হয়েছেন। বনবিভাগের জনবল সংকটের সুযোগে স্থানীয় প্রভাবশালীরা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে দখল চেষ্টা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। ফলে বনবিভাগ মামলা করলেও অভিযুক্তরা ওই মামলার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রীট মামলা করে বিচার কার্য ঝুলিয়ে রেখে দিব্যি বহাল তবিয়তে রয়ে যাচ্ছে।

সুত্র জানায়, ৯১সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের পর উপকূলীয় এলাকার বেড়িবাঁধ, জেগে উঠা চর ও রাস্তার ধারে সৃজন করা প্যারাবন এখন আর নেই। সময়ের পরিক্রমায় এলাকার প্রভাবশালীরা সৃজনের পরের বছর থেকে প্যারাবন নিধন করে সেখানে লবণ ও চিংড়ি চাষ শুরু করেছে। এখনো বিদ্যমান রয়েছে জবরদখলের প্রতিযোগিতা। গত বৃহস্পতিবার চকরিয়া উপজেলার বদরখালী ইউনিয়নের এক নম্বর পোল্ডারের দুই নম্বর স্লুইচ এলাকায় সরেজমিনে দেখা গেছে নতুন করে প্যারাবন নিধনের মাধ্যমে চিংড়ি ঘের তৈরীর দৃশ্য। নতুন করে বেদখল হওয়া ওই জমিটি পড়েছে উপজেলার রামপুর মৌজার ২০০১নম্বর দাগে।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, বদরখালী ইউনিয়নের আমিরখালী পাড়ার আবুল আহমদের ছেলে আবদুল কাদের, গুদাম পাড়ার মৃত আছদ আলীর ছেলে নুরুল আলম, তার ভাই আবু ছিদ্দিক, একই গ্রামের মৃত রশিদ আহমদের ছেলে নাছির উদ্দিন, মৃত ছফুর আলীর ছেলে জাফর আহমদ, মৃত বজল আহমদের ছেলে ফরিদুল আলম ও বদর মিয়ার ছেলে গিয়াস উদ্দিনসহ ৩৫-৪০জনের একটি চক্র গত ডিসেম্বর মাসে বনবিভাগের লোকজনের অনুপস্থিতির সুযোগে প্রায় ২শত একর প্যারাবন দখল করে নেয়। কয়েক শত শ্রমিক দিয়ে তাঁরা প্যারাবনের বৃক্ষরাজি নিধণের মাধ্যমে সেখানে তৈরী করেছে চিংড়ি ঘের। ইতোমধ্যে তাঁরা চিংড়ি ঘেরের চর্তুরদিকে মাটি কেটে আট (স্থানীয় ভাষায় আইল) বেঁেধ মৎস্য চাষের উপযুগী করেছে দখল করা প্যারাবনের ওই জমি।

জানতে চাইলে চকরিয়ার রামপুর ও চরনদ্বীপ মৌজার দায়িত্বরত উপকুলীয় বনবিভাগের ঘোরকঘাটা রেঞ্জ কর্মকর্তা মো.ইকবাল হোসেন বলেন, দুই মৌজার প্রায় চিংড়ি ঘের ও লবণ মাঠ এক সময় উপকুলীয় বনবিভাগের ছিল। বিগত সময়ে জেলা প্রশাসকের এক নম্বর খাস খতিয়ানে বিপুল পরিমাণ জমি চলে যাওয়ার পর এখন তাদের নিয়ন্ত্রনে রয়েছে মাত্র ১২শত একর জমি। তিনি বলেন, যেসব প্যারাবন নিধন ও জবরদখল হয়েছে সে গুলো অনেক বছর আগের ঘটনা। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলাও দেয়া হয়েছে। তিনি আরো বলেন, এখনো ক্ষতিপুরণের অভিযোগে ৫টি ও দখলসহ অন্যান্য অভিযোগে ১৭টি মামলা আদালতে চলমান রয়েছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম উপকুলীয় বনবিভাগের কক্সবাজার জেলার দায়িত্বরত সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মো.এনামুল হক জিয়া মুঠোফোনে বলেন, বিগত সময়ে জনবল সল্পতার কারনে মুলত উপকুলীয় বনবিভাগের প্যারাবন ও জমি বেহাত হয়েছে। এখন জনবল সল্পলতা থাকলেও জমি দখলের সেই সুযোগ কাউকে দেওয়া হচ্ছেনা। তিনি বলেন, মামলা দেয়ার মাধ্যমে আগের বেদখল হওয়া জমি উদ্ধারে সব রকম চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নতুন করে কেই প্যারাবন নিধন ও দখল করে থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রনজিত কুমার বড়–য়া বলেন, প্যারাবন নিধন ও দখলে জড়িতরা শুধু সরকারের নয়, তাঁরা জনগণ ও পরিবেশের শুত্রু। বনবিভাগ চাইলে জড়িতদের গ্রেফতারে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।