গত ১১ জুলাই ২০১৩ গণভবনে কয়েকজন মন্ত্রিপরিষদ সদস্য ও উচ্চ পর্যায়ের দলীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনাকালে নোবেলজয়ীরফেসর মুহাম্মদ ইউনূস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিছু মন্তব্য করেছেন বলে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী প্রফেসর ইউনূস সম্বন্ধে অনেক অভিযোগও উত্থাপন করেছেন। অভিযোগগুলি সবই মিথ্যা। পত্রপত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য দেখে দেশের মানুষ হতবাক হয়েছে।
আমরা আশা করেছিলাম প্রধানমন্ত্রী এই রিপোর্টের প্রতিবাদ করবেন এবং বলবেন যে তিনি এই ধরনের কথা বলেন নি। কিন্তু পাঁচদিন যাবার পরেও এই প্রতিবাদ আসেনি। তাই বাধ্য হয়ে আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে দেশের জন্য বড় রকম ইমপ্লিকেশন (ইঙ্গিত) আছে এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রফেসর ইউনূসের জন্যও। এর ফলে দেশের মানুষের মনে কিছু ভুল ধারণার জন্ম দিতে পারে। তাই আমরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
এ ব্যাপারে ইউনূস সেন্টারের পক্ষ থেকে নিম্নলিখিত বক্তব্য তুলে ধরা হলো:
১.০ প্রধানমন্ত্রীঃ প্রফেসর ইউনূস একজন স্বার্থপর মানুষ, যিনি নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য যেকোনো কাজ করতে পারেন।
আমাদের বক্তব্যঃ প্রফেসর ইউনূস সারা জীবন গরীবের জন্য কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত স্বার্থে তিনি কোনো কাজ করেননি। তাঁর মালিকানায় কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। গ্রামীণ নামধারী, কিংবা গ্রামীণ নামধারী নয়, কোনো রকম কোম্পানিতে তাঁর একটিও শেয়ার নেই। গ্রামীণ কোম্পানিগুলো দেশের এবং দেশের গরীব মানুষের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মুনাফাকেন্দ্রিক বিশ্বকে পরিবর্তনের জন্য যে প্রফেসর ইউনূস ‘সামাজিক ব্যবসা’-র ধারণা সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দেবার আন্দোলনে নেমেছেন- তাঁকেই কিনা তাঁর দেশের প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বলছেন তিনি স্বার্থপর? যেখানে সামাজিক ব্যবসার মূল ভিত্তি হলো পরার্থপরতা, সেখানে প্রফেসর ইউনূস স্বার্থপর হলেন কিভাবে? ড. ইউনূসের স্বার্থপরতার একটি দৃষ্টান্ত কি প্রধানমন্ত্রী মহোদয় দেবেন? ড. ইউনূস কি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হয়েছেন? তিনি কি এক লাখেরও বেশি ছেলেমেয়েকে চাকরি দিতে গিয়ে তাদের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বড়লোক হয়েছেন? নাকি তিনি তাঁর কোনো ব্যবসায়িক কার্যক্রম থেকে অন্য কাউকে ভাগ দেয়া হয় নি বলে তাঁকে স্বার্থপর বলা হচ্ছে?
২.০ প্রধানমন্ত্রীঃ নরওয়ের টেলিনর কোম্পানি প্রফেসর ইউনূসের জন্য লবি করেছে। টেলিনর বিশাল অংকের অর্থ ক্লিনটন ফাউন্ডেশনকে দিয়েছে, যাতে তারা ইউনূসের জন্য নোবেল পুরস্কার এনে দিতে পারে।
আমাদের বক্তব্যঃ প্রধানমন্ত্রী যেহেতু পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের কোনো প্রতিবাদ করেন নি, সেহেতু তার বক্তব্যকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। বক্তব্যটি দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এই বক্তব্য প্রমাণ করার জন্য তাঁর যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ লাগবে। তা না হলে দুটি বন্ধু দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিদেশি তিনটি প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বড়রকম দুর্নীতের অভিযোগ এসেছে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে। বিষয়টা কেউ হালকাভাবে নেবে না।
এই তিনটি প্রতিষ্ঠান হলোঃ
ক্লিনটন ফাউন্ডেশন যেটা প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এবং তিনি সেটা নিজে পরিচালনা করেন। তাঁর স্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। হিলারি ক্লিনটন আগামীতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিযোগিতা করবেন বলে জল্পনা- কল্পনা শোনা যাচ্ছে। তাঁর প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এটা প্রমাণ করা গেলে তাঁর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার আর কোনো সুযোগই থাকবে না। যদি প্রমাণ করা না যায়, তাঁদের বিরুদ্ধে এই ব্যক্তিগত অভিযোগ করার ফলে তাদের অনুসারীদের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। প্
দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠানটি হলো টেলিনর। এটা নরওয়েজিয়ান সরকারের মালিকানায় পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান। দুর্নীতির এই অভিযোগ নরওয়েজিয়ান সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়ালো। তারা আমাদের একটি উন্নয়ন সহযোগী দেশ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার আগে আমাদের হাতে কী ধরনের সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে তা ভালোভাবে যাচাই করে দেখতে হবে। তা নাহলে এটা একটা বন্ধু রাষ্ট্রের প্রতি বিরূপ আচরণ করার সামিল হবে।
তৃতীয় প্রতিষ্ঠানটি হলো ‘নোবেল শান্তি পুরস্কার কমিটি’। লবিং করে নোবেল পুরস্কার কেনা যায়- এই অভিযোগের পক্ষে উপযুক্ত প্রমাণাদি দিতে পারলে পুরো পুরস্কারটিই আগামীতে তাঁর সমস্ত মর্যাদা হারাবে। প্রমাণ করতে না পারলে সেটাও নরওয়েজিয়ান সরকারের ও জনগণের সঙ্গে বাংলাদেশের দূরত্ব সৃষ্টি করবে। কারণ নরওয়ের মানুষ এই পুরস্কারটিকে কেন্দ্র করে জাতীয়ভাবে গর্ব অনুভব করে। এই ব্যাপারে বিনা প্রমাণে দুর্নীতির অভিযোগ তাদের সবাইকে বিশেষভাবে আহত করবে।
৩.০ প্রধানমন্ত্রীঃ গরীব মানুষকে ঋণ দেবার জন্য গ্রামীণব্যাংক সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু এই ব্যাংকের টাকা ড. ইউনূস গ্রামীণ শক্তি ও এধরনের অন্যান্য ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে সরিয়ে ফেলেছেন।
আমাদের বক্তব্যঃ গ্রামীণব্যাংকের বিধান অনুসারে গ্রামীণব্যাংক তার পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদনক্রমে, দাতা সংস্থাসমূহের শর্তানুসারে তাদের দেওয়া টাকা ব্যবহার করেছে। প্রফেসর ইউনূস তাঁর ব্যক্তিগত কোনো প্রতিষ্ঠানে কোনো টাকা সরিয়ে ফেলেন নি। তাঁর কোনো ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানই নেই, তাই ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানে টাকা সরিয়ে ফেলার কোনো প্রশ্নই উঠে না।
৪.০ প্রধানমন্ত্রীঃ প্রফেসর ইউনূস গ্রামীণব্যাংকের টাকায় এমনকি ‘ইউনূস সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার ভাইয়েরা এবং আত্মীয়- স্বজনরা গ্রামীণ ব্যাংক এবং এর সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে অনেক আর্থিক সুবিধা গ্রহণ করেছেন।
আমাদের বক্তব্যঃ অভিযোগটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। গ্রামীণব্যাংক ইউনূস সেন্টারকে কখনো কোনো টাকা দেয় নি। একজন সম্মানিত প্রধানমন্ত্রী দেশের একজন সম্মানিত নাগরিক সম্বন্ধে মিথ্যা বক্তব্য দেবেন এটা কখনো কারো কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি যদি তাঁর বক্তব্য প্রমাণ করতে না পারেন, তাহলে তার বক্তব্য প্রত্যাহার করাটাই সম্মানজনক পন্থা হবে। ইউনূস সেন্টার সম্পূর্ণভাবে ড. ইউনূসের নিজস্ব উপার্জনের টাকা দিয়ে চলে। তিনি তার নিজস্ব টাকা ইউনূস সেন্টারকে দান করেন। প্রতি বছর বিভিন্ন সম্মেলনে বক্তৃতা দিয়ে তিনি যে উপার্জন করেন তার সামান্য অংশ দিলেই এর খরচ পুষিয়ে যায়। প্রতি বছর তিনি অনেক বক্তৃতা করেন। প্রতি বক্তৃতার জন্য তিনি বিরাট অংকের সম্মানী পান। এগুলোর একটা বা দুটো বক্তৃতা থেকে প্রাপ্ত সম্মানির টাকা দিলেই ইউনূস সেন্টারের সব খরচ বহন করা হয়ে যায়। ইউনূস সেন্টারের অফিস গ্রামীণ ব্যাংক ভবনে অবস্থিত। গ্রামীণব্যাংকের বোর্ড গ্রামীণ ‘নোবেল লরিয়েট ট্রাস্ট’ নামে একটি ট্রাস্ট গঠন করে ব্যাংকের একটি ফ্লোর এই ট্রাস্টকে ২৫ বছরের জন্য বিনামূল্যে ইজারা দেয়। এই ট্রাস্ট ইউনূস সেন্টারকে ফ্লোরটি নামমাত্র মূল্যে ইজারা দিয়েছে।
তাঁর ভাইদের প্রসঙ্গে প্রফেসর ইউনূস আগেও বলেছেন। তাঁর দুই ভাই ঢাকায় থাকেন। মুহাম্মদ ইব্রাহীম এবং মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর। মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সঙ্গে গ্রামীণের কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নেই। মুহাম্মদ ইব্রাহীম তাঁর যোগ্যতায় চারটি মুনাফাবিহীন গ্রামীণ কোম্পানির বোর্ডের সদস্য। বোর্ডের কোনো সদস্য এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো আর্থিক সুবিধা নিতে পারে না, তারা শুধু বোর্ডসভায় যোগদান করেন। ড. ইব্রাহীম ছাড়া আর কোনো ভাইয়ের সঙ্গে গ্রামীণ নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানের কোনো সম্পর্ক নেই। ড. ইউনূসের কোনো আত্মীয়- স্বজনের সঙ্গে গ্রামীণ নামধারী কোনো প্রতিষ্ঠানের সম্পর্ক নেই। প্রধানমন্ত্রী মিথ্যা অভিযোগ করেছেন।
৫.০ প্রধানমন্ত্রীঃ একটি শক্তিশালী দেশ প্রফেসর ইউনূসকে এতদিন মদত দিয়ে এসেছে। এমন দিন আর দূরে নয় যেদিন সেদেশের মানুষ যখন প্রফেসর ইউনূসের অজানা সব তথ্য জেনে যাবে তখন তারা প্রফেসর ইউনূসের কাছ থেকে সমস্ত সমর্থন প্রত্যাহার করে নেওয়ার জন্য তাদের সরকারের উপর চাপ দেবে। সেদেশের সরকার যখন মুখ ফিরিয়ে নেবে, তখন প্রফেসর ইউনূস যাবেন কোথায়?
আমাদের বক্তব্যঃ প্রফেসর ইউনূস এক বা একাধিক দেশের সমর্থনের উপর নির্ভর করে কাজ করেন না। তিনি যেটা ভালো মনে করেন সেটা করে যান। তাঁর কাজ দেখে যেমন এদেশের মানুষ তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন, অন্য দেশের মানুষও তেমনি তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন। বাংলাদেশ সরকার বহু রকমভাবে, এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ব্যবহার করে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রফেসর ইউনূসের ‘দুর্নীতি ও অনাচারের’ মিথ্যা তালিকা প্রচার করেও দেশ-বিদেশের মানুষকে প্রফেসর ইউনূসের তথাকথিত অজানা কাহিনীগুলো বিশ্বাস করাতে পারেন নি। একজন নাগরিককে ভণ্ড প্রমাণ করার পেছনে সরকার যতই তার মেধা ও অর্থ ব্যয় করছে, ততই নিজের দেশের সামনে, দুনিয়ার সামনে নিজেকে ভণ্ড প্রমাণ করে যাচ্ছে। পৃথিবীর সম্মানের আসন থেকে বাংলাদেশকে ক্রমেই তাচ্ছিল্যের দূরত্বে সরিয়ে দিচ্ছে।