ফল খেয়েই জীবনধারণ

0
367

ফল, আল্লাহর এক অপূর্ব নিয়ামত। কথায় আছে ‘ফলই বল’। আদিকালে মানুষ বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত এবং ফল খেয়েই জীবনধারণ করত। বর্তমান সোগ্লান হচ্ছে
দেশি ফলে পুষ্টি বেশি
অর্থ খাদ্যে পাই তুষ্টি।
দেশি ফল পুষ্টিতে ভরপুর। বর্তমানে ফল অর্থকরী ফসল। ফল গাছ কাঠ দেয়, ছায়া দেয় এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে। ফলের রয়েছে ভেষজ বা ঔষধি গুণ। নিয়মিত ফল খেলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সুস্থ সবল জীবন লাভ করা যায়।
খনার বচনে আছে, বারো মাসে বারো ফল
না খেলে যায় রসাতল।
তাই বলব, সুস্থ সবল জীবন চান
হরহামেশা ফল খান।
আমাদের দেশের অধিকাংশ লোক পুষ্টিহীনতার শিকার। এখানকার প্রায় ৮৮ ভাগ লোক ভিটামিন-এ, ৯০ ভাগ লোক ভিটামিন-সি, ৯৩ ভাগ লোক ক্যালসিয়ামের অভাবে ভোগে। এ ছাড়া প্রায় ৭০ ভাগ পুরুষ, ৭৩ ভাগ শিশু ও ৭৫ ভাগ মহিলা রক্তাল্পতা রোগে ভোগে। আমাদের এ পুষ্টি ঘাটতি পূরণে ফল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

পুষ্টিবিদদের মতে, সুস্থ সবল দেহের জন্য দৈনিক জনপ্রতি ১১৫ গ্রাম ফল খাওয়া দরকার। তা জোগান দেয়া সম্ভব না হলে কমপক্ষে ৬০ গ্রাম ফল খাওয়া বাঞ্ছনীয়।
বয়স অনুপাতে দৈনিক খাদ্য তালিকায় ফলের চাহিদা
বয়স ফলের পরিমাণ (মাথাপিছু গ্রহণ হার
শিশু ৩০ গ্রাম
কিশোর (১৩-১৯ বছর) ৬০ গ্রাম
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ৬০ গ্রাম
গর্ভবতী মহিলা ৯০ গ্রাম
সূত্র : পুষ্টি প্রশিক্ষণ সহায়িকা, জনস্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়।

দেশি ফলে বেশি বল
আমাদের দেশে বিভিন্ন মৌসুমে বাহারি ফল জন্মে। এসব দেশি ফল বিদেশি ফলের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। শুধু স্বাদে, গন্ধেই নয় পুষ্টি মানের বিচারেও উৎকৃষ্ট। আজকাল অনেক দেশি ফলের নাম শুনলে নাক ছিটকান। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাচ্চাদেরকে নামি-দামি বিদেশি ফল-আপেল, আঙুর, মাল্টা খাওয়ান। অথচ দেশি ফলে পুষ্টি উপাদান বেশি। বিদেশি ফল আপেলে ভিটামিন-সি আছে খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রামে মাত্র ৩.৫ মিলিগ্রাম। অপরদিকে বাংলার আপেল বলে খ্যাত পেয়ারায় ভিটামিন-সি আছে ২১০ মিলিগ্রাম। অর্থাৎ পেয়ারায় আপেলের চেয়ে ৫০ গুণেরও বেশি ভিটামিন-সি আছে। আঙুরে খাদ্যশক্তি আছে ১৭ কিলোক্যালরি আর কুলে খাদ্যশক্তি আছে ১০৪ কিলোক্যালরি যা ৬ গুণেরও বেশি। আঙুরে ভিটামিন সি আছে ২৮.৫ মিলিগ্রাম, কুলে ভিটামিন সি আছে ৫১ মিলিগ্রাম অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। পাকা আমে ক্যারোটিন আছে ৮৩০০ মাইক্রোগ্রাম, পেঁপের মধ্যে আছে ৮১০০ মাইক্রোগ্রাম, কাঁঠালে আছে ৪৭০০ মাইক্রোগ্রাম (ফল পরিচিতি ও চাষাবাদ কৌশল, কৃতসা)। সে তুলনায় আঙুর, আপেল, নাশপাতি, বেদানায় ক্যারোটিন আদৌ নেই। বিদেশি ফল মাল্টা ক্যারোটিন শূন্য অথচ দেশি কমলায় ক্যারোটিনের পরিমাণ ৩৬২ মাইক্রোগ্রাম (কৃষি কথা, আষাঢ় ১৪২১)। সুতরাং-

আর নয় বিদেশি ফল
খাবো কেবল দেশি ফল।

অপুষ্টিজনিত রোগবালাই প্রতিরোধে দেশি ফল
ভিটামিন-এ’র অভাবে শিশুদের রাতকানা, অন্ধত্ব রোগ দেখা দেয়। বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০ থেকে ৪০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করে এবং রাতকানা রোগে ভোগে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু। হলদে বা লালচে রঙিন ফল যেমন- পাকা আম, পাকা পেঁপে, পাকা কাঁঠাল ক্যারোটিন সমৃদ্ধ। এ ক্যারোটিন প্রায় ৬ ভাগের এক ভাগ ভিটামিন-এ তে রূপান্তরিত হয়ে আমাদের শরীরে কাজে লাগে। এসব ফল অন্যান্য পুষ্টি উপাদানে সমৃদ্ধ। তাই শিশুসহ সব বয়সী লোকদের উচিত দৈনিক বেশি করে ফল খাওয়ার অভ্যাস করা। ভিটামিন-সি ত্বককে মসৃণ করে, দাঁতের মাঢ়িকে মজবুত করে ও সর্দি কাশি থেকে রক্ষা করে। এছাড়া রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। ভিটামিন-সি রান্নার তাপে প্রায় ৮০% নষ্ট হয়ে যায়। ফল সরাসরি খাওয়া হয় বলে ভিটামিন-সি নষ্ট হয় না। ফল বিশেষ করে টক জাতীয় ফল ভিটামিন-সি’র রাজা। আমলকী ও অরবরই ভিটামিন-সি’র গুদাম ঘর। ভিটামিন-সি দৈনিক খেতে হয়। খাদ্যোপযোগী প্রতি ১০০ গ্রাম আমলকীতে ভিটামিন-সি থাকে ৪৬৩ মিলিগ্রাম আর অরবরইয়ে আছে ৪৬৩ মিলিগ্রাম। লেবুতে ৪৭ মাইক্রোগ্রাম, কমলা লেবুতে ৪০ মাইক্রোগ্রাম, বাতাবি লেবুতে ১০৫ মাইক্রোগ্রাম, আমড়ায় ৯২ মাইক্রোগ্রাম, কামরাঙায়-৬১ মাইক্রোগ্রাম, জামে ৬০ মাইক্রোগ্রাম, জলপাইয়ে ৩৯ মাইক্রোগ্রাম ভিটামিন-সি বিদ্যমান। ভাতের সঙ্গে একটু লেবুর রসেই ভিটামিন-সি’র চাহিদা পূরণ হতে পারে। অন্যগুলো সামান্য একটু খেলেই দৈনন্দিন চাহিদা পূরণ হবে। লৌহ ঘাটতিজনিত রক্তাল্পতার কারণে শিশু, কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়, জ্ঞান বিকাশ কমে যায়।
গর্ভকালীন রক্ত স্বল্পতার কারণে প্রসব-উত্তর রক্তক্ষরণের সময় মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। এ ক্ষেত্রে ফলের অবদান যথেষ্ট। বিশেষ করে কালো জাম, খেঁজুর, কাঁচকলা, পাকা তেঁতুল, তরমুজ লৌহ ঘাটতি পূরণে সহায়ক। ডায়রিয়া ও পেটের পীড়ায় ডাবের বিশুদ্ধ পানি খুবই উপকারী। এতে আছে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও ফসফরাসের মতো পুষ্টিকর উপাদান। ঘন ঘন পাতলা পায়খানা ও বমির ফলে দেহে যে পানির অভাব হয় সে ক্ষেত্রে গ্লুকোজ স্যালাইনের বিকল্প হিসেবে ডাবের পানি অতুলনীয়। দৈনিক ডাবের পানি ডায়াবেটিস রোগীর জন্যও হিতকর।

ভিটামিন-বি২ এর অভাবে মুখের কোণে ও ঠোঁটে ঘা হয়, ত্বকের স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা নষ্ট হয়। এছাড়া নাকের দুইপাশে চর্মরোগ হয়। এসবের অভাব পূরণে ফল চমৎকার কাজ করে। কাঁঠাল, লটকন, ডেউয়া, আতা, শরীফা ও অন্যান্য ফল ভিটামিন-বি২ এর অভাব পূরণে সহায়ক। এসব ফল বেশি বেশি খাওয়া দরকার।

দৈনন্দিন ফল প্রাপ্তির সীমাবদ্ধতা ও করণীয়
বাংলাদেশে প্রায় ১৩০ রকম ফলের সন্ধান পাওয়া গেছে। তার মধ্যে প্রায় ৭০ রকম প্রচলিত ও অপ্রচলিত ফলের ভাণ্ডার রয়েছে। এসব ফল সারা বছর সমান হারে পাওয়া যায় না। বৈশাখ থেকে শ্রাবণ-এ ৪ মাসে ৫৪% ফলের প্রাচুর্য দেখা যায়। বাকি ৮ মাসে পাওয়া যায় মাত্র ৪৬% ফল। আবার জ্যৈষ্ঠে অর্থাৎ মধুমাসে ১৪% ও আষাঢ় মাসে ১৭% ফল উৎপন্ন হয়। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের ৩১% ফল পাওয়া যায় এ দুইমাসে। তাই বছরের বেশিরভাগ সময়ই আমরা দেশি ফল খেতে পাই না।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলো প্রতি নজর দিতে পারি :
১. ভর মৌসুমে আম, লিচু, পেয়ারা, আনারস পচে বিনষ্ট হয়। আমের জুস, আমসত্ত্ব, মোরব্বা, চাটনি তৈরি করে সংরক্ষণ করা যায়। আনারস টিনজাত করে রাখা যায়। পেয়ারার জ্যাম, জেলি, আমড়ার জেলি, তালের জ্যাম, জামের স্কোয়াশ, কুল থেকে আচার, চাটনি, পেঁপের জুস তৈরি করে সংরক্ষণ করলে পরবর্তীতে অমৌসুমে খাওয়া যায়।
২. সারা বছর যাতে আম, লিচু, কাঁঠাল, কুল, আনারস ও অন্যান্য ফল পাওয়া যায় সেজন্য বারোমাসি জাত উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা জোরদার করা দরকার।
৩. এরই মধ্যে বারোমাসি আমড়া, বারোমাসী কামরাঙার প্রচলন হয়েছে। এগুলোর চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা দরকার।
৪. কলা, পেঁপে, নারিকেল সারা বছরই জন্মে। তাই এগুলোর আবাদ ব্যাপক সম্প্রসারণ করা দরকার।
৫. আজকাল বসতবাড়িতেও বনজ গাছ দেখা যায়। বনজ গাছ দ্রুত বর্ধনশীল। এগুলো ফলগাছের ওপর ছায়া বিস্তার করে যা ফল গাছের জন্য যম স্বরূপ। এতে ফলের উৎপাদন হ্রাস পাচ্ছে। এ অবস্থায় গ্রাম বাংলার প্রতিটি বসতবাড়িতে শুধু ফল চাষ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তাহলে ফল গাছ থেকে আমরা পাবো খাদ্য, পুষ্টি, অর্থ ও সুন্দর পরিবেশ। এভাবে গড়ে উঠুক সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।