ফসলের জমিতে কীটনাশক কাজ না করার কারণ ও করণীয়

0
337

কীটনাশক ব্যবহারক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমন সবজি ফসল উৎপাদনে একটি বড় সমস্যা। সবজি ফসলের ক্ষেত্রে ৩০ থেকে ৫২ ভাগ পর্যন্ত পোকামাকড়ের কারণে ক্ষতি হয়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষনা ইনস্টিটিউট এর তথ্যমতে প্রতিবছর ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমনে সবজি ফসলের ২৫ ভাগ এবং ফলের ক্ষেত্রে ৩০ ভাগ ক্ষতি হয়ে থাকে। এছাড়াও ফসলের গুনগতমান ও বাজারমূল্য কমিয়ে দেয়। বাংলাদেশে সবজি ফসলের ক্ষতিকর পোকাগুলোর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ক্যাটারপিলার, বোরার, ফ্রুট ফ্লাই, এপিড, হোয়াইট ফ্লাই প্রভূতি প্রধান। এদেশে উচ্চ তাপমাত্রা ও আদ্রতা এসব পোকামাকড়ের বংশবৃদ্ধি ও বিচরনের জন্য খুবই সহায়ক।

কৃষকদের সাম্প্রতিক সমস্যা
আমাদের দশের কৃষকরা এসব পোকামাকড় দমনের জন্য প্রায় সম্পূর্নভাবে রাসায়নিক কীটনাশকের উপর নির্ভরশীল। যার দরুন গত এক দশকে রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। ১৯৯৭ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে ৩২৮ ভাগ। যদিও বালাইনাশকের শতকরা ৮০ ভাগ ব্যবহার হয় ধান উতপাদনে তথাপিও একক জমিতে সবচেয়ে বেশী পরিমান রাসায়নিক বালাইনাশক ব্যবহার হয় শাক সবজি উতপাদনে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের কৃষক ভাইদের একটি বড় অভিযোগ হলো তারা কীটনাশক প্রয়োগ করেও এসব পোকামাকড় দমন করতে পারছেন না । যার দরুন একদিকে ফসলের ফলন কমে যাচ্ছে অন্যদিকে ফসল উতপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

কীটনাশক কাজ না করার কারন
কীটনাশক কাজ না করার অনেকগুলো কারন আছে । আমাদেও দেশের কৃষক ভাইয়েরা অনেকটা সেচ্ছাচারীভাবে অতিরিক্ত মাত্রায় কীটনাশক ব্যবহার করে থাকেন। সাত থেকে দশ দিন অন্তর অন্তর কীটনাশক প্রয়োগ করার কথা থাকলেও তারা ক্ষেত্রবিশেষে এক থেকে দুইদিন অন্তর পর্যন্ত কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকেন। একই কীটনাশক মাসের পর মাস ধারাবাহিকভাবে ক্রমাগত একই জমিতে ব্যবহার করেন। অনেক সময় যথাযথ কীটনাশক ব্যবহার করেন না কিংবা একাধিক কীটনাশক একত্রে মিশিয়ে ব্যবহার করেন। এছাড়াও পোকামাকড় দমনে তারা শুধুমাত্র কীটনাশকের উপর নির্ভর করেন। এসব কারনে পোকামাকড়সমূহ ধীরে ধীরে কীটনাশকের প্রতি প্রতিরোধী হয়ে উঠে। তখন কীটনাশক প্রয়োগ করেও আর পোকামাকড় দমন করা যায় না।

সঠিক কীটনাশক নির্বাচনে সমস্যা
সঠিক কীটনাশক নির্বাচনে কৃষকভাইদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতা অনেকাংশে দায়ী। কৃষকদের কীটনাশক নির্বাচনে সবচেয়ে বেশী ভূমিকা রাখেন দেশের বিভিন্ন কীটনাশক কোম্পানীর স্থানীয় প্রতিনিধিরা। তারা অনেকসময় তাদের ব্যবসায়িক মুনাফার জন্য কৃষকদের অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগের জন্য প্রলুদ্ধ করে এবং ভূল কীটনাশক দিয়ে থাকেন। আর এসব ক্ষেত্রে দেশের কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের ব্যর্থতাও কম নয়। তৃনমূল পর্যায়ে কর্মরত কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের কর্মকর্তা ও মাঠকর্মীদের যথাযথ প্রশিক্ষণ না থাকায় তারাও কৃষকদের যথাযথ পরামর্শ দিতে পারেন না।

কীটনাশক প্রয়োগ ও মানব স্বাস্থ্যঝুঁকি
কীটনাশক পোকামাকড়ের জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি মানবস্বাস্থ্যের জন্যও ক্ষতিকর। শাকসবজি, ফলমূল ও ফসলে বিদ্যমান কীটনাশকের রেসিডিও মানবস্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে। সাম্প্রতিক সময়ে ক্যন্সার সহ বিভিন্ন দূরারোগ্য ব্যাধির বিস্তার এবং প্রজনন স্বাস্থের ক্ষতির জন্য এসব কীটনাশকের রেসিডুয়াল ইফেক্ট দায়ী। স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর জন্য নিয়ম হলো কীটনাশক প্রয়োগের ৭-১০ দিন পর ফসল উত্তোলন করা। কিন্তু কৃষকরা কীটনাশক প্রয়োগের ১-২ দিন পরই ফসল সংগ্রহকরে বাজারজাত করে থাকে । এমনও দেখা গেছে সকালে কীটনাশক প্রয়োগ করে বিকালে ফসল বাজারজাত করে থাকে। অজ্ঞতবশতই কৃষকদের কাছে এখানে মানবস্বাস্থ্য বিবেচ্য নয় বরং গুরুত্বপূর্ন হলো মুনাফা আর ভোক্তার সন্তুষ্টি। অন্যদিকে আমাদের ভোক্তাদের আচরনও এখানে বিবেচনায় আনতে হবে। তারা চকচকে এবং দাগমুক্ত ফল ফসল বেশী পছন্দ করে। মনে রাখতে হবে যে সবজি, ফল বা ফসল যত বেশী চকচকে বা দাগমুক্ত সেখানে ততবেশী কীটনাশক প্রয়োগের ঝুঁকি রয়েছে যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

সমস্য উত্তোরনের উপায়
একদিকে ফসল উতপাদন নিশ্চিত করা অন্যদিকে মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষা করতে হবে। এ সমস্য উত্তোরনের একটি উপায় হলো আইপিএম বা সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা। আইপিএম ধারনায় ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন না বলে ব্যবস্থাপনা বলা হয়। এ ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। একইসাথে বিবেচনা করা হয়, ক্ষতিকর পোকামাকড় প্রকৃতিতে ছিল, আছে এবং থাকবে কিন্তু ক্ষতি করতে পারবে না। আইপিএম ব্যবস্থাপনায় এসব ক্ষতিকর পোকামাকড় নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় থাকবে। অর্থাৎ ইকোনোমিক ইনজুরি লেবেল এর নিচে থাকবে। আর পোকামাকড় এর আক্রমনে ফসলের সামান্য কিছু ক্ষতি হতে পারে তবে তাতে উদ্ভিগ্ন হবার কোন কারন নেই। আইপিএম ব্যবস্থাপনায় শুধুমাত্র একটি দমন ব্যবস্থার উপর নির্ভর না করে কতগুলো কার্যকরী দমন ব্যবস্থার মাধ্যমে একটি প্যাকেজ প্রনয়ন করা হয় । এখানে প্রতিকার অপেক্ষা প্রতিরোধকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। আর সর্বশেষ দমন ব্যবস্থা হিসেবে রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ বিবেচনা করা হয়। তবে তা আবশ্যয় নির্দিষ্ট মাত্রায়, নির্দিষ্ট পন্থায় এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে প্রয়োগ করতে হবে। একই কীটনাশক ক্রমাগত ব্যবহার না করে কিছুদিন অন্তর পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে হবে। এক কথায় আইপিএম হলো ক্ষতিকর পোকামাকড় দমনের জন্য পরিবেশবান্ধব, সুসংহত এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রহনযোগ্য একটি পদ্ধতি।

আইপিএম ব্যবস্থাপনা
নিরাপদ ফসল উতপাদনে আইপিএম প্রযুক্তির প্যাকেজে অর্ন্তভূক্ত দমন ব্যবস্থাগুলো হলো রোগ প্রতিরোধী জাত ব্যবহার, যান্ত্রিক দমন, জৈব প্রযুক্তির ব্যবহার, জৈব বালাইনাশক ব্যবহার, উপকারী পোকামাকড়ের ব্যবহার, সেক্স ফেরোমোন ফাঁদ ব্যবহার, পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ পদ্ধতি প্রভৃতি। আইপিএম ব্যবস্থাপনায় রাসায়নিক বালাইনাশকের ব্যবহার কমে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হয়। নিরাপদ শাকসবজি ও ফলমূল উতপাদনের জন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কিছু সবজি জাতীয় ফসলের প্রধান ইনসেক্ট পেস্ট দমনের জন্য আইপিএম প্যাকেজ প্রনয়ন করা হয়েছে।

স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব সবজি উৎপাদনের জন্য আইপিএম প্যাকেজ একটি লাগসই প্রযুক্তি। দিন দিন দেশে এবং দেশের বাহিরে বাংলাদেশের সবজির চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। একই সাথে বাড়ছে নানারকম ক্ষতিকর পোকামাকড়ের আক্রমন। আইপিএম পদ্ধতি ব্যবহার করে ক্ষতিকর পোকামাকড় দমন করা যায় এবং গুনগত মানসপন্ন সবজি উৎপাদন নিশ্চিত করা যায়।