পার্বত্য অঞ্চলের বন নিধন: বাঁশের উৎপাদন কমে যাচ্ছে

0
131

পার্বত্য অঞ্চলের বাঁশেচট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চলে উত্পাদিত বনজ সম্পদের মধ্যে বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ ছোট আকারে হলেও জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। কিন্তু অযাচিতভাবে বন নিধনে এই বনজ সম্পদটি দিন দিন কমে যাচ্ছে। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল কাপ্তাই, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানসহ বিভিন্ন এলাকায় ছয় প্রজাতির বাঁশ উত্পন্ন হয়ে থাকে। এসব বাঁশের মধ্যে রয়েছে মূলি বাঁশ, ডলু বাঁশ, নিতিয়া বাঁশ, ওরা বাঁশ, বাইজ্জা বাঁশ, মাহাল বাঁশ। পার্বত্য অঞ্চলে উত্পাদিত বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ দৈনন্দিন বিভিন্ন কাজ ছাড়াও কর্ণফুলী পেপার মিলে কাগজ উত্পন্নের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকার বাঁশ ব্যবসায়ী কিরণ বাবু বাঁশ উত্পাদন এবং সরবরাহ সম্পর্কে বলেন, আমি প্রায় ৪০ বছর ধরে বাঁশ ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছি। অতীতে যেভাবে বাঁশের ব্যবহার হত বর্তমানে তা হয় না। অতীতে দুর্গম পাহাড় থেকে বাঁশ আনতে অনেক সমস্যা হলেও এখন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে তা সহজ হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলে শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি এবং পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় বাঁশের দাম আগের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে বাইজ্জা বাঁশ প্রতি শ’ ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা। মূল বাঁশ প্রতি হাজার ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। নিতিয়া বাঁশ প্রতি হাজার ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। ডলু বাঁশ প্রতি হাজার ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। কর্ণফুলী পেপার মিলের উপপ্রধান প্রকৌশলী শেখ আহমেদ বলেন, পেপার মিলে উত্পাদিত কাগজের জন্য সব ধরনের বাঁশ ব্যবহূত হয়। এ মিলে প্রতিমাসে পূর্ণ উত্পাদনের সময় সাত থেকে আট হাজার টন বাঁশ লাগে। পার্বত্য অঞ্চলে যেভাবে বন নিধন চলছে তাতে বাঁশের উত্পাদন কমে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।

ক্রমেই সঙ্কুচিত হয়ে আসছে পাহাড়ের বাঁশক্ষেত্র। অথচ এক সময় নিত্যদিনের চাহিদা পূরণের অর্থনীতির যোগান আসতো বাঁশ থেকে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে অর্থ সঞ্চালনের প্রধান উৎস ছিল এই বাঁশ।
তিন পার্বত্য জেলার বাঁশ যেমন দেশব্যপী সমাদৃত; তেমনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ অঞ্চলের ৩৫ শতাংশ মানুষ এই বাঁশ শিল্প, ব্যবসা, পরিবহন ও কর্তনের মাধ্যমে পরিচালিত ব্যবসার ওপর নির্ভরশীল। মাত্র চার দশক আগেও পাহাড়ের বিভিন্ন প্রজাতির প্রাকৃতিক ও সৃজিত বাঁশই ছিল অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। পাহাড়ের বিস্তীর্ণ বাঁশ ক্ষেত্রকে পুঁজি করেই এক সময় গড়ে উঠেছিল কর্ণফুলি পেপার মিল (কেপিএম)। যার ৮০ শতাংশ কাঁচামালের যোগান আসতো বাঁশ থেকে। বর্তমানে বাঁশ কমে যাওয়ায় যেমন কেপিএমএর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অনেকের জীবন-জীবিকা।
‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ, মাগো আমার শোলক বলা কাজলা দিদি কই?’ এমন কবিতা পড়ে আমরা স্মৃতিকাতর হলেও বাস্তবে এখন দেশে বাঁশ বাগান হ্রাস পাচ্ছে। অথচ মানুষের দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত কাজে লাগা সেই বাঁশের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ঘর বানাতে বাঁশের ব্যবহার কিছুটা কমে গেলেও বাঁশ ব্যবহারের ত্রে বেড়েছে দিনে দিনে। এখন বাঁশ দিয়ে আসবাবপত্র থেকে শুরু করে শো পিস পর্যন্ত তৈরি করা হচ্ছে। এসব কুটির শিল্প পণ্যের রপ্তানি চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। কিন্তু অতি প্রয়োজনীয় এই বাঁশের চাষ ও উৎপাদন বাড়েনি। পার্বত্যাঞ্চল এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বাঁশবহুল এলাকা। কিন্তু গবেষণা ও পরিকল্পনার সমন্বয় না থাকায় পাহাড়ের বাঁশ ক্ষেত্রও ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে। বাঁশ নিয়ে চট্টগ্রামে সরকারি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে। কিন্তু তা থেকে স্থানীয় কৃষকরা প্রয়োজনীয় উপদেশ ও সহায়তা পায় না বলে অনেকের অভিযোগ।
বাঁশ পরিবহন ব্যবসার সাথে জড়িত একটি সূত্র জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত বাণিজ্যিকভাবে পরিবেশবান্ধব বাঁশ চাষের প্রচলন না থাকলেও খাগড়াছড়ি জেলার দুই উদ্যমী যুবক বাঁশ চাষের ক্ষেত্রে উদ্ভাবন করেছেন এক নতুন কৌশল। এই কৌশল কাজে লাগিয়ে পার্বত্যাঞ্চলে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাঁশ চাষের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তারা এগুতে পারছেন না।
জানা গেছে, ১৯৬০ সালে কাপ্তাই জল বিদুৎ প্রকল্পের জন্য কৃত্রিম বাঁধ সৃষ্টির পর থেকেই রাঙ্গামাটিবাসীর জীবনে নেমে আসে নানা সঙ্কট। মূলত এরপর থেকেই এ জেলার মানুষ বাঁশ, গাছ ও কাপ্তাই হ্রদের মাছের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। প্রাকৃতিক জঙ্গল ধ্বংস হওয়ায় ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে রাঙ্গামাটি জেলার বাঁশ ত্রে। মাত্র ১৫-২০ বছর আগেও প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা বাঁশ বাগানের যে সমাহার দেখা যেতো; বনাঞ্চল উজাড় করার ফলে বর্তমানে সেসব বাঁশ বাগানও তেমন একটা চোখে পড়ে না।
গবেষকরা জানিয়েছেন, ভূ-প্রাকৃতিক কারণেই পার্বত্যাঞ্চলের মাটি, পানি আর আবহাওয়া বাঁশ চাষের জন্য উপযোগী, এদেশে বাঁশের প্রচুর চাহিদা থাকায় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বাঁশ চাষ করে লাভবান হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনাও রয়েছে। এতে পরিবেশের ভারসাম্যও রা হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩শ’ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে। এর মধ্যে পার্বত্যাঞ্চলে মুলি, বাজালি, রফাই, মৃতিঙ্গাসহ প্রায় ২০ প্রজাতির বাঁশ পাওয়া যায়। প্রয়োজন ভেদে একেক প্রজাতির বাঁশ একেক কাজে লাগে। বিভিন্ন জাতের বাঁশ দিয়ে নানা রকম আসবাবপত্রও তৈরি করা হয়ে থাকে।
বাঁশ নিয়ে গবেষণা কাজে জড়িত মোহসীন আলী জানান, প্রতি এক শ’ বছর পর পর বাঁশে এক ধরনের বিচি হয়। যখন এ বিচি হয় তখন বাঁশ মরতে শুরু করে। এই মড়কের কবলে পড়ে কয়েক বছর আগে এই এলাকায় ব্যাপক হারে বাঁশ মরে যায়। এতে বেশিরভাগ বাঁশ বাগানের বিলুপ্তি ঘটে। তার মতে, বর্তমানে একেবারে দুর্গম অঞ্চলে যে বাঁশ ক্ষেত্রগুলো অবশিষ্ট আছে সেখান থেকে বাঁশ সংগ্রহ করতে কষ্ট আর খরচ দুই-ই বেশি পড়ে যায়। এতে বাঁশ অনেকটা দু®প্রাপ্য বস্তুতে পরিণত হয়েছে।
বিগত ২০০৫ সালে পাহাড়ে মড়কের কারণে বিপুল পরিমাণ বাঁশ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় কর্ণফুলি পেপার মিলে কাঁচামাল সঙ্কট দেখা দিয়েছিল। একথা জানিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম দণি বনবিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, বাঁশ নিয়ে আমরা নতুন পরিকল্পনা হাতে নেয়ার চেষ্টা করছি, আশা করি সহসা এ ব্যাপারে প্রকল্প হাতে নেয়া হবে।
‘বাঁশ যেমন অতি প্রয়োজনীয় গাছ তেমনি এর ব্যবহারও বহুবিধ। এখন পর্যন্ত দেশের মোট জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ বাঁশ সংগ্রহ থেকে শুরু করে, বাজারজাতকরণ, কারিগরি এবং বাঁশ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। কাজেই এই উদ্ভিদ যেমন বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন তেমনি এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে প্রয়োজন প্রচুর গবেষণা ও পরিকল্পিত বাঁশ চাষ। পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচতে এবং পরিবেশবান্ধব বাঁশ চাষের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে যেমন ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, তেমনি বাঁশ শিল্পের মাধ্যমে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে’ বলে মত প্রকাশ করেছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম বাঁশ গবেণা কেন্দ্রের কর্মকর্তা। তিনি জানান, শুধু উৎপাদন নয় বিভিন্ন কাজে লাগানো বাঁশের স্থায়িত্ব (টেকসই) বৃদ্ধির বিষয়েও গবেষণা করছেন তারা।