‘বাংলাদেশের সংসদ অকার্যকর’ সিপিডি

0
87

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক সক্ষমতা প্রতিবেদন-২০১৪’ প্রকাশ করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নৈতিকতা অত্যন্ত নিম্নমানের। সরকার পরিচালনায়
তাদের দক্ষতা খুবই নগণ্য। আইন প্রণয়নকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে জাতীয় সংসদও অকার্যকর। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের প্রতি জনগণের আস্থা নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের সব ক্ষেত্রই দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে। সরকারের রাজস্ব ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এছাড়া, সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সহযোগিতাপূর্ণ সম্পর্কও নেই। বৈশ্বিক সক্ষমতায় বাংলাদেশ এক ধাপ এগিয়ে যাওয়ার তথ্য দিয়ে বলা হয়েছেন দুর্নীতির কারণে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা থেকে প্রকাশিত বুধবারের বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন নিয়ে গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে এক আলোচনার আয়োজন করে সিপিডি। এতে প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন সংস্থাটির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডি’র ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য সৈয়দ মঞ্জুর এলাহীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু। আলোচনায় অংশ নেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক ড. মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি একে আজাদসহ বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। শিল্পমন্ত্রী তার বক্তব্যের সময় প্রতিবেদনের কড়া সমালোচনা করে বলেন, বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদনে এ দেশের রাজনীতিবিদদের নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে- আমি এর সঙ্গে একমত নই। তিনি বলেন, রাজনীতি না থাকলে দেশে কিছুই থাকবে না। তাই রাজনীতিবিদদের সমালোচনার সীমা থাকা উচিত। নতুবা রাজনীতির বাইরে অন্যরা সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আস্থাহীনতা সৃষ্টি হলে দেশের জন্য তা কখনওই মঙ্গল বয়ে আনবে না। এজন্য রাজনীতিবিদদের বিষয়ে সমালোচনা করার ক্ষেত্রে একটা সীমা থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। পরে সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকারই যেখানে অনির্বাচিত সেখানে জবাবদিহি থাকতে পারে না। কানাডায় পদ্মা সেতু নিয়ে মামলা চললেও দুদক সবাইকে অব্যাহতি দেয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। অথচ মন্ত্রী বললেন, দুদক স্বচ্ছভাবে কাজ করছে। তিনি মন্ত্রীর বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেন, পদ্মায় যে দুর্নীতি হয়েছে তা ছিল সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। তিনি বলেন, সারাজীবন শুনে এসেছি সমালোচনা ছাড়া রাজনীতি হতে পারে না। কিন্তু বর্তমান সরকার বলছে সমালোচনার ক্ষেত্রে সীমা থাকতে হবে। আমীর খসরু বলেন, দুদক পদ্মায় কোন দুর্নীতির কোন প্রমাণ পায়নি, এটা অনেক বড় ইস্যু। অবশ্য আজ যদি সবার অংশগ্রহণমূলক সংসদ থাকতো, তাহলে এই ইস্যু নিয়ে রাজনীতির মাঠে ঝড় উঠতো। তিনি বলেন, অবৈধ সরকার দেশ পরিচালনা করছে। আমলা হিসেবে যাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের কেউ কারও কথা শুনছেন না। তারা কেউ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের কোন জবাবদিহি নেই। যেখানে অবৈধভাবে সরকার গঠন করা হয়েছে, সেখানে কেন তারা কারও কথা শুনবেন? প্রতিবেদনে জাতীয় সংসদকে অকার্যকর বলা হয়েছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, যেখানে নির্বাচন ছাড়াই সংসদ গঠন হয়, সেখানে কার্যকর হয় কিভাবে?
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্ব অর্থনৈতিক সক্ষমতা সূচকে বাংলাদেশের ১১০ থেকে ১০৯-এ উঠে এসেছে। অর্থনৈতিক সক্ষমতা সূচকে ১২টি ক্যাটিগরি রয়েছে। এর মধ্যে ২০১৪ সালে ৭টিতে উন্নতি আর ৫টিতে অবনতি হয়েছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশ যে সব উপ-সূচকে উন্নয়ন করে তা হলো- অবকাঠামো উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৭তম আর স্কোর ৩, সামগ্রিক অর্থনীতি পরিবেশ উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম আর স্কোর ৪.৭, উচ্চ শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৫তম আর স্কোর ২.৯, পণ্য বাজারজাতের দক্ষতা উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৮৪তম আর স্কোর ৪.২, আর্থিক বাজার উন্নয়ন উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৭২তম আর স্কোর ৪.৭, বাজারের ধরন উপ-সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম আর স্কোর ৪.৫ এবং উদ্ভাবনে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম আর স্কোর ২.৬। অবনমন হওয়া উপ-সূচকগুলো হচ্ছে- প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, শ্রম বাজারের দক্ষতা, প্রযুক্তিগত প্রত্যুপন্নতা এবং ব্যবসায়িক উৎপাদনশীলতা (বিজনেস সফস্টিকেশন)। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা অবকাঠামোতে পর্যাপ্ত সরবরাহের সমস্যা, দুর্নীতি, সরকারের আমলাতন্ত্রিক সমস্যা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অবস্থান গত কয়েক বছর একই স্থানে ঘুরছে উল্লেখ করে সিপিডি জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ধারাবাহিকভাবে অগ্রগতির দিকে গেলেও বাংলাদেশ অনেক বিষয়ে কোন পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারছে না। অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতি প্রতিরোধ, আস্থাশীল প্রশাসন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, অর্থনৈতিক অবস্থান, শ্রম বাজার, চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য, কর ব্যবস্থা, নতুন উদ্যোক্তা তৈরিসহ বেশ কিছু বিষয়ে একই অবস্থানে রয়েছে। প্রযুক্তির ব্যবহার কিছুটা বাড়লেও তা দেশের অর্থনৈতিক সূচক অগ্রগতিতে তেমন প্রভাব ফেলছে না। প্রতিবেদনে প্রশাসনিক আস্থাহীনতার মধ্যে সঠিক আইন প্রণয়নের জন্য কার্যকর সংসদ না থাকা, বিনিয়োগবান্ধব উদ্যোগ ও যথাযথ ট্যাক্স পদ্ধতি না থাকা, দুর্নীতি প্রতিরোধের প্রতিষ্ঠানগুলো সঠিকভাবে কাজ না করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে যোগ্যতাসম্পন্ন লোক না থাকাসহ বেশ কয়েকটি দুর্বলতা তুলে ধরা হয়। অবকাঠামো উন্নয়নের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি, শ্রমমানের উন্নতি, বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি, নারীর জীবন মানের উন্নয়ন, মানবসম্পদ উন্নয়নের কিছুটা দুর্বল দিক তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনে সক্ষমতা সূচকে এক ধাপ এগোলেও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও ভুটানের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। তবে পাকিস্তানের চাইতে এক ধাপ এগিয়ে রয়েছে। ১৪৪টি দেশের মধ্যে এই জরিপ পরিচালনা করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম। বাংলাদেশের পক্ষে এতে সহযোগিতা করে সিপিডি।
সিপিডি জানায়, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী উদ্যোক্তার মতামতের উপর ভিত্তি করে এ জরিপটি পরিচালনা করা হয়। এতে ৪৮ ভাগ ব্যবসায়ী মনে করেন দেশের ব্যবসায়ীক পরিবেশ বর্তমানে ভালো রয়েছে। তবে ব্যবসার উন্নয়নে কিছু ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নকারী হিসেবে সংসদের ভূমিকা খারাপ থেকে আরও খারাপ হয়েছে। ব্যবসায়ীক দৃষ্টিকোণ থেকে রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার মান খারাপ থেকে আরও খারাপ বা নিকৃষ্ট হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ২০১৩ সালে ৮৭ ভাগ উত্তরদাতা খারাপ বললেও এ বছর ৯৪ ভাগ উত্তরদাতা বলেছেন রাজনীতিবিদদের নৈতিকতার মান খারাপ।
গত কয়েক বছরের মতো এবারও তালিকার শীর্ষে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। আর দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর, তৃতীয় যুক্তরাষ্ট্র, চতুর্থ ফিনল্যান্ড এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে জার্মান। এশিয়ার অন্যতম দেশ জাপান ও হংকং রয়েছে যথাক্রমে ৬ ও ৭ এ। এদের পরেই অষ্টম স্থানে রয়েছে ইউরোপের অন্যতম পরাশক্তিধর দেশ যুক্তরাজ্য। এশিয়ার বৃহত্তম দেশ চীনের অবস্থান ২৮ এ এবং থাইল্যান্ড ও ইন্দোনেশিয়া রয়েছে যথাক্রমে ৩১ ও ৩৪তম স্থানে। এদিকে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত ১১ ধাপ নিচে নেমে ৭১তম স্থানে চলে গেছে। আর ভারতের দুই ধাপ নিচে রয়েছে শ্রীলঙ্কা। ২০০৫ সাল থেকে নিয়মিত এই রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে সংস্থাটি। আর্থিক প্রতিষ্ঠান, অবকাঠামো, অর্থনৈতিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও প্রাথমিক শিক্ষা, উচ্চ শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, পণ্য বাজারের দক্ষতা, শ্রমবাজার, আর্থিক বাজার উন্নয়ন, শ্রযুক্তি, বাজারের আকার, ব্যবসা এবং উদ্ভাবনের ওপর নির্ভর করে তারা এই তালিকা তৈরি করে থাকে।