বাংলাদেশে মৎস সম্পদ সংরক্ষণ

0
124

ড. মুহাম্মদ মাহফুজুল হক রিপন:
অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর মধ্যে মত্স্য সম্পদ সংরক্ষণের গুরুত্ব বেশ আলোচিত। হালদা খাগড়াছড়ির রামগড় উপজেলার হালদাছড়া থেকে উত্পত্তি লাভ করে ৮৮ কিলোমিটার বাহিত হয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে কর্ণফুলি নদীতে মিলিত হয়েছে। বছর কয়েক আগে হালদা ও এর শাখা নদীতে সেচ প্রকল্পের আওতায় দুটি রাবার ড্যাম তৈরি করা

হয়েছে। কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ইত্যাদি) মাছের একমাত্র প্রাকৃতিক প্রজনন ক্ষেত্র হালদার উপর রাবার ড্যামের প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। গবেষণা মতে রাবার ড্যামের প্রভাবে হালদা নদীতে নিরবিচ্ছিন্ন পানি প্রবাহ কমে যাওয়ায় মাছের চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে এবং মাছের খাদ্য প্লাংটনের পরিমাণ কমে গেছে আশঙ্কাজনক হারে। প্লাংটনে যে পুষ্টি উপাদান থাকে তা ব্রুড-মাছের (পিতা-মাতা মাছ) প্রজননের পরিপক্বতা অর্জনে অপরিহার্য। রাবার ড্যাম তৈরির পরবর্তী বছর ২০১৪, ২০১৫ ও ২০১৬ সালে উত্পাদিত রেণুর পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৭৫, ৪৭ ও ১২ কেজি। এ লেখাটি লেখার সময় হালদায় রেণু সংগ্রহের খবর আসছিল কিন্তু এবারও রেণুর পরিমাণ কম। ক্রমহ্রাসমান এ ধারা দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মত্স্য প্রজনন ক্ষেত্রের জন্য অশনি সংকেত। অন্যদিকে হাওরে ফ্লাস-ফ্লাডের কারণে এ সময়ে মাছের মহামারী হচ্ছে, যার প্রকৃত কারণ স্পষ্ট নয় কিন্তু মত্স্য সম্পদের ক্ষতির বিষয়টি দৃশ্যমান।

নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীগুলোর করুণ দশার কারণে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির ৩৬% মাছ নানা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে, মুক্ত জলাশয় অর্থাত্ ফিশারিজ থেকে মাছের উত্পাদন কমে গেছে। বর্ধিত জনসংখ্যার বিপুল পরিমাণ মাছের চাহিদা পূরণে চাষকৃত অর্থাত্ একোয়াকালচারের মাধ্যমে উত্পাদিত মাছের উপর নির্ভরশীলতা দিন দিন বাড়ছে। বিগত ২০১৪-২০১৫ সালে বাংলাদেশের মোট মত্স্য উত্পাদন ছিল ৩৬.৮৪ লক্ষ মেট্রিক টন যার ৫৬% উত্পাদিত হয় একোয়াকালচার থেকে। মোট একোয়াকালচার উত্পাদনের সিংহভাগ আসে কার্প জাতীয় মাছ থেকে। মাছে-ভাতে বাঙালির প্রাণিজ আমিষের ৬০% যোগান দেয় মাছ। প্রাপ্ত বয়স্ক ৭০ কেজি ওজনের একজন মানুষের ১২ কেজি হলো প্রোটিন, এর ৬০% অর্থাত্ ৭.২ কেজি প্রোটিন আসে মাছ থেকে। যেহেতু মাছের প্রধান সরবরাহ একোয়াকালচার থেকে সেহেতু দেশের কর্মক্ষম জনশক্তি তৈরিতে একোয়াকালচারের উপর নির্ভরশীলতা এখন ভাবনার বিষয়।

বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে একোয়াকালচারের ব্যাপক প্রসার হয়েছে, জীবিকার জন্য এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। একোয়াকালচারের প্রধান নিয়ামক হলো গুণগতমানের পোনার সহজলভ্যতা। তিন দশক আগে নদী থেকে মাছের পোনা সংগ্রহ করা যেত, নদীর বেহাল দশার কারণে মত্স্য হ্যাচারিই এখন পোনার একমাত্র উত্স। দেশে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন হ্যাচারির সংখ্যা যথাক্রমে ১৩৬ ও ৮৬৮টি। ব্যক্তিমালিকানাধীন হ্যাচারির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এবং পোনা উত্পাদনে মুখ্য ভূমিকা রাখছে। হ্যাচারি নির্ভর পোনা উত্পাদনের মূল চাবিকাঠি হলো গুণগতমানের ব্রুড-মাছ, যার একমাত্র উত্স ছিল বড় বড় নদীগুলো। নদীর ইকোলজিক্যাল বিপর্যয়ের কারণে মত্স্য হ্যাচারিগুলো গুণগতমানের ব্রুড-মাছ পাচ্ছে না, ফলে ব্যাহত হচ্ছে মানসম্মত পোনা উত্পাদন এবং বাণিজ্যিক মত্স্য চাষ। নদীমাতৃক বাংলাদেশে প্রাকৃতিক জলাশয় মত্স্যহীন হয়ে যাবে এটি অবিশ্বাস্য হলেও এখন চরম বাস্তবতা। এমন সময় হয়ত আসবে যখন হ্যাচারির জন্য বিদেশ থেকে ব্রুড-মাছ আমদানি করতে যেয়ে বাংলাদেশ বায়োপাইরেসি অ্যাক্টের মত আন্তর্জাতিক আইনি সমস্যার সম্মুখীন হবে।

আন্তঃসীমান্ত ও অভ্যন্তরীণ নদীর বিপর্যস্থ অবস্থায় আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন জলসম্পদ নিয়ে মত্স্য সংরক্ষণের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। সংরক্ষিত জলাশয়ে মত্স্য অধিদপ্তর, মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান মত্স্য বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, গবেষণা ও উন্নয়নে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। এ কাজটি শুরু হতে পারে হালদা থেকে যেখানে এখনো মাছের আসল (original) ও বলিষ্ঠ (vigor) জাত রয়ে গেছে। হালদা এলাকায় অতি সেচনির্ভর ধানের বিকল্প হিসেবে স্বল্প সেচনির্ভর কৃষি যেমন সবজি, মশলা, ফুল ও ফলের আবাদ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারলে খাদ্য বৈচিত্র্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে নদীমাতৃক বাংলাদেশ।

n লেখক :প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, একোয়াকালচার বিভাগ, মাত্স্য বিজ্ঞান অনুষদ

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ