বাংলার প্রকৃতিতে এসেছে হেমন্ত

0
219

হেমন্তের মাঠ থেকে কৃষকরা ঘরে তোলে নতুন ফসল। বালিহাঁস নামে পড়ে থাকা ধান খুটে খুটে খাওয়ার লোভে। রাখালেরা গরু-মহিষের পাল ছেড়ে দিয়ে মেতে ওঠে ডাঙগুলি-গোল্লাছুট খেলায়। সমস্ত মাঠ ছাপিয়ে সোনার ধানের আভা শেষ বিকেলে পশ্চিম আকাশকে পর্যন্ত রাঙিয়ে দেয়। মানুষের মনে আনন্দ আর ধরে না।
%e0%a6%b9%e0%a7%87%e0%a6%ae%e0%a6%a8%e0%a7%8d%e0%a6%a4-%e0%a6%95%e0%a6%be%e0%a6%b2
কোথাও কি একটা পাখি ডাকলÑ মহুয়া বনের ছায়ার ঢেউ তোলা বিকেল বেলায়। রৌদ্রের ফিন্কি চুঁয়ে সারা বনে কি তখন ছড়িয়ে পড়েছিল ওই পাখিটার মিষ্টি আর মিহিন কলস্বর। হেমন্তের ছবিটাও প্রকৃতিতে এমনি করেই ছড়িয়ে পড়ে। বাংলার আবহমান নৈসর্গিকতার পালে হেমন্তের উন্মনা হাওয়ার স্রোত এভাবেই বয়ে যায় দিগি¦দিকে সব পাশে সরিয়ে।

শরতের রুপোঝুড়ি ঝালরের কার্নিশে কখন যে এসে বসেছে হেমন্ত বুকে জ্বেলে হলুদ বর্ণের ভোর। টেরই পায়নি কেউ। যখন উঠল বেজে উঠোনে, দাওয়ায়, দহলিজে হেমন্তের কর্নেটÑ কী যে ভালো লাগা, কী যে আনন্দ পড়ল ছড়িয়ে দিগন্তে! হেমন্ত এমনই। বাংলার হেমন্তের রূপ যে কী জাদুকরী, কী মনোলোভা আর মন ভোলানোÑ বলে শেষ করা যাবে না। কার্তিক আর অগ্রহায়ণ এই দুই মাসের ভেতর দিয়ে যায় বয়ে হেমন্তের বাঁকফেরা নদী। নদীর স্বর্ণালি চরে চরে কিশোরের দঙ্গল, ভোকাট্টা ঘুড়ির পেছনে উন্মাতাল দৌড়। নদীর কোল ঘেঁষে সবুজ বুনো ঝোপে ঝোপে পতঙ্গের খুনসুটি। একটি কি দু’টি ফুলও যায় ঝরেÑ টুপ করে ঘাসের কার্পেটে। আর যায় ভেসে ডিঙি নাও, বেদেনৌকোর বহর। বর্ষার ঘোর শরতেও থাকে লেগে। তারপর হেমন্তের রেশমি দুপুর এসে সেই লেগে থাকা বর্ষা ও শরতের রুপালি জলের চিবুকে রাখে তার রৌদ্রাঙ্কিত মরমি আঙুল। চার পাশে হেমন্তের এই হুলস্থূল করা আবেশ এই বাংলা ছাড়া আর কোথাও কি দেখা মেলে। নদীর বাঁধানো ঘাটের থুঁত্নিতে ঝরন্ত শিশির কুয়াশা থাকে বসে ভেজা সন্ধ্যায়। রাত্তিরে বনে-বাদাড়ে জ্যোৎ¯œার ঘেরাটোপ ফুঁড়ে উড়ে যায় রাতভর নিশুতি পাখির ধূ-ধূ গা ছমছম করা ভুতুড়ে শব্দরাজি। তারপর ঝাপসা আকাশে খুব ভোরবেলা ছড়ায় হেমন্ত সোনামুখী রোদ। আর রোদের টাওয়েলে থাকে জড়িয়ে সেগুন, দেবদারু, শিরীষের গলার ভাঁজের মায়াবী শবনম।
মাঠে-মাঠে হেমন্তের বাওকুড়ানি ঘূর্ণির পলকা টানে থামে চঞ্চল কিশোরীর মতো উচ্ছ্বল দিনের মসলিন। হেমন্তের রূপৈশ্বর্য্যরে খ্যাতি সব ঋতুকে যায় ছাপিয়ে। যেন কোনো নবীনা কনেবউয়ের নতুন মুখের মতো উজ্জ্বল আভা ছড়িয়ে কানে ঝুমকো, নাকে নাকফুল, গলায় নীলাম্বরী হাড়, মাথায় সিঁথিপাটি, কোমরে বিছার ঝলকানি, বাহুতে বাজুবন্ধ আর পদযুগলে পরে সোনার নূপুর হেমন্ত নাইওর এসেছে। আর এসেই রাঙিয়ে দিয়েছে বাংলার মন তার বর্ণোজ্জ্বল রঙে। পথে পথে দমকা বাতাসে ভাসে হেমন্তের ধুলো। কিছু ফুলও থাকে পড়ে হেমন্তের নির্জন ব্যালকনিতে। কিছু ঝরাপাতা। কাঁঠালিচাঁপার গন্ধে যায় ডুবে সারাটা দুপুর। ঘুঘু ডাকা নিঝুম বিকেল। সন্ধ্যার ঘন কালো পনিটেল থেকে দু-একটা তারাও যায় খসে।
চাঁদের আলোর মিহি রিমুভারে ঘষে কখনোই যায় না মোছা হেমন্তের দাগ। থাক, এবার তো থামো-নামো হেমন্তের হিলস্টেশনে। গুড্স ট্রেনে, লোকোমোটিভের ঘাড়ে ও গলায় হেমন্ত মধুরÑ বৃষ্টি কী এক অদ্ভুত দৃশ্যের অবতারণা করেÑ তা শুধু এই বাংলার চার দিকে চোখ রাখলেই প্রত্যক্ষ করা যায়।
প্রকৃতিতে যেমন হেমন্তের রয়েছে প্রবল প্রভাব। তেমনি বাংলা সাহিত্য, কবিতা গল্প, কথাশিল্প, চিত্রকলা, নাটক, সিনেমা, গানেও হেমন্তের স্বর্ণোজ্জ্বল প্রভাবের ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। অনন্তকাল ধরে বাঙালি সংস্কৃতি, কৃষিপ্রধান এই বাংলার মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, নদী, বিল, হাওর, বাঁওড়, বন-অরণ্য গ্রামে ও শহরে হেমন্তের ছোঁয়া রচনা করে এক অনাবিল সৌন্দর্যমুগ্ধ চিত্রবীথি। রচিত হয় শব্দ, অক্ষরপুঞ্জে হৃদয়স্পর্শী অজস্র পঙ্ক্তিমালা। ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,/হেমন্তের মাঠে মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল,/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশপাতা মরাঘাসÑ আকাশের তারা! বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এভাবেই হেমন্তকে কবিতার আর্শিতে প্রতিবিম্বিত করেছেন এক অনন্য রূপকল্প আর স্বপ্ন ও বাস্তব জগতের বিচিত্র বর্ণের মনোলোভা রূপে। কবিতার বাইরে যে হেমন্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে উদ্ভাসিত তাকে কল্পনায় সেভাবে ছুঁয়ে দেয়া যায় তার থেকেও মনোহর আবেশে উপলব্ধি করা যায় খুব ভোরে যখন দূরদিগন্তে ধূ-ধূ কুয়াশার নেকাব সরিয়ে আরক্ত সূর্যের আভা নীলিমার জংশনে এসে দাঁড়ায় গহিন দীর্ঘ এক লাল ট্রেনের মতোÑ তখন।
শিশির আর ধুলোডোবা পথে চাষি আর রাখালের গরুর পাল নিয়ে ক্ষেত আর মাঠে যাওয়ার যে দৃশ্য হেমন্তের রৌদ্রাঙ্কিত সকালের ক্যানভাসে ফুটে ওঠে তা কেবল এই ষড়ঋতুময় বাংলায়ই প্রত্যক্ষ করা যায়। কার্তিক কিংবা অঘ্রাণের দুপুরে হেমন্ত যেরূপে আবির্ভূত হয়Ñ অপরাহ্ণে তার রূপটা যেন আরো মোহনীয় আর মায়াবী মুগ্ধতায় স্ফুরিত হয়ে ওঠে। আর সন্ধ্যায় নারিকেল পাতার ঝালরের ফিনকি গলিয়ে হেমন্তের গোল-চাঁদের মণিরতœ এসে ছড়িয়ে পড়ে এই মৃত্তিকায়, ঘাসে, পথের ধুলোয়। রাত যত গভীর হয়Ñ হিম হিম মৃদু বাতাসের আঙুল যেন পিয়ানোর রিডের মতো মেঘশিরিষের সবুজ খাঁজকাটা পত্রপল্লবে তোলে এক অপূর্ব গুঞ্জরণÑ সোনারঙ চাঁদের কিরণ আরো ঘন আর গাঢ় হয়ে নিসর্গকে রাঙিয়ে তোলে, যা শুধুই এই হেমন্তের রাত্রিকালেই অনুভব করা যায়। আর নিশুতি রাতের গভীর স্তব্ধতা ছিন্ন করে দিয়ে ডেকে ওঠা পেঁচার ডাক, বাদুড়ের ডানা ঝাপটানির শব্দ গ্রাম বাংলার আদি হৈমন্তি আবহটাকেই ফুটিয়ে তোলে নিগূঢ়ভাবে। একই অঙ্গে অনেক রূপের বর্ণ ধারণ করে হেমন্ত বাংলার গ্রামে-গ্রামে যে রঙ ছড়িয়ে দেয় তার তুলনা কেবল হেমন্তের সাথেই চলে।
হেমন্ত এলেই এই বাংলার মাঠে-প্রান্তরে এক হলুদ রঙের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপট তার অমোঘ বিশালতায় রেশমি পালক ছড়িয়ে দেয়। হলদে ধানের ক্ষেতে হাওয়ার দাপাদাপি এক চিরায়ত নৃত্যপরা বাংলার কৃষি ঐতিহ্যকে চোখের সামনে ফুটিয়ে তোলে। তারপর শুরু হয় ধান কাটা। ধানের আঁটি গরু আর মোষের গাড়িতে কৃষকের বাড়ি বয়ে নিয়ে যেতে যেতে গাড়োয়ানের কণ্ঠে উৎসারিত হয় যে ভাওয়াইয়া সঙ্গীত আর বাঁশির সুরের এক পাগল করা, হৃদয় নিংড়ানো সুরমূর্ছনা; তার ছবিটা এই বাংলা ছাড়া কোথাও কি খুঁজে পাওয়া যায়! উঠোনের এক পাশে ধানের আঁটির স্তূপ থেকে থোকা-থোকা ধানের আঁটি খুলে ধান খসিয়ে নিয়ে রাতভর উনুনে সিদ্ধ করার যে দৃশ্যাবলি, কৃষাণীদের অবিশ্রান্ত ব্যস্ততা আর নতুন ধানের ম-ম গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে ওঠার নৈসর্গিক পরিবেশকে হেমন্তের এক অনাবিল অবগাহন ছাড়া অন্য কিছু কি বলা যায়! ধান শুকিয়ে ঢেঁকি অথবা কলে ধান ভাঙানোর পর নতুন চালের সুমিষ্ট-¯িœগ্ধ ঘ্রাণ শরীরে মেখে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটি প্রহরে বাংলার চিরন্তন প্রতিচ্ছায়াটা ঘুর ঘুর করে বেড়ায় যেন এই বাংলারই জল, হাওয়া আর মাটির মনোভূমে।
এ ছাড়া নতুন চাল ঘরে এলেই কৃষকের মুখে যে হাসি অবারিত হয়-তাতে যে প্রাণের স্পন্দন খুঁজে পাওয়া যায় তাকে ফ্রেমে ধরে রাখলেও যেন সেই স্পন্দনের শব্দ অনুরণিত হবে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। নতুন চালের ভাত, পাশাপাশি ‘আগুনি’ চালের ক্ষির পায়েস পিঠা কৃষকের ঘরে ঘরে তৈরি হবেÑ যার সাথে মিশে থাকবে কোমল এক আনন্দোচ্ছ্বাস।
‘বিশ্বখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান তার আঁকা অসংখ্য ছবিতে বাংলার এই কৃষক, হেমন্ত, অঘ্রাণের রূপটাকেই মহিমান্বিত রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন গভীর মমতায়। হেমন্তের আবহে যেমন ¯িœগ্ধ পেলবতার রেশ প্রবহমান, তেমনি হেমন্ত তার অবয়বে গহন উজ্জ্বলতাও বহন করে আসছে অনন্তকাল ধরে। মনকে প্রফুল্ল করে তোলা যেন হেমন্তের এক নিবিড় বৈশিষ্ট্য। যে বৈশিষ্ট্য জীবন যাপনে প্রবলভাবে ছায়া ফেলে। শালিকের খয়েরি রোঁয়ার মতো এক ধরনের বিষণœতাও দানা বাঁধে মর্মে। আর ওই মর্ম থেকেই নিঃসৃত হয় নির্জন অরণ্য স্তব্ধতা। বিজন দ্বিপ্রহরে হেমন্ত-তালচড়ুইয়ের ছায়ার মতো কখনো লাফায় জানলার কার্নিশে, রেলিংয়ে আর দোলনচাঁপার ডালে, জ্যোৎ¯œাঙ্কিত সন্ধ্যায় ফেব্রিকোর নরম তোয়ালের মতো হেমন্ত যেন পুরনো ভাঙা পুকুর ঘাটের সিঁড়ির শ্যাওলা বিজড়িত সবুজ গালিচায় এসে গড়িয়ে যায় জ্যোৎস্নাধারার মতো যেন ঝাউয়ের চূড়োয় একগুচ্ছ কুয়াশার মতো ফুটে আছে হেমন্ত। কখনো-কখনো হেমন্ত ঠিক মেঘের ড্রেসিং টেবিল হয়ে যায়। আর ওই ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ভেসে যায়, নদীর কুলকুল ধ্বনি। আর এক নিঃসঙ্গ মাঠ খুব সন্তর্পণে কেবল হেমন্তে বসে বাজায় তার ধুলো আর ঘাসের পাখোয়াজ। হেমন্ত কি বৃষ্টির মতো ঝরে পড়তে পড়তে সেতার বাজায় কিংবা ভায়োলিন! কাঠের বাড়ির ছায়ার গহনে হেমন্ত বসে রোজকার গল্প বলে! বনে-বনে যেমন হেমন্ত আসে। হেমন্ত আসে এই নগরজীবনেও। কিন্তু নাগরিক জীবনের অপার ব্যস্ততায় হেমন্ত যে কখন এসে মিলিয়ে যায় টেরই পাওয়া যায় না। শিউলিফোটা শরতের প্রহর অতিক্রান্ত হতে-না-হতেই হেমন্ত এসে প্রকৃতির ডোরবেলে তার গুঞ্জরিত আঙুল রাখে। শীতের আগে আগে হেমন্তে অনেকেই একা অথবা সপরিবারে বেড়ানোর ছকও কেটে ফেলে। কেউ-কেউ লংড্রাইভে চলে যায় শহর ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে। গ্রামে তখনো কাশফুলের মৃদু হাতছানি, ধবল বকের ওড়াউড়ি, হলুদ ধানের ক্ষেত, ঝাঁক ঝাঁক রৌদ্র বোঝাই গরু আর মোষের গাড়ির সারবন্দী হেমন্তের ছবিÑ ঝুটিঅলা টিয়া আর কাকাতুয়ার দলে দলে উড়ে যাওয়ার নয়নাভিরাম বিমুগ্ধ দৃশ্যপট মনকে ভীষণভাবে আন্দোলিত করে, উচ্ছ্বসিত করে।
ঘাসফড়িং, গঙ্গাফড়িং আর বর্ণিল প্রজাপতির দল হেমন্তের চিবুক ছুঁয়ে যেন উড়ে গিয়ে বাংলার গ্রামীণ-লোকজ প্রতিটি মুহূর্তকে স্মরণীয় করে দেয়। হেমন্তের অপরিসীম রূপোজ্জ্বলতা যেমন প্রকৃতির এক অনিঃশেষ সম্পদ, একইভাবে এই হেমন্ত বাংলা সাহিত্যেরও বিশাল জায়গাজুড়ে অবস্থান নিয়ে আছে সুদীর্ঘকাল ধরে কবিতা, কথাসাহিত্য, গল্প, নাটক, চিত্রকলা, সঙ্গীত, চলচ্চিত্র, সাজসজ্জা, ফ্যাশন তথা জীবনধারার প্রতিটি ছন্দে স্পন্দনে হেমন্তের সুরমাধুর্য বেজে-বেজে যায়। কবিতায় হেমন্তকে জীবনানন্দ লালন করেছেন এমন করে যেন হেমন্ত শুধুই জীবনানন্দের ঋতু। তার কবিতায় কার্তিক, অগ্রহায়ণ, ধান, পেঁচা, শালিক, চিলের উপস্থিতি সেই সত্যটিই মনে করিয়ে দেয়। বাংলা কবিতায় জীবনানন্দ যেমন এক অপরিহার্য ভূখণ্ড, তেমনি তার কবিতায় হেমন্তের ফিরে ফিরে আসাটাও এক অমিয় বিষয়। পাশাপাশি বাংলা কবিতাঞ্চলে হেমন্তের আনাগোনা নেহায়েত কম নয়। যুগে-যুগে কবিতার পঙক্তিতে-পঙক্তিতে হেমন্তের রূপ-ঐশ্বর্য পরিবেশ-পারিপার্শ্বিকতা ধরা দিয়েছে নানা রঙে, নানা আঙ্গিকে।
আজ এই হেমন্তের জলদ বাতাসে
আমার হৃদয়মন মানুষীর গন্ধে ভরে গেছে।
রমণীর প্রেম আর লবণসৌরভে
আমার অহংবোধ ব্যর্থ আত্মতুষ্টির ওপর
বসায় মর্চের দাগ, লাল কালো
কটু ও কথায়।
(অঘ্রাণ/আল মাহমুদ)
তনু হিম ঈষদচ্ছ নীলার সোফায়
একতাল সবিতার কোঁকড়া শয়ন:
অক্ষর শিক্ষকে যেন ঠাট্টা করে যায়
হেমন্তের নহবত: অস্পষ্ট শয়ন
কুয়াশার ব্লাউজের যতোক্ষণ চলে,
ততোক্ষণ পড়ে থাকে শেফালির ফুল;
অনন্তর স্বপ্ন পড়ে বস্তুর কবলে
চূর্ণ প্রকল্পনা, ভোরপ্রাথমিক ভুল।
(হেমন্ত ভোর/আবদুল মান্নান সৈয়দ)
জানালার দুমড়ানো পরদা সরিয়ে কে যেন
নিষ্প্রভ স্বরে ডেকে ওঠে :
–হেমন্ত এসেছে?
–হেমন্ত? কে তিনি? কার কথা বলেছেন সাহেব? কে সে?
ছেলে ছোকড়া কেউ?…
নাকি কোনো নেহাত ছাপোষা ভদ্রলোক?
কার কথা বলছেন সাহেব শুনি?
কোন গলিতে থাকেন তিনি?
(হেমন্ত বিষয়ক কবিতার খসড়া/আবিদ আজাদ)
কাইত্যান শীত নামিয়ে দেয় কাঁথার/হেমন্তকে মনেই পড়ে না,Ñ
সে কোন শিশুবেলায় জমিয়ে রেখেছি নোনাভরা চোখের জল;
তোমরা গাঁয়ের কথা ভাবো, এক্কেবারে শৈশবকাল চাল আর কাঁঠাল বীচি
চিবুতে চিবুতে হেমন্তে এসে হাজির;
(জীবনচক্র/মাহবুব হাসান)
হ্যাঁ, হেমন্ত এসে দাঁড়িয়েছে বাংলার হাল্কা কুয়াশাজ্বলা মাঠে, শীতের আমেজে চরের রুপোলি উপকূলে, বনমোরগের লালঝুঁটিতে শিশিরের গুঁড়ো হয়ে জমে আছে হেমন্ত খুব ভোরবেলা। কবিতায়, শিল্প-সাহিত্যে হেমন্তকে পাওয়া যায় গভীরভাবে। নবান্নের মুখর উৎসবে, আনন্দে হেমন্ত এক অনাবিল উচ্ছ্বাসে উল্লসিত হয় আর কার্তিকে-অগ্রহায়ণের অরুণাভ চিবুকে জাগে হেমন্তেরই গাঢ় কুজঝটিকা জ্বলা নিঝুম দুপুর, বিকেল আর বিজন সন্ধ্যা। কবিতার পঙ্ক্তিতে হেমন্তের বর্ণমালাগুলো যেন মুক্তোর দানার মতো চমকিত হতে দেখা যায় আকণ্ঠ উৎসারণে।
‘ শৈশব কৈশোর ফেলে বহুদূর চলে এসে
ঋতুর বৈভব ভুলে নগরীর জঞ্জালে ডুবে আছি
তবু হেমন্ত এসে টোকা দিলে
খুলে যায় স্মৃতির জানালা-
চোখে ভাসে মাইল মাইল ঘনখেসারি ও শনের হলুদ
হেমন্ত রহিবে এই উচ্ছ্বাসে
কয়েক পঙ্ক্তি লিখে শৈশবে ডুবে যাই :
….
ট্রেনের জানালায় ঘুরে ঘুরে সুদূরে হারায়
ট্রেন চলে, হলুদ কার্পেট মৌমাছি হৈমন্তিক বিকেলে খেলা করে।
(হৈমন্তিক বিকেল/ জাহাঙ্গীর ফিরোজ)
‘অনন্ত আকাশ জুড়ে তোমার
বর্ণিল ঘুুড়ির উৎসব এখন নাটাই বন্দি
সুনীল সাগরে বিস্তারিত মায়াজল পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে
হাতের কাঁকন বানিয়েছ।
দিগন্ত জোড়া বিস্তীর্ণ সবুজ তৃণভূমি আর সোনালি ফসল
তোমার ওয়েডিং গাউনের ভেতর সীমাবদ্ধ।’
(মিস হেরিটেজ/বুলান্দ জাভীর)
সূদীর্ঘ আঁধার ভেঙে জেগে ওঠে আমার সুদিন
আমার আশ্চর্য আনন্দের ভোর
কিছুটা শিশির মাখা কিছুটা কুয়াশা হিম
বাকিটা কোমল আর্দ্রতায় অবনত নীলের উঠোনে
কেউ যেনো লিখে গেছে-হেমন্তের নাম
হেমন্ত আমার হেমন্ত’
(প্রিয় হেমন্ত আমার/জাকির আবু জাফর)
‘মিহি-স্মৃতির কষ্ট নিয়ে আমার দু’চোখ অতীতের জলকণা,
ভিজে-আসা রাতের টুপটাপ বিলাপ, ঠিকানাহীন গাংচিলের একাকী কাঁপন…
অশ্রুময় পৃথিবী তবু প্রাণে প্রাণে হেমন্ত
নতুনের সেলুকাস হৃদয়ে বারবার সূর্যোদয়।’
(হেমন্ত বন্দনা/রহমান মুজিব)
এভাবেই কবিতার হাত ধরে চন্দ্রচূড় কুয়াশার ঘনজমাট ঘোর কেটে লোকোমোটিভের অয়েল কালারের নীল মুখচ্ছবি এসে দাঁড়ায় কবিতায় কবিতার গ্রীবার মতো বেঁকে যাওয়া হেমন্তের ভোরবেলাকার সুনসান জংশনে।
হেমন্ত আসে, হেমন্ত যায় খুব বিকেল বেলার ফিকে রোদে বোনা টেরিলিনের মিহিন শার্ট পরে। নিঃসঙ্গ সন্ধ্যায় ধূ-ধূ কোনো কিশোরের ছায়াচ্ছন্ন মনে হেমন্ত এসে বসে ডানলোপিলোর র‌্যাক্সিনে মোড়া তারাপুঞ্জ গাঁথা আকাশের নীলাভ ডিভানে-সোফায়।
প্রকৃতির নৈসর্গিক সবুজ মিডিয়ামে পড়া হেমন্তের লাল প্যান্টের পকেট ভর্তি বর্ণিল মার্বেল থেকে দলছুট এক রাঙা গুলতির ভেতর যেন ফুটে আছে আমাদেরই চিরচেনা হেমন্তের দিন। কখনো-কখনো হেমন্তকে পাওয়া যায় স্বর্ণোজ্জ্বল ধানের ক্ষেতের বাদলাঝরা কাকতাড়–য়ার ছেঁড়া জামার আস্তিনে। ভাঙা বোতামের কান্কোয়। বুনো টিয়ে কিংবা ময়নার আরণ্যক গন্ধজাগা স্বর্ণরেণু ফোটা রোঁয়ায়ও হেমন্ত আছে। আছে খড়ের গাঁদায়। পাখিদের বর্ণোজ্জ্বল পনিটেলে। ফাইবারের সুতীক্ষè ঠোঁটে। আছে আখরোটে, কিশ্মিশের বনে-মনে-মনে তুমুল বর্ষণেও হেমন্তের ঝাপসা ছায়াটুকু এসে থামে সারা বাংলায় কবিতা, সাহিত্য শিল্প-কলার নিবিড় স্পন্দনে।