নির্যাতন-ধর্ষনের শিকার রোহিঙ্গা তরুণীর লোমহর্ষক গল্প

0
1236

বি এম হাবিব উল্লাহ চকরিয়া (কক্সবাজার) প্রতিনিধি রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে ফিরে :
ঘটনার দিন চার ননদ সহ ওই তরুণী রাতের খাবার খাচ্ছিল। তখনই মিয়ানমারের সেনারা তাদের বাড়িতে হামলা করে। তারা ঘরে ঢুকে জোর করে অন্য একটি কক্ষে নিয়ে যায় তাদের। ওই সময় তরুণীর সঙ্গে থাকা ২ বছরের ছোট সন্তানকে ফুটবলের মতো লাথি মেরে ফেলে দেয় সেনারা। পরে সবাইকে তারা নগ্ন করে। এক এক সেনা এক এক তরুণীকে গলায় ছুরি ধরে বাকিরা ধর্ষণ করতে শুরু করে। গভির রাত পর্যন্ত তাদের সবাইকে ১৫ জন সেনা পর্যায়ক্রমে ধর্ষণ করে। কথাগুলো বলছিলেন ধর্ষণের শিকার গৃহবধু ওই তরুণী আয়েশা বেগম। মাত্র সপ্তাহ খানেক আগেই মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ভূসি-ডংয়ের তামিয়া গ্রাম থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে সে। সেখানে মিয়ানমারের সেনাদের বর্বরতার কথা জানায় আয়েশা। ২০ বছর বয়সী আয়েশা বেগম বলে, ‘আমি বারবার ভাবছিলাম, তারা আমাকে মেরে ফেলবে। ওদিকে আমি ভয়ে ছিলাম, সেনাদের লাথি খাওয়ার পর আমার সন্তান বোধহয় মারা গেছে। এ ঘটনার পর ১০ দিন হেঁটে পাহাড়ী পথে আমরা বাংলাদেশে আসি। বাংলাদেশে আসার পথে ধর্ষণের শিকার আমার দুই ননদ মারা যায়। গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের আরাকান-রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর রাষ্ট্রীয় সহিংসতা শুরু হলে এখানে খুন, অগ্নিসংযোগ লুটপাট সহ নির্বিচারে রোহিঙ্গা নারীরা ধর্ষণের শিকার হয়। ধর্ষণের পর অনেককেই কষ্ঠ দিয়ে হত্যা করে সেনা ও স্থানীয় বড়ুয়া-হিন্দু ও মগ সম্প্রদায়। সুত্র বলছে হিন্দু ও বড়ুয়াদের কিছু করেনা সেনারা। তাদেরকে সাথে নিয়েই হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। আবার অনেকেই শরণার্থী হয়ে আশ্রয় নিয়েছে কুতুপালয়-কাষ্টম-নাইক্ষনছড়ি, বালখালী, হোয়াক্যং, হিৃলা সহ বিভিন্ন স্থানে। বিভিন্ন সুত্র মতে, ২৫ আগস্ট সহিংসতা শুরু পর থেকে এ পর্যন্ত সোয়া পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই নারী ও শিশু। সরজমিন দেখা গেছে, বিশেষ করে থাকার বাসস্থান, খাবার, শৌচাগার ও চিকিৎসা সংকটে রোহঙ্গিা ক্যাম্প গুলোতে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় তৈরি হয়েছে। আশ্রয় নেয়া ওই কিশোরী ও নারীদের অনেকেই যৌন নির্যাতনের শিকার। ফলে মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত তারা। শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ধর্ষণের শিকার নারী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা আরো অনেকেই কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, অনেক কিশোরী ও নারীদের মিয়ানমারের সেনারা ধর্ষণ করেছে এবং ধর্ষণের পর ঘরের ভেতর তাদের আটকে রেখে আগুন লাগিয়ে দেয় সেনারা। ফলে এক বাড়ীতে একই সাথে ১০/১৫জনও মারা গেছে। পালাবার কোন পথ ছিলনা তখন। কারন বাড়ীর বাইরে ১৫জন থাকলে ভিতরে ১৫জন ঢুকে পড়ে। শুধু ধর্ষণ নয়, ধর্ষন করার পর উলঙ্গ করে শরীরের গোপনাঙ্গ সহ অন্যান্য স্পর্ষকাতর অঙ্গেও পাশবিক নির্যাতন করেছে এসব বৌদ্ধ সেনারা। এখন তাদের দাবি একটাই। মিয়ানমারের সেনারা তাদের ওপর যে যৌন নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের বিচার চাইছে এসব তরুণীরা। বিশষজ্ঞরা বলছেন বিশেষ করে রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে ২৭ বছরের আগেও পালিয়ে আসা কয়েকজন রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ তাদের অভিজ্ঞতার কথাও জানান। ধষণের পর অধিকাংশ নারীকেই হত্যা করা হয়েছে এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। রোহিঙ্গা ধর্ষিত নারীদের চিকিৎসা দিচ্ছে এমএসএফ নামে একটি সংস্থা। রোহিঙ্গা নারীরা নিশ্চিতভাবে ব্যাপক ধর্ষণের শিকার হয়েছে উল্লেখ করে এমএসএফের সমন্বয়ক কেইট হুয়াইট বলেন, সহিংসতা শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৫০ জন ধর্ষিতাকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এদের মানসিক অবস্থা খুবই নাজুক।‘এক ধর্ষিতার লাশ দাফন না করেই পালিয়ে আসা তামিয়া গ্রামের আরেক নারী মোহসিনা বেগম বলেন- মিয়ানমারের সেনারা ঘরে ঢুকে আমাদের ১৯ বছর বয়সী বোনকে তুলে নিয়ে যায়। সে দেখতে খুব সুন্দর ছিল। গ্রামের চেয়ারম্যানের মধ্যস্থতায় তাকে ফিরিয়ে আনি। কিন্তু ফিরিয়ে আনার আগ পর্যন্ত তাকে সেনারা আটকে রেখে ধর্ষণ করেছে। পরে যখন আমরা পালিয়ে আসতে থাকি। আসতে পথেই তখন রাস্তায় মারা যায় সে। তার লাশ দাফন না করেই আমরা পালিয়ে আসি। তিনি অঅরো বলেন-বর্মী বৌদ্ধ সেনারা ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে বেদম মারধর করে। তারপর শরীরে পেট্রোল ঢেলে দিয়ে অনেককেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করেছে। ভূসি-ডংয়ের তুলাতোলি গ্রামের রাজুমা বেগম (২০)। তিনি বলেন, সেনারা আমার ছেলেকে কেড়ে নিয়েছে। তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় মাটিতে। পরে তার গলা কেটে ফেলে সেনারা। এরপর আমাকে সহ আরো চার নারীকে একটি ঘরের নিয়ে যায় সেনারা। সেখানে তিনজন নারী, একজন কিশোরী এবং ৫০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা ছিল। ওই বৃদ্ধাকে ছাড়া সবাইকে ধর্ষণ করে বৌদ্ধ সেনারা। দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে দুই সেনা আমাকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর লাঠি দিয়ে তারা আমাদের বেদম মারতে থাকে। পরে তারা মনে করে আমরা মারা গেছি। এর পরও মৃত্যু নিশ্চিত করতে ঘরের ভেতর আমাদের আটকে রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। রাখাইনেরভেূসি-ডংয়ের চম্প্রা গ্রাম থেকে আসা ৫০ বছর বয়সী ইয়াসমিন প্রতিবেদককে বলেন- ১৫ দিন আগে তিনি বাংলাদেশে এসেছেন স্বামীসহ ১৩ সন্তান নিয়ে। প্রথমে তিনি ধর্ষিত হওয়ার বর্ণনা না দিতে চাইলেও স্বামীর অনুমতি নিয়ে জানান সেই ভয়ংকর ও লোমহর্ষক সময়ের কথা। ইয়াসমিন বলেন, ‘গ্রামে ঢুকে সেনারা বলে তোমাদের কাছে অস্ত্র থাকলে আত্মসমর্পণ কর। যখন গ্রামবাসী বলে অস্ত্র নেই, সেনারা সবাইকে নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন করতে শুরু করে। তিনি বলেন-১২ সেনা আমার ঘরে ঢুকে এবং ৫-৬ ও ১০ বছর বয়সী সন্তানদের লাথি ও ছুরি মারতে থাকে। সন্তানদের বাইরে ফেলার পর বিভিন্ন বয়সী পাঁচজন সেনা আমাকে ধর্ষণ করতে থাকে। বাকি সেনারা বাইরে প্রহরা দেয়। এ সময় তাদের সাথে কয়েকজন হিন্দু ও বড়ুয়াও ছিল। নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বেলেন-মুখে বলতে পারব না। আরো কত কিযে, ওতচিত করে কিভাবে নির্যাতন করেছে বৌদ্ধ নোরা বলতেই মুখটা লজ্জায় ঢেকে ফেলছিলেন তিনি। তখন মনে হচ্ছিল তিনি মারা পড়ছেন। তবে আল্লাহ তাকে এ ঘটনার স্বাক্ষি বানিয়েই দুনিয়ায় বেচে রেখেছেন। তখন শত শত মানুষের সামনে এ বয়োবৃদ্ধ মহিলা অঝর নয়নে কাঁদছেই। এ রকম শত শথ ঘটনার জন্ম দিয়েছে বর্মী-মিয়ানমারের বৌদ্ধ সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এখনো আরাকান থেকে মানুষ আসছেই। টেকনাফ-উখিয়ায় শেষ মেষ আবাসন সংকট তৈরী হওয়ারও উপক্রম বলে মনে করছেন স্থানীয়।