ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে উপবন এক্সপ্রেস

0
132

সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে আসা আন্তঃনগর উপবন এক্সপ্রেস ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। রোববার রাত পৌনে ১২টার দিকে ট্রেনটির ছয়টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে ছিটকে পড়ে। এর মধ্যে একটি খালে পড়ে এবং অপর পাঁচটি বগি জমিতে উল্টে পড়ে। এতে এ প্রতিবেদন লেখার সময় পর্যন্ত ঘটনাস্থলে ৭জন নিহত ও অন্তত দুই শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। ঘটনাস্থলে পুলিশ, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিসের ২৭টি ইউনিটের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা উদ্ধার কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন।

 

রাত তখন প্রায় পৌনে ১২ টা। যথা নিয়মেই শোনা যাচ্ছিল ট্রেন চলার শব্দ। স্থানীয় ইসলামাবাদ,নন্দনগর,মহলালসহ আশপাশের গ্রামবাসী অনেকেই তখন ঘুমে। আবার কেউ কেউ নিচ্ছিলেন ঘুমের প্রস্তুতি। বরমচাল রেলস্টশন সংলগ্ন কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী দোকানপাট বন্ধ করে ফিরছিলেন নিজ বাড়িতে। ওই ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রত্যক্ষ করছিলেন তাদের চিরচেনা ওই ট্রেনটির অচেনা দ্রুতগতি আর সাইরেন। হঠাৎ এমন দ্রুতগতি আর বিদঘুটে শব্দ শোনে তখন অনেকেরই সন্দেহ জাগে। কিছু দূর যেতে না যেতেই হঠাৎ ট্রেনের বিকট শব্দ।

সাথে সাথেই পেছনের বগিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ধোয়ার কুন্ডলি। এমন বিকট শব্দ আর দৃশ্যে অজানা শঙ্কা জাগায়। বাতাশেই ভেসে আসে যাত্রীদের গগণ বিদারী চিৎকার। এমনটিই জানাছিলেন ঘটনাস্থলে উদ্ধার কাজে আসা স্থানীয় লোকজন। গতকাল (রোববার) রাতে সিলেট থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসা উপবন এক্সপ্রেস কুলাউড়ার বরমচাল রেলওয়ে স্টেশন পাড়ি দিয়ে প্রায় ২শ গজ সামনে আগাতেই ইসলামাবাদ গ্রামের বড়ছড়া রেলওয়ে ব্রিজে ওঠার আগেই ব্রিজ ভেঙ্গে বিকট শব্দে ট্রেনটির পেছনের একটি বগি ছড়ায় পড়ে যায়। আর আরো তিনটি বগি দুমড়েমুচড়ে রেলসড়কের পাশেই পড়ে যায়। অন্য ২টি বগি ব্রীজের দক্ষিণ পাশেই লাইনচ্যুত অবস্থায় কাত হয়ে কোনো রকম দাঁড়িয়ে থাকে। ৬টি বগিই চরম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এসময় ট্রেন থেকে আগুনের ফুলকি আর ধোয়া বের হতে থাকে। এই ৬টি বগি পড়ে যাওয়ার পর সামনের ১১টি বগিই ওই দূর্ঘটনার স্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার যাওয়ার পর থেমে যায়। দূর্ঘটনার পর আহতদের চিৎকারে আশপাশের গ্রামবাসী দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে এসে  উদ্ধার তৎপরতা চালায়। এবং ফায়ারসার্ভিস ও পুলিশকে দুর্ঘটনার খবর জানায়। খবর পেয়ে এলাকাবাসীর সাথে ফায়ার সার্ভিসের মৌলভীবাজার ও সিলেট জেলার ১১টি ইউনিটসহ পুলিশ ও বিজিবি ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাত্রীদের উদ্ধার কাজ চালায়। খবর পেয়ে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ও পুলিশের  ঊর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছান। তাদের সহায়তায় বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বেশ কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ঘটনাস্থলে পৌঁছে আহতদের সরকারী বেসরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়। স্থানীয় পিকাপ ও লেগুনা মালিক সমিতির লোকজনও তাদের গাড়ি দিয়ে উদ্ধার কাজে সহযোগিতা করেন। ব্যক্তি মালিকাধীন প্রাইভেট গাড়িগুলোর মালিকরাও উদ্ধার ও ওই ট্রেন যাত্রী বহনের কাজে সহযোগীতা করতে দেখা যায়। দূর্ঘটনার খবর চাউর হলে কুলাউড়া উপজেলার ভাটেরা বরমচাল ব্রাহ্মণবাজার ইউনিয়নের বাসিন্দাসহ পুরো উপজেলার লোকজন দ্রুত ছুটতে থাকেন ঘটনাস্থলে। অন্ধকারের মধ্যে মুঠোফোনের আলো ও টর্চ লাইট জালিয়ে তারা সকলেই আহতদের উদ্ধার কাজে সহায়তা করেন। গভীর রাতেও ব্রাহ্মণবাজার সিলেট সড়কে যাত্রীসহ দূর্ঘটনায় আহত নিহতদের উদ্ধারে সহায়তাকারীদের লোকজন ও যানবাহনের ভীড় ছিল লক্ষণীয়। ইসলামাবাদ গ্রামের মো: জহির আলী, মো: জয়নাল আবেদীন, নন্দনগর গ্রামের  নরুল আমিন চৌধুরী তপু, মহলাল গ্রামের পারভেজ আহমদ,আহসান মিরাজসহ অনেকেই জানান দূর্ঘটনাস্থলের কাছেই তাদের বাড়ি। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগেই তারা হঠাৎ বড়ছড়া ব্রিজের পাশে ট্রেনের বিকট শব্দ শুনতে পান। এরই সাথে ট্রেনের পেছনের বগিতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ আর ধোয়া দেখতে পান। এমন সময় ট্রেনের যাত্রীদের কান্না আর চিৎকারে তারা দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এই ভয়াবহ দূর্ঘটনার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে তারা দ্রুত মুঠোফোনে ফায়ারসার্ভিস ও পুলিশকে এ খবর জানান। এবং তাদের প্রতিবেশী ও গ্রামবাসীদের নিয়েই আহত যাত্রীদের উদ্ধার ও সহায়তায় নামেন। স্কাউট সদস্য হোসাইন আহমদ,সাব্বির আহমদ, কলেজ শিক্ষার্থী  নাঈম আহমদ সুজন,আলতাফ মাহমুদ,ব্যবসায়ী সুলেমান আহমদ, বিমেলেন্দু সেন কৃষ্ণ, মিনহাজ উদ্দিন আহমদ কমরু, মোক্তাদির হোসেন মনা বলেন আহত ও নিহত স্বজনদের চিৎকার আর কান্নায় ওই এলাকার পরিবেশভারী হয়ে উঠে। এই মর্মান্তিক দৃশ্যে যে যার মত করে সবাই উদ্বার কাজে সহায়তা করেন। উপবন ট্রেনের ক্যানটিন ম্যানেজার  মো: মানিক খান জানান অন্য দিনের চাইতে আজকে একটু বাড়তি চাপ ছিল যাত্রীদের। তাই নিয়মিত ১৫ টি বগি থাকলেও আজকের জন্য আরো ২টি বাড়িয়ে ১৭ টি বগি করা হয়েছিল। নন্দনগর গ্রামের ফারুক মিয়াসহ ওই গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান বড়ছড়া ব্রিজের উপর ও ব্রিজের মুখের রেল স্লিপার ও পাতের নাট বল্টু দীর্ঘদিন থেকে নেই বললেই চলে। আর যে দু’একটি আছে তা জং ধরে থ্রেট ক্ষয় হওয়াতে কাজ করে কম। তাই ট্রেন ওই ব্রীজে উঠলেই লক্কর ঝক্কর ওই ব্রীজের রেললাইন নড়াচড়া করত। এই বিষয়টি তারা স্থানীয় রেল স্টেশনের সংশ্লিষ্টদের জানালেও তারা তা আমলে নেননি। তাদের ধারনা একারনেই হয়ত দ্রুত চলা এই ট্রেনটি দূর্ঘটনায় পড়ে। ঘটনাস্থলে আসা আরব আলী, মাছুম আহমদ চৌধুরী, সুলতান আহমদ চৌধুরীসহ ভাটেরা বাজার ও বরমচালের কালামিয়া (ফুলেরতল) বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান অন্য দিনের চাইতে উপবন ট্রেনটি বেশ দ্রুতগামী ছিল। এমন দৃশ্য দেখে আমাদের ভয় হয়েছিল। সে ভয়ই বাস্তব হল। রাত প্রায় আড়াইটার দিকেও ঘটনাস্থলের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে উদ্ধারকারী,যাত্রীদের স্বজন,আইনশৃঙ্খলাবাহীনির সদস্যসহ স্থানীয় বাসিন্দাদের উপস্থিতি ছিল লক্ষ্যনীয়। ভোর পর্যন্ত ঘটনাস্থলের আশপাশ এলাকায় পুলিশ, ফারসার্ভিসকর্মীদের নিরাপত্তা বেষ্টনী ছিল জোরদার। কুলাউড়া সদর হাসপাতাল,মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালসহ স্থানীয় সরকারী বেসরকারী হাসপাতালেও আহত ও নিহদের খোজঁখবর নিতে ও তাদের এক নজর দেখতে ভীড়ে হিমশিম খেতে হয় কর্তৃপক্ষের। কুলাউড়া হাসপাতালের বারান্দার মেঝেতে সারিবদ্ধভাবে রাখা হয় দূর্ঘটনায় নিহত ৪ জনের লাশ। আর স্থান সংকুলান না হওয়াতে মেঝেতে চলে আহতদের চিকিৎসা সেবা। গুরুতর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে প্রেরণ করা হয় মৌলভীবাজার সদর কিংবা সিলেট ওসমানী হাসপাতালে। হাসপাতাল গুলোতে আহতদের কান্নায় ভারী হচ্ছে পরিবেশ। ফায়ারসার্ভিসের সিলেট বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আলী জানান হতাহতের পরিসংখ্যান এই মুহুর্তে সঠিক করে বলা না গেলেও ৪জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়েছেন। আমাদের ১১টি ইউনিটের সদস্যরা এখানে কাজ করছেন। দূর্ঘটনা কবলিত সব বগিই আমরা সার্চ করে দেখেছি। কোনো বগিতেই আহত নিহত কোনো যাত্রীকে পাইনি। তারপরও আমরা ঘটনাস্থলে আরো সার্চ করছি। ভয়াবহ এই ট্রেন দূর্ঘটনায় ৬ জন নিহত ও ৩ শতাধিক যাত্রী আহত হয়েছেন। আর আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা গুরুতর। আহত ও নিহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে উদ্ধারকারী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের ধারণা। ওই দূর্ঘটনায় ট্রেনের ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। আহতদের উদ্ধার করে কুলাউড়া,মৌলভীবাজার,ফেঞ্চুগঞ্জ ও সিলেটের সরকারী ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণে সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ রয়েছে। প্রতিটি স্টেশনে অপেক্ষমান যাত্রীদেরও চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত (সোমবার সকাল ৭ টা) ইঞ্জিনের সাথে সংযুক্ত থাকা ১১টি বগি উদ্ধার করে কুলাউড়া স্টেশনে আনা হয়েছে। আর ব্রীজের নীচে ও সড়কের পাশে দুমড়েমুচড়ে পড়া ৪টি বগি ও লাইচ্যুত হওয়া দু’টি বগিসহ ৬টি বগি উদ্ধারে তৎপর রয়েছেন রেল বিভাগের লোকজন। পরে সাতটি বগি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয় উপবন ট্রেন।
উল্লেখ্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরাইলের শাহবাজপুরে ব্রিজ ভেঙ্গে গেলে ঢাকা-সিলেট সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকায় ট্রেনে যাত্রী সংখ্যা ছিল দ্বিগুন। কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশনের লোকাল ইনচার্জ দুলাল চন্দ্র দাস জানান ট্রেনে মোট ১৭ বগির মধ্যে ৬টি বগি লাইনচ্যুত হয়। ওই ৬টি বগি উদ্ধারের কাজ চলছে।