মহামারীর মধ্যে যেভাবে ‘হার্ড ইমিউনিটিতে’ পৌঁছানো যাবে

0
82

বিশ্বজুড়ে নতুন করোনাভাইরাসের মহামারী এখন সাধারণ মানুষের চিন্তা-চেতনায়ও ‘হার্ড ইমিউনিটির’ ভাবনাকে সামনে নিয়ে এসেছে। সবারই আশা, এ ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জিত হলে সংক্রমণের গতি শ্লথ হয়ে আসবে অথবা দুঃসহ এই প্রাদুর্ভাবের অবসান ঘটবে।

কী এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’? এই তত্ত্ব অনুযায়ী, যদি জনসংখ্যার ব্যাপক অংশের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো ভাইরাসের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে ওঠে, তখন ভাইরাসটি সহজে সংক্রমিত হওয়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এরকমটা হলে কেবল যাদের প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো তারাই নয়, বেশিরভাগ মানুষই ভাইরাসের আক্রমণ থেকে সুরক্ষা লাভ করবে।

দুই উপায়ে এই ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জন করা যায়। এর একটি হল- স্বাভাবিক সংক্রমণ, আরেকটি হল টিকার প্রয়োগ। স্বাভাবিক সংক্রমণের ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যক মানুষকে ভাইরাসবাহিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর সুস্থ হয়ে উঠতে হবে।

তবে নতুন করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এ ধরনের স্বাভাবিক সংক্রমণে সুরক্ষার ব্যপ্তি ঠিক কতটুকু তা এখনও অজানা, বলছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, টিকা উৎপাদন ছাড়া কেবল স্বাভাবিক সংক্রমণের মাধ্যমে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনের অপেক্ষা করলে তুলনামূলক বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটবে।

“এই ঝুঁকি নেওয়া যাবে না। যেহেতু আমরা ভাইরাসটির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব সম্বন্ধে খুবই কম জানি, তাই হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছানোর জন্য বিপুল সংখ্যক মানুষের আক্রান্ত হওয়া মেনে নিতে পারি না আমরা,” বলেছেন মেলবোর্নের ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অনুষদের মহামারী বিশেষজ্ঞ ক্যাথরিন বেনেট।

অন্যদিকে টিকা বা প্রতিষেধক মিললে বেশ দ্রুতগতিতে এবং তুলনামূলক নির্ভরযোগ্য উপায়েই বিপুল সংখ্যক মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিশ্চিত করা যাবে।

এখন পর্যন্ত নতুন করোনাভাইরাসে সৃষ্ট রোগ কোভিড-১৯ এর কোনো প্রতিষেধক পাওয়া যায়নি। তবে অনেকগুলো টিকার বিভিন্ন পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। কিছু কিছু টিকা তৃতীয় পর্যায়ের পরীক্ষাও শুরু করেছে।

সাধারণত একটি ভ্যাকসিন বা টিকা উদ্ভাবন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, উৎপাদন ও শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছাতে পৌছাতে কয়েক বছর পর্যন্ত লেগে যায়।

কোভিড-১৯ এর টিকার ক্ষেত্রে দ্রুতগতিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং চূড়ান্তভাবে সফল বলে বিবেচিত হওয়ার আগেই বিপুল সংখ্যক উৎপাদনের মাধ্যমে এই সময়সীমা কমিয়ে আনা যাবে বলে আশা বিভিন্ন ওষুধ ও টিকা নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান, টিকার মাধ্যমে যদি বিশ্বের ৫০ থেকে ৭০ শতাংশ মানুষ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জন করতে পারে, তাহলেই ‘হার্ড ইমিউনিটি’র কাজ শুরু হয়ে যাবে।

তবে এক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা হারও খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার হার যদি ৭০ শতাংশ হয়, তাহলেই সবচেয়ে ভালো হবে বলেও মত বিশেষজ্ঞদের।

কীভাবে একটি টিকা সরবরাহ করা হচ্ছে, তার উপরও এর কার্যকারিতা নির্ভর করে, বলছেন বিশ্লেষকরা। যদি অসমভাবে বন্টন করা হয়, তাহলে টিকাটি খুব একটা কার্যকর হবে না।

ধরা যাক, একটি ভ্যাকসিন পাওয়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র এলাকাগুলোর চেয়ে ধনী এলাকাগুলো বেশি প্রাধান্য পেল। সেক্ষেত্রে নিরাপদ কিছু ‘ক্লাস্টার’ বা ‘গুচ্ছ’ এলাকা বানানো সম্ভব হলেও, বাকি বিরাট অংশের জনগণকে ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতেই থাকতে হবে।

টিকা দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রথম দিকে স্বাস্থ্যসেবা খাতের সঙ্গে জড়িত কর্মী, ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অগ্রবর্তী দলগুলোর সদস্য এবং সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অবশ্য এই ‘টার্গেটেড ভ্যাকসিনেশন’ প্রক্রিয়াতেও গণপরিবহন কর্মীদের মতো ‘সুপার স্প্রেডাররা’ বাদ পড়ে যেতে পারে।

“ভ্যাকসিন যেন জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের,” বলেছেন মেলবোর্নের লা ত্রোভ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক জোয়েল মিলার।

জোয়েল মূলত গাণিতিক মডেল ব্যবহার করে সরকার ও বিভিন্ন অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ঠিক করতে সহযোগিতা করেন।

মানুষের চলাফেরা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব ফেলায় টিকাদান পর্বেও বিধিনিষেধ আরোপের প্রয়োজন পড়তে পারে, বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

টিকাদানের প্রাথমিক পর্যায়েও টিকা না নেওয়া সেসব মানুষেরই সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবে, যারা ভ্রমণ কিংবা বেশি মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করবেন।

টিকা গ্রহণকারী মানুষের সংখ্যা ধাপে ধাপে বাড়ানো হলেও, ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেই কেবল ভাইরাসে আক্রান্তের পরিমাণ কম হবে, বলছেন তারা।

এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, নতুন করোনাভাইরাস ছড়ায় আক্রান্তের কাশি, হাঁচি বা কথা বলার সময় নির্গত ড্রপলেট থেকে। ছোঁয়াচে এই ভাইরাস থেকে বাঁচতে বিজ্ঞানীরা তাই মাস্ক পরা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বেশি বেশি হাত ধোয়ার উপর জোর দিচ্ছেন।

ভ্যাকসিন আসার আগ পর্যন্ত নিজেকে নিরাপদ রাখার এ চর্চা একদিকে সংক্রমণের হার কমাবে, অন্যদিকে ‘হার্ড ইমিউনিটি’ অর্জনেও ভূমিকা রাখবে, বলছেন তারা।

মহামারী বিশেষজ্ঞদের মতে, ভ্যাকসিন মিললেই বিপদ শেষ, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। শুরুর দিকের টিকাগুলোর কার্যকারিতা ১০০ শতাংশ হবে না বলেও ধারণা তাদের; এ কারণে টিকার পাশাপাশি সংক্রমণ প্রতিরোধে যেসব পরামর্শ ও পদক্ষেপ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে সেগুলো প্রয়োগের গুরুত্বও স্বীকার করে নিয়েছেন তারা।

“এটা আমাদেরকে কমিউনিটি পর্যায়ে ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেবে। ব্যবস্থার সংমিশ্রণ থাকলে পরিস্থিতি তুলনামূলক অনেক ভালো হবে,” বলেছেন ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামারী বিশেষজ্ঞ বেনেট।