বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম::
বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে জাতীয় স্মৃতিসৌধে এসে সরকারের কাছে মানবতাবিরোধী সব অপরাধীর বিচার নিশ্চিতের দাবি জানিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধারা।
তারা বলছেন, বিজয় দিবসের চেতনাকে সমুন্নত রাখতে প্রয়োজনে আবারও তারা যুদ্ধে যেতে রাজি আছেন। পাশাপাশি তরুণদেরকেও এই চেতনা লালন করে দেশকে এগিয়ে নেবার আহ্বান জানান তারা।
মুক্তিযোদ্ধারা যখন তাদের দাবির কথা বলছিলেন, তখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে ফুল নিয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ছিল সর্বস্তরের মানুষের অপেক্ষার দীর্ঘ লাইন। তার উল্টো দিকে হুইল চেয়ারে করে প্রতিবন্ধী শিশু-কিশোরাও এসেছেন শহীদদের ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে।তার আগে ভোরেই ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় স্মৃতিসৌধ। লাখো মানুষের ভিড়, কোলাহল, স্মৃতিসৌধের আরো কাছে যেতে শিশুদের বায়না আর কিশোর যুবকদের স্লোগানে তখন স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণ ছিল মুখরিত।
একটু পর পরই শোনা যাচ্ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মরণে তরুণদের ‘বিজয়ের এই দিনে/ মুজিব তোমায় পড়ে মনে’ ও ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ সহ বিভিন্ন স্লোগান।’ পাশাপাশি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও শ্রমিক সংগঠনের কন্ঠে শোনা যাচ্ছিল, ‘বীর বাঙালির হাতিয়ার/ গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘জামায়াত শিবির রাজাকার/ এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগানও।
এমন সময় মুক্তিযুদ্ধে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা মো. আলাউদ্দিন মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের মানুষ ভালো থাকবে এটাই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা। নিজেদের কোনো চাওয়া-পাওয়ার জন্য তো যুদ্ধে অংশ নিইনি।“তবে বর্তমান সরকারের কাছে দাবি জানাই, যারা একাত্তরে মানবতাবিরোধী কাজে যুক্ত ছিল, তাদের বিচারের প্রক্রিয়া দ্রুত যেন শেষ করা হয়,” বলেন মুক্তিযুদ্ধের পর জনতা ব্যাংকে কর্মজীবন শেষে অবসর নেওয়া এই কর্মকর্তা।
তার পাশে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রাণ হারানো সহযোদ্ধাদের কথা মনে পড়ে বলে জানান একই সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা পয়ষট্টি বছর বয়সী মো. আবদুল হামিদ।
তিনি বলেন, “এই দিনে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের কথা খুব মনে পড়ে। বয়স হয়ে গেলেও তাদের শ্রদ্ধা জানাতে ফুল নিয়ে আসতে ভুল করি না। তাদের স্বপ্ন সবাই মিলে সত্য করতে হবে।”
এই সময় মো. আলাউদ্দিন মিয়া স্মৃতিচারণ করে বলেন, “১৬ ডিসেম্বরও (মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইরের) ধল্লায় মুক্তিযুদ্ধ চলেছিল, সেখানে তিনজন শহীদও হন। ১৪ তারিখ চাপাইলে ক্যাপ্টেন আবদুল হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম।”
স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে চলে যাওয়ার পথে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা এএইচএম শফিউল আলমের সঙ্গে কথা হয়।
হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে গিয়ে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, “স্বাধীনতা যেন দেশের মানুষ উপভোগ করতে পারে, স্বাধীনতার চেতনা যেন সবখানে ছড়িয়ে যায় এটা আমরা চাই। পাশাপাশি সরকারের কাছে দাবি জানাই মানবতাবিরোধীদের শাস্তি যেন নিশ্চিত করা হয়।”স্মৃতিসৌধ এলাকা থেকে বেরিয়ে কথা হয় মুক্তিযোদ্ধা হাফিজুল কবির লেনিনের সঙ্গে। চেহারায় বয়সের ছাপ থাকলেও পুরান ঢাকার ভাষায় কথা বলেন ভারি কন্ঠ আর দৃঢ মনোবলের অধিকারী এই যোদ্ধা।
তিনি বলেন, “একাত্তরে সূত্রাপুর থানা আক্রমণ করেছিলাম বাবার লাইসেন্স করা বন্ধুক দিয়ে। জীবনে এমন আরো ঘটনা আছে, যা একদিনে বলে শেষ করা যাবে না।
“আমরা চাই বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকুক। এই সরকার ক্ষমতায় না থাকলে দেশটা সাম্প্রদায়িক শক্তির হাতে চলে যাবে। এতে করে স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়ন করাও সম্ভব হবে না।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিতের পাশাপাশি তাদের সাজাও দ্রুত কার্যকরের দাবি জানান তিনি।
‘শিশু-কিশোররাও জানুক মুক্তিযুদ্ধ কী’
বিজয় দিবসে ফুল দিয়ে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে দুই সন্তান নিশাত ইবনে তানজিম ও মেয়ে তাহমিনা তানজিল তুলিকে স্মৃতিসৌধে নিয়ে এসেছেন টাঙ্গাইল রেসিডেন্সিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক শামসুন্নার বেগম।
ফুল দেওয়া শেষে লাল শাড়ি ও লাল সবুজের পতাকা রঙে রাঙা পাঞ্জাবি পড়ে দুই ভাই বোন স্মৃতিসৌধের কাছে যাওয়ার জন্য হাঁটছিলেন।
নিশাত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, তাদের শ্রদ্ধা আর ভালবাসা জানাতে মা ফুল নিয়ে স্মৃতিসৌধে নিয়ে এসেছেন। তাদের আমরা আজীবন শ্রদ্ধা জানাতে চাই, আজীবন মনে রাখতে চাই।”
এ সময় শামসুন্নাহার বেগম বলেন, “শিশু-কিশোররা জানুক- কত কষ্ট করে জীবন দিয়ে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। এই চেতনা তাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। তাই সন্তানদের এখানে নিয়ে এসেছি।”শামসুন্নাহারের মতো দুই শিশু সন্তান নিয়ে স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে এসেছেন সাভারের বাইপাইল এলাকার বাসিন্দা কাকলিও।
তার চার বছর বয়সী মেয়ে মরিয়ম ইসলাম মুন আর সাত বছর বয়সী ছেলে আল জুবায়ের স্মৃতিসৌধের আরো কাছে যেতে বায়না করছিল।কাকলি বলেন, “দেশের শ্রেষ্ঠ অর্জনটা শিশুদেরও জানা উচিত। তারাও দেশকে ভালবাসুক, ইতিহাসটা জানুক। এজন্য ওদের আমি এখানে নিয়ে এসেছি।”
স্মৃতিসৌধের সামনে চার বছরের ছোট মেয়ে তানজিম সুলতানা সানকে কাঁধে নিয়ে আনন্দ করছিলেন বাবা শওকত হোসেন, যিনি কর্মসংস্থান ব্যাংকের কর্মচারী।
শওকত বলেন, “শিশুরা যেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ভালবাসে, দেশের ইতিহাস শিখতে পারে এজন্য তাদের স্মৃতি সৌধে নিয়ে আসি প্রত্যেক বছর। আমি চাই ওরাও দেশকে ভালবাসতে শিখুক।”
জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিতে হুইল চেয়ারে করে সিআরপি (সেন্টার ফর দ্যা রিহেবিলেটশন ফর দা প্যারালাইজড) থেকে পরিবারসহ এসেছেন অন্তত পঞ্চাশজন।তাদের মধ্যে শাওন নামের এক কিশোর হুইল চেয়ারে বসে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফুল দিতে এখানে এসেছি। এখানে আসতে পেরে ভালো লাগছে।”
সিআরপির সোশাল ওয়েলফেয়ার বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বলেন, “প্রতিবন্ধীরা এই সমাজের বাইরের কেউ না। তারাও যেন অন্য সবার মতো দেশের ইতিহাস জানতে পারে, শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ভালবাসার সুযোগ পায়, এজন্য তাদেরকেও স্মৃতিসৌধে নিয়ে আসা হয়েছে।”