পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে না পেরে ছয় ফুট লম্বা স্ট্যান্ডে মাইক্রোফোন বসিয়ে দিয়েছিল উদীচী। সরাসরি নাম উচ্চারণ না করে এভাবেই মানুষকে সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের কথা বলেছিল উদীচী।
প্রায় চার দশক আগে সামরিক শাসকদের নিপীড়নের ভেতর স্বাধীনতার মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের এমন আবেগঘন স্মৃতি তুলে ধরেছেন উদীচীর কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি রতন সিদ্দিকী।
শুক্রবার (০৩ মার্চ) উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদ আয়োজিত সাংগঠনিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে রতন সিদ্দিকী এই স্মৃতিকথা তুলে ধরেন।
ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা রতন সিদ্দিকী বলেন, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের পর প্রকাশ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাম উচ্চারণ করা যেত না। ১৯৭৭ সালে ঢাকায় রমনা রেস্তোঁরার পাশে একটি জায়গায় উদীচী অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। বিডিআর এসে বলল, অনুষ্ঠান করতে হলে বঙ্গবন্ধুর কথা বলা যাবে না। আমরা বললাম, বলব না।
‘আমরা অনুষ্ঠান শুরু করলাম। চারদিকে আর্মি-বিডিআরের ঘেরাও। আমরা বঙ্গবন্ধুর নাম বললাম না। কিন্তু মঞ্চের এক পাশে ছয় ফুট লম্বা একটি স্ট্যান্ডে মাইক্রোফোন লাগিয়ে ডায়াসের সামনে রেখে দিয়েছিলাম। সেই মাইক্রোফোনের সামনে কেউ বক্তব্য দেননি। মানুষ ঠিকই বুঝে গিয়েছিল, ছয় ফুট লম্বা স্ট্যান্ডের উপর রাখা মাইক্রোফোনের সামনে বক্তব্য দেয়ার মানুষটি আর নেই। ’
তিনি বলেন, মানুষ মুখ দিয়ে সেদিন বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ সেদিন করতে পারেনি। কিন্তু অন্তরের ভেতরে ঠিকই বঙ্গবন্ধুকে গেঁথে নিয়েছিল। এটাই সংস্কৃতির শক্তি।
তিনি বলেন, উদীচী বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ সাংস্কৃতিক সংগঠন। অথচ মৌলবাদি আস্ফালনের কাছে আমরা পিছিয়ে পড়ছি বলে মাঝে মাঝে মনে হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, পঁচাত্তরের পর সেই দু:সময়ে উদীচী পিছিয়ে যায়নি, সামরিক শাসনের সময় উদীচী পিছিয়ে যায়নি। মৌলবাদি আস্ফালনের কাছে উদীচী নতি স্বীকার করবে না। উদীচী শুদ্ধ এবং ঋব্ধ সংস্কৃতির চর্চা করে যাবে।
রতন সিদ্দিকী বলেন, রাষ্ট্রের নীরবতার কারণে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রশয়ের কারণে মৌলবাদিরা এখন নিজেদের প্রতিরোধ্য ভাবছে। কিন্তু সংস্কৃতির শক্তি হচ্ছে অপ্রতিরোধ্য।
প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে উদীচীর কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, পাঠ্যপুস্তকের উপর মৌলবাদি ঝড় বয়ে গেছে। এই ঝড়ের তান্ডবে আজ বাঙালীর জাতিসত্তা, আত্মপরিচয়, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাঁথা টিকবে কি না সেটা নিয়েই সংশয় তৈরি হয়েছে। এই রাষ্ট্র কি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ থাকবে নাকি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হয়ে যাবে, সেটা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
তিনি বলেন, এই পাঠ্যপুস্তক থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, হুমায়ন আজাদকে মুছে ফেলা হয়েছে। বাংলা সাহিত্য পড়লে বোঝা যায় না এটা কি সাহিত্য পড়ছি নাকি ইসলাম ধর্ম বই পড়ছি। এই পাঠ্যপুস্তক পড়ে আমাদের সন্তানেরা মানুষ হবে না। এই বই পড়ে আগামী প্রজন্ম জঙ্গি হিসেবে তৈরি হবে।
তপন বলেন, পাঠ্যপুস্তকের উপর হেফাজতি থাবা মেনে নেয়া যাবে না। সারাদেশে উদীচীর কর্মীদের জোরদার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে হবে। এই আন্দোলনকে পাড়ায়, পাড়ায় নিয়ে যেতে হবে।
উদীচীর চট্টগ্রাম জেলা সংসদের সহ সভাপতি ডা.চন্দন দাশের সভাপতিত্বে এতে আরও বক্তব্য রাখেন সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপিকা শীলা দাশগুপ্ত।
উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের কার্যালয়ে প্রশিক্ষণে অংশ নেন জেলা ও শাখা সংসদের নির্বাচিত সদস্যরা।
বিকেলে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর জাতীয় গণসঙ্গীতের জেলা পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।