‘লালদী পাড়র মেলা জইম্যে,জিনিসে পুরোই গেয়ি’

0
89

‘লালদী পাড়র মেলা জইম্যে,জিনিসে পুরোই গেয়ি’, মানুষও আইয়িরবৈশাখী মেলা১

গরম তো নয় যেন আগুনের হলকা। তাপমাত্রা বারবার রেকর্ড ভাঙছে স্মরণকালের। ঘরের বাইরে বের হতে কে চায়? কিন্তু লালদীঘির পাড়ের আশপাশ দেখলে বোঝার উপায় নেই, গরমে কাবু দেশ। এখানে রাজ্যের ব্যস্ততা,মেলার মাহাযজ্ঞে মেতেছে সবাই। বিকেল গড়াতেই দঙ্গলে দঙ্গলে আসছে মানুষ। সবার যেন একবার হলেও ঢুঁ মারা চাই। ঐতিহ্যের ধারায় প্রতিবছর বৈশাখের ১১, ১২ ও ১৩ তারিখ বসে মেলা। প্রতিবার যেন নতুন রূপে নতুন প্রত্যাশা নিয়ে আসে চট্টগ্রামের মানুষের মনে। মাঠে প্যান্ডেল বাঁধছেন ডেকোরেটর্সের কর্মীরা। তার পাশে তৈরি হচ্ছে মঞ্চ। রাস্তায় জিনিসের স্তূপ। কেউ গাঁট খুলে পণ্যের পসরা সাজাচ্ছেন, কেউ ছাউনির ব্যবস্থা করতে টাঙাচ্ছেন শামিয়ানা। এর মধ্যে আধখোলা গাঁট থেকেই জিনিসপত্র দেখছেন ক্রেতারা। দরদাম, কেনাকাটা শুরু হলো বলে। দোকানির কোনো বিরক্তি নেই। হাসিমুখে বিক্রি চলছে।

বেলা বাড়ার সঙ্গে বাড়ছে মানুষের আনাগোনা। বাড়ছে হাঁক-ডাক। বিকেল গড়াতে তো রীতিমতো জমজমাট। সব বয়সীর ভিড়ে মুখর আন্দরকিল্লা-লালদীঘি। হবেই তো, সারা বছরের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র পাওয়া যায় এখানে। বছরজুড়ে অপেক্ষাও যেন এই শতবর্ষের আবদুল জব্বারের বলীখেলার মেলার। মেলার আনুষ্ঠানিকতা শুরু আজ বৃহস্পতিবার থেকে। প্রতিবারের মতো এবারও এক দিন আগে জমে গেছে মেলা। দোকানিদের ভাষায়, ‘মেলা জইম্যে, মানুষ আইয়্যের’।

গরমে ক্লান্ত এক দোকানি পণ্যসামগ্রীর মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েন আন্দরকিল্লা মোড় হয়ে লালদীঘির পাড়ের দিকে পা বাড়তেই চোখে পড়ল শাহী মসজিদের সিঁড়ির নিচে বসে আছেন এক ব্যক্তি। তাঁর পাশে স্তূপ করে রাখা চালনি-কুলা, মাছ ধরার পলো, চাঁই, ধামা, মোড়াসহ বাঁশের তৈরি নানা পণ্য। জানালেন, তাঁর নাম আতাউর রহমান (৪৬)। এসেছেন নরসিংদীর শিবচর থেকে। ১০ বছর ধরে মেলায় আসছেন। বললেন, ‘সকালে আইসা নামছি। এখনো জায়াগা বিচরাইতেছি (খুঁজছি)। পাইলেই বইস্যা যামু।’ তাঁর মতো শিবচর থেকে বাঁশের তৈরি এসব পণ্য নিয়ে এসেছেন আবুদল আউয়াল, মাসুম ব্যাপারী, আলমাস ব্যাপারী ও আঙ্গুর ব্যাপারী। আরও সামনে এগোতে দেখা গেল, জেনারেল হাসপাতালের সামনে পাশাপাশি বসেছেন ঝাড়ু বিক্রেতা রাঙামাটির মোহাম্মদ সিদ্দিক (৫৫) ও আগ্রাবাদের বাসিন্দা পাপোশ বিক্রেতা লিয়াকত আলী (৩২)। তাঁরা জানান, জায়গা পাবেন না দেখে আগেভাগে বসে গেছেন। তা ছাড়া এক দিন আগে থেকে বেচাকেনা শুরু হয়।

লালদীঘি পার্কের কোনায় দেখা গেল, বেতের নানা সামগ্রী নিয়ে বসেছেন সিলেট সদর থেকে আসা মিনহাজ উদ্দিন (৫৫)। তাঁর কাছে রয়েছে বেতের আসবাব ও মোড়া থেকে শুরু করে বেতের তৈরি নানা পণ্য। ৩০০ থেকে ১২ হাজার টাকার পণ্য রয়েছে তাঁর কাছে। তিনি বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর বয়স থেকে বাবার সঙ্গে মেলায় আসছি। চট্টগ্রামের মানুষের সঙ্গে বছরে এই একবার দেখা হয়। তাই অন্য কিছু চিন্তা করি না চলে আসি। শুধু আমি না, সিলেট থেকে আরও অনেকে আসেন।’

মাঠ ঘেঁষে বসেছে বাচ্চাদের খেলনা আর মুড়ি-মুড়কির দোকান। কুমিল্লার সুরুজ মিয়া (৬০) এনেছেন বাচ্চাদের দোলনা, টমটমসহ রকমারি খেলনা। তাঁর পাশে রেশমি চুড়ি নিয়ে বসেছেন রাজশাহীর বিনোদপুর থেকে আসা মোহাম্মদ আরশাদুল (৪৫)। তিনি জানান, বিকেলের পর থেকে রাত ১০টা থেকে ১১টা পর্যন্ত নারীদের ভিড় থাকে বেশি। ওই সময় বিক্রিও হয় ভালো।

লালদীঘির পাড়ের হাবিব ব্যাংক ভবনের নিচে ফুলের টব নিয়ে বসেছেন ঢাকার সাভার থেকে আসা কাদের মিয়া (৮৯)। চেহারায় বয়সের বলিরেখা। অশীতিপর এই বৃদ্ধ মেলায় আসছেন প্রায় ৩৫ বছর ধরে। তিনি বলেন, ‘আমি যখন মেলায় আসা শুরু করি, তখন লালদীঘির পাড়ে এত বিল্ডিং ছিল না। আর এখন তো সব বিল্ডিং। বিক্রি আগের মতো হয় না। প্রায় সময় লস দিতে হয়। শরীরও চলতে চায় না। তার পরও মনের টানে চলে আসি। আগামীবার আসতে পারব কি না জানি না।’ কাদের মিয়ার সঙ্গে আলাপের সময় কথায় যোগ দেন ঢাকার শ্যামপুর থেকে আসা মোহাম্মদ হাসান (৪০)। তাঁর পণ্য কাঠের পিঁড়ি ও মাড়গালা (ভাতের মাড় ফেলার কাঠের তৈরি এক ধরনের পাতিল)। হাসান বলেন, ‘এখন ঝামেলা অনেক। আগের অবস্থা নেই। লাভে-লোকসানে কোনো রকমে চলে যাচ্ছি।’

লালদীঘি পেট্রোলপাম্প ঘিরে বসেছে মৃৎশিল্পের নানা সামগ্রীর বিক্রেতারা। অনেকে ফুলদানিতে রং করছেন। কেউ পণ্য সাজাতে ব্যস্ত। দেওয়ানহাটের পোস্তারপাড়ের ব্যবসায়ী মো. মোশারফ হোসেন বলেন, ‘বেশি বিক্রি হয় আমাদের সামগ্রী। এত বড় টব মেলা ছাড়া খুব একটা পাওয়া যায় না। তা ছাড়া একসঙ্গে এত্ত জিনিস আর পাবেন কই?’ সিনেমা প্যালেসের দিকে আসতে চোখে পড়ল আস্ত খাট-চৌকির দোকান। আছে শোকেস ডাইনিং টেবিলও।

যেন