‘রোহিঙ্গা সিম’ প্রমাণের চ্যালেঞ্জে মোবাইল অপারেটররা

0
177

ঘটনা ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যেন মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা না পায় সেজন্য ওই দিন মোবাইল অপারেটরগুলোকে নির্দেশনা পাঠায় বিটিআরসি।

ওই একই নির্দেশনা প্রায় এক বছর পর নিয়ন্ত্রণ সংস্থা অপারেটরগুলোকে আবারও পাঠালো। সোমবারে পাঠানো এই চিঠিতে কিন্তু আগের চিঠির সূত্রও উল্লেখিত রয়েছে।

কিন্তু এক বছরে কাজ কী হলো ? এখন রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অন্তত নয় লাখ মোবাইল সিম চালু রয়েছে হলে বলা হচ্ছে। ওই সময় সংখ্যাটি নিশ্চইয় আরও কম ছিল। অন্যদিকে ঝুঁকির বিষয়টি এখন যেমন বলা হয়েছে তখনও বলা হয়েছিলো।

তাহলে বিটিআরসির নির্দেশনা কেন বাস্তবায়ন করতে পারলো না মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ?

এই প্রশ্নের উত্তরে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিম বিক্রি হয়েছে এনআইডি ডেটাবেইজে নিবন্ধন ও এনআইডির সঙ্গে ফিঙ্গার প্রিন্ট মেলার পরেই। মূলত এসব ম্যাচ না হলে সিম চালু হবে না। আর রোহিঙ্গাদের তো এনআইডিরই সুযোগ নেই, তাই নিয়মানুযায়ী সিমের মালিক হওয়ার প্রশ্নও আসে না।

‘মূলত যেসব সিম রোহিঙ্গারা ব্যবহার করছে, মানে কোনগুলো যে রোহিঙ্গা সিম সেটা খুঁজে বের করে প্রমাণ করা চ্যালেঞ্জের। এগুলো এনআইডি যাচাই হয়েই কার্যকর হয়েছে তাই না’ বলছিলেন অন্যতম বড় একটি মোবাইল অপারেটরের শীর্ষ পর্যায়ের এক কর্মকর্তা।

এখানে মোবাইল অপারেটরদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই তো, যেমনটা প্রায়ই দেখা যায় ‘অবৈধভাবে নিবন্ধিত সিম’ বিটিআরসি উদ্ধার করছে যা ব্যবহৃত হতো ভিওআইপিসহ বিভিন্ন কাজে ?

‘ না এমনটা হয়নি, সুযোগও নেই’ দৃঢ়তার সাথে এই প্রশ্নের অভিযোগটি নাকচ করে দেন তিনি।

দ্বিতীয় আরেকটি অপারেটরের কাছে প্রশ্ন ছিল, এই বিপুল সংখ্যক সিম কি বাংলাদেশি নাগরিকরা রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করেছে নাকি রোহিঙ্গাদের কোনো অংশ অবৈধ কোনো উপায়ে এনআইডি করে সিম কিনেছেন ?

তিনি অবশ্য বলছেন, এটা বিটিআরসি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অনুসন্ধান করে বের করে ফেলতে পারে। এতে তারা মোবাইল ফোন অপারেটররা সব রকম সহযোগিতা করবেন।

যদিও এদিকে রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ভুয়া ঠিকানা ব্যবহার করে জাতীয় পরিচয়পত্র এমনকি পাসপোর্টও বানিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে বেরিয়ে এসেছে।

রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলছেন, সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী জাতীয় পরিচয় তথ্যভান্ডার বা এনআইডিতে সংরক্ষিত তথ্যের সাথে বায়োমেট্রিক যাচাইকরণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরেই একটি মোবাইল সিম বিক্রি করা হয়। অর্থাৎ মোবাইল সিম কিনতে হলে একজন ব্যক্তির বৈধ জাতীয় পরিচয়পত্র থাকতে হবে।

তিনি বলছেন, সিম সংক্রান্ত যে কোনো সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র বৈধ নাগরিকদের আঙুলের ছাপ বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও এনআইডি ডাটাবেজে নিবন্ধন নিশ্চিত করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে।

মোবাইল অপারেটররা সবসময়ই বিটিআরসির নির্দেশনা মেনে চলে। এ ব্যপারে তারা নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে সম্ভব যথাযথ পদক্ষেপ নেবে উল্লেখ করে অ্যামটব মহাসচিব ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এস এম ফরহাদ বলেন, এনআইডি ডাটাবেসের সঙ্গে বায়োমেট্রিক নিশ্চিতকরণের পরেই কেবল মোবাইল সিম সক্রিয় করা যায়।

যদিও এই ‘এনআইডি’ ইস্যুতে কীভাবে ‘রোহিঙ্গা সিম’ প্রমাণ ও বন্ধ হবে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে এবারও কিছু বলেনি কোনো মোবাইল অপারেটর।

তবে রোহিঙ্গা সিম চিহ্নিত করতে একটি পদ্ধতি বাস্তবায়ন হতে পারে। মোবাইল অপারেটরগুলো রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় সচল থাকা-ব্যবহৃত হওয়া সিমগুলো চিহ্নিত করবে। এরপর সেই তালিকা তারা বিটিআরসিকে দেবে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেটি যাচাই-বাছাই করে বের করবে যে এগুলো রোহিঙ্গাদের ব্যবহৃত সিম। তারপর সেগুলো বন্ধ করে দেবে অপারেটরগুলো।

তবে এই ‘যাচাই’ কীভাবে সেটি এখনও চূড়ান্ত হয়নি।

এবার পরিস্থিতি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়া এলাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সেখানে প্রতি রাতে থ্রিজি-ফোরজি নেটওয়ার্কও বন্ধ করা হয়েছে।

সোমবার রাত থেকেই থ্রিজি-ফোরজি ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়টি মোবাইল অপারেটরদের কার্যকর করতে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। সেটিও প্রতি রাত করে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করা হবে।

এছাড়াও বিটিআরসি অপারেটরদের নির্দেশ দিয়েছে, মিয়ানমার সীমান্তের ভিতরে চলে যাওয়া বাংলাদেশী মোবাইল টাওয়ারের নেটওয়ার্ক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে।

এর আগে সোমবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় মোবাইল সেবা বন্ধ করতে অপারেটরদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সেটি কার্যকর করতে অপারেটরদের প্রতি বিটিআরসি ওই নির্দেশনা জারি করেছে।

বৈঠকে বিটিআরসি এবং মোবাইল অপারেটরদের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

২০১৮ সালের অক্টোবরের চিঠিতে বলা হয়েছিল,২০১৬ সালে মোবাইল কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্ক কাভারেজ কক্সবাজার সীমান্তের জিরো লাইনের মধ্যে রাখার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালে উদ্ভুত পরিস্থিতি এবং রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব বিবেচনায় কক্সবাজার এবং উখিয়া এলাকায় অস্থায়ীভাবে বিটিএস স্থাপনের অনুমতি দেয়া হয়। এছাড়া সীমান্তবর্তী এলাকা এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সিম বিক্রির ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময় বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে সরকার।

রোহিঙ্গাদের কাছে সিম বিক্রির বিষয়ে সেই সময়ের টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমও অপারেটরদের সতর্ক করেছিলেন।এরপর ২০১৭ সালে অপারেটরদেরও এ বিষয়ে বিশেষ নজরদারি করতে বলা হয়েছিল।

বায়োমেট্রিক নিবন্ধন ছাড়া সিম বিক্রির কোনো সুযোগ নেই উল্লেখ করে ওই চিঠিতে জানানো হয়, বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থা বর্তমানে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বিভিন্ন সিম বিক্রি ও ব্যবহারের তথ্য পেয়েছে।

সেই চিঠিতে অপারেটরগুলোকে মোবাইল নেটওয়ার্ক যেন মিয়ানমার পর্যন্ত না পাওয়া যায় এবং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মোবাইল নেটওয়ার্ক সুবিধা বন্ধ করে বিটিআরসিকে জানাতেও বলা হয়েছিল।

কক্সবাজারের বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে।