লিবিয়া’র বন্দিশালা থেকে মুক্তিপণে ছাড়া পেল যুবক শামীম

0
81

মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন, পেকুয়া থেকে
শামিম
ভাগ্য পরিবর্তণের আশায় বিদেশ যাবার স্বপ্ন বুনেছিলেন কক্সবাজারের পেকুয়ার যুবক শামীম আক্তার। স্বপ্ন সত্যি করতে সহায়তা নিলো স্থানীয় একটি চক্রের। ভালো চাকুরির প্রতিশ্র“তি দিয়ে কম টাকায় যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ লিবিয়ায় পাঠায় দালাল চক্রটি। তাদের সহায়তায় তিনি পৌছায় লিবিয়া বিমান বন্দরে। কিন্তু সেখান থেকে শুরু হয় স্বপ্ন ভঙ্গের অধ্যায়। বিমান বন্দর থেকেই চক্রটি তাকে নিয়ে যায় তাদের বন্দিশালায়। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য চলে অমানবিক নির্যাতন। দীর্ঘ ১৮ দিন পর ৮ লাখ টাকার বিনিময়ে মুক্তি পেয়ে লিবিয়ায় অবস্থান করছেন হতভাগা যুবক শামীম আক্তার। তিনি পেকুয়ার বারবাকিয়া ইউনিয়নের বোঘামাঝির গোনার মৃত আলী আহমদের ছেলে।

শুধু এক শামীম আক্তার নয় ওই দালাল চক্রের কারনে পেকুয়ার অর্ধশতাধিক যুবক সর্বস্ব হারিয়েছে। অনেকের এখনও সন্ধান পাওয়া যায়নি।

ভূক্তভোগীদের সূত্রে জানা যায়, পেকুয়া মানব পাচারকারীর বিশাল এক সিন্ডিকেট কাজ করে। যারা কাউকে তোয়াক্কা করে না। এই সিন্ডিকেটের চট্টগ্রম-ঢাকায় এজেন্সি রয়েছে। এই দালাল চক্রের সদস্যরা পেকুয়া থেকে শুরু করে লিবিয়া পর্যন্ত কাজ করে।

শামীম আক্তারের স্ত্রী জানান, পেকুয়ার সাবেদকগুলদি সরকারী ঘোনা এলাকার নাজির আহম্মদের ছেলে মোহাম্মদ দিদার দীর্ঘদিন আদম ব্যাপারীর কাজ করছে। তিনি শামীম আক্তারকে প্রলোভন দেখান যুদ্ধ বিধ্বস্থ দেশ লিবিয়ার গেলেই মোটা অংকের বেতনের চাকরি করতে পারবে। এছাড়া দিদারের পরিচিত আইয়ুব খান নামে এক ব্যক্তি লিবিয়া থেকে ফোন করে ওখানের সুযোগ-সুবিধার কথা বলেন। আর তিনিই নাকি শামীমকে চাকরি ধরিয়ে দেবে। আইয়ুব খান পেকুয়ার শিলখালী এলাকার বাসিন্দা। তাদের কথামত লিবিয়া যেতে দিদারকে ২ লাখ টাকা দেন শামীম আক্তার। আর ওই টাকা পাঠান লিবিয়া পৌছানোর মূল হুতা পেকুয়া ভারুয়াখালী এলাকার আবু ছৈয়দ নামে এক ব্যক্তির কাছে। আবু ছৈয়দ চট্টগ্রাম এবং ঢাকার এজেন্সি রয়েছে। ওসব এজেন্সির মাধ্যমেই লিবিয়ায় লোক পাঠানো হয়। টাকা দেওয়ার পরে গত ৩১ মার্চ মঙ্গলবার শামীম আক্তার বিমান যোগে লিবিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। তিনি দুবাই হয়ে গত ২ এপ্রিল বৃহস্পতিবার সকাল ১১ টার লিবিয়া বিমান বন্দরে গিয়ে পৌছান। লিবিয়ার বিমান বন্দরে পৌছালে তাকে বিমান বন্দরে গ্রহণ করতে যাওয়া লোকজন প্রথমেই তার মোবাইলটি কেড়ে নেয়। তাকে গাড়ি যোগে বিমান বন্দর থেকে ৪ ঘন্টার দূরবর্তী স্থানে নিয়ে যায়। রাতে ১০ টায় (বাংলাদেশ সময়) ফোন করে জানান, তাকে বন্দি করে নির্যাতন করা হচ্ছে। ৬ লাখ টাকা মুক্তিপন দিলে ছেড়ে দেওয়া হবে। চলে তার উপর নির্যাতন। আর ফোন করে শুনায় শামীমের আর্তনাদ। এভাবে চলতে থাকায় শামীমের আত্মীয়-স্বজনেরা দিদার, আবু ছৈয়দ, কবির ও হামিদ হাসানের সাথে যোগাযোগ করে। আবু ছৈয়দের সাথে যোগাযোগ করতে গিয়ে জানা যায়, তিনি একজন প্রতারক। দীর্ঘদিন আদম ব্যবসার নামে এই অপকর্ম চালাচ্ছে। এই প্রতারনার কারনে তিনি এলাকায় থাকেন না। তিনি ঢাকা-চট্টগ্রামে পলাতক হয়ে থাকেন। একাধিক মোবাইল নাম্বার ছাড়াও তার কাছে ৫-৬ টি নাম্বার রয়েছে। প্রতারনার কাজে তিনি এসব নাম্বার ব্যবহার করে। অপরিচিত নাম্বার রিসিভ করেন না। আর তার হয়ে কাজ করে দিদার, আইয়ুব (লিবিয়ায় অবস্থানরত) কবির ও হামিদ। এই চক্রটি প্রলোভন দেখিয়ে লোকজনকে প্রতিনিয়ত বিদেশ পাঠিয়ে মুক্তিপন আদায় করে। এসব খবর জানার পরে শামীমের আত্মীয়-স্বজনরা খুব বেশি আতংকিত হয়ে পড়ে। পরে দালাল দিদার ও তার স্ত্রী জিগারুর হাতে ৮ লাখ টাকা দিলে আড়ালে থাকা আবু ছৈয়দের মাধ্যমে ১৮ দিন পর গত ২০ এপ্রিল ছাড়া পায় শামীম আক্তার।

বন্দিশালা থেকে মুক্তি পাওয়া লিবিয়ায় অবস্থানরত শামীম আক্তার জানান, তিনি এখন হাজার কিলোমিটার দূরবর্তী স্থানে অবস্থান করছেন এক আত্মীয়ের সাথে। তিনি দেশে ফিরে আসার চেষ্টা করছেন। তিনি জানান, ওই বন্দিশালায় তারমত শতাধিক লোক রয়েছে। যাদেরকে বিদ্যুৎশক সহ নানাভাবে নির্যাতন করে মুক্তিপনের জন্য। তাদের সাথে আবু ছৈয়দ সহ বাংলাদেশের দালালদের সাথে মোবাইলে কথা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। অনেক বন্দির কাছ থেকে মুক্তিপন আদায় করতে না পেরে নিয়ে যাচ্ছে অন্যত্রে। যেখান থেকে আর ফিরে আনা হচ্ছে না। তারা খুবই বর্বর। ওখানে শুধু মারধর ছাড়াও কষ্ট দেওয়া হয় খাবার-দাবার নিয়ে। এমনও দিন গেছে সারাদিনে ২ গ্লাস পানি খেয়ে থাকতে হয়েছে। তিনি ভেবেছিলেন হয়ত এখানেই তার মৃত্যু হবে। ওখান থেকে ছাড়া পেয়ে তিনি ফিরে পেয়েছেন নতুন জীবন।

আবু ছৈয়দের সকল নাম্বার বন্ধ থাকায় তার চট্টগ্রাম এজেন্সি (আবাহা ওভারসী)’র দায়িত্বরত হামিদ হাসানের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি স্বীকার করেন আবাহা ওভারসীস এজেন্সিটি আবু ছৈয়দের ছিল। কিন্তু ২০০৪ সালের পর থেকে ওই এজেন্সি হামিদ হাসানের। ওখানে আবু ছৈয়দের কোন ভূমিকা নেই। মুক্তিপন আদায় এবং লিবিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ওসব বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান।

ঢাকার উত্তরাস্থ এজেন্সি (আবাহা ওভারসী)’র দায়িত্বরত মোহাম্মদ কবিরের মোবাইল নাম্বারে একাধিকবার ফোন করলেও তিনি মোবাইল রিসিভ করেননি। পরে তাদের টিএনটি নাম্বারে ফোন করলে রিসিভ করে জানান, আবু ছৈয়দ তাদের মালিক। এছাড়া তিনি কোন তথ্য দিতে রাজি নন। এমনকি এজেন্সিটি উত্তরার কোন জায়গায় রয়েছে তাও জানাবেন না।

আবু ছৈয়দের হয়ে কাজ করা স্থানীয় আদম ব্যাপারী দিদারের সাথে যোগাযোগ করলে তার নাম্বার বন্ধ থাকায় কথা বলা যায়নি। ওই দিদারই মুক্তিপনের টাকা লেন-দেন করেছিলেন।

পেকুয়া সদর থানার ওসি আবদুর রকিব জানান, তিনি বিষয়টি জানেন না। এই ধরনের কেউ কোন অভিযোগ দেননি। যদি এই ধরনের ঘটনায় কেই অভিযোগ করে তাহলে অবশ্যই আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।