শক্ত হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ নিলেন এরশাদ

0
97

শক্ত হাতে দলের নিয়ন্ত্রণ নিলেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দলের নেতৃত্বে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়ে দল পরিচালনার চাবি নিজের হাতেই তুলে নিলেন তিনি। ছোট ভাই জিএম কাদেরকে উত্তরসূরি ও রুহুল আমিন হাওলাদারকে নতুন মহাসচিব ঘোষণার পর এরশাদ রওশনসুবিধাবাদী ও সরকারের সুবিধাপ্রাপ্ত নেতারা বিদ্রোহের সুর তুললেও এরশাদের কঠোরতায় শেষ পর্যন্ত তারা পিছু হটেছেন। দলীয় মন্ত্রী ও এমপিরা সংসদীয় দলের বৈঠক ডেকে এরশাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা করলেও শেষতক এরশাদের নেতৃত্বের প্রতিই তারা নতজানু হয়েছেন। গতকাল সংসদীয় দলের বৈঠকে কিছু সময়ের জন্য হাজির হয়ে এরশাদ দলীয় এমপি ও মন্ত্রীদের কড়া বার্তা দেন। একই সঙ্গে তার সিদ্ধান্তই শেষ কথা বলে জানান। এরশাদ এমপিদের বলেন, তার সিদ্ধান্তের বাইরে গেলে তিনি তাদের বহিষ্কার করবেন। আর দল থেকে বহিষ্কার হলে কারও এমপি ও মন্ত্রিত্ব থাকবে না। এরশাদের এ কড়া হুঁশিয়ারির পরও বৈঠক থেকে বেরিয়ে বিরোধী দলের চিফ হুইপ তাজুল ইসলাম জানিয়েছিলেন, সংসদীয় দল এরশাদের সব সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে। তার এ বক্তব্য প্রকাশের কিছু সময়ের মধ্যেই তাকে ডেকে পাঠান এরশাদ। জানতে চান তিনি কেন এ বক্তব্য দিয়েছেন। পরে তাজুল এরশাদের সামনে নিজের আগের দেয়া বক্তব্য অস্বীকার করেন। একপর্যায়ে তাজুলকে নিয়েই গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এরশাদ জানান, আমৃত্যু তিনি সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। এ সময় এরশাদের পাশে থাকা কয়েকজন এমপিও এরশাদের নেতৃত্বের প্রতি সমর্থন জানান।
গত রোববার রংপুর সফরে থাকা এরশাদ ছোটভাই জিএম কাদেরকে তার উত্তরসূরি ঘোষণা করে তাকে দলের কো-চেয়ারম্যান করার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর দলে নয়া মেরূকরণ শুরু হয়। সরকারপন্থি বলে পরিচিত বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদপন্থি নেতারা এ ঘোষণায় নড়েচড়ে বসেন। শুরু হয় নানা তৎপরতা। পরের দিন রওশন এরশাদের বাসায় জরুরি বৈঠকে বসেন তারা। এ বৈঠকে রওশন এরশাদকে তারা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব করেন। এ বিষয়ে রওশন এরশাদের তেমন সম্মতি না পেলেও বৈঠক শেষে বেরিয়ে দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলু রওশনকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। তিনি জানান, দলের চেয়ারম্যান নিষ্ক্রিয় হওয়ায় সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। তার ঘোষণা অবৈধ বলে রংপুর থেকেই প্রতিক্রিয়া দেন এরশাদ। গতকাল দুপুরে ঢাকায় ফিরেই জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলুকে মহাসচিবের পদ থেকে অব্যাহতি এবং সাবেক মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারকে মহাসচিব করার ঘোষণা দেন। এরপরই দৃশ্যপট পাল্টাতে থাকে। বিকালে সংসদীয় দলের পূর্বনির্ধারিত বৈঠকে এরশাদ অংশ নেবেন না এমনটিই ভেবে নিয়েছিলেন রওশনপন্থি এমপিরা। কিন্তু এরশাদ নবঘোষিত মহাসচিব রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে ওই বৈঠকে উপস্থিত হন। দলীয় চেয়ারম্যান হিসেবে তার সিদ্ধান্তের বিষয়ে কড়া বার্তা দেন নেতাদের। সেখানে এরশাদের সিদ্ধান্তের বিষয়ে কিছুটা বাকবিতণ্ডা হলেও এরশাদের কঠোর অবস্থানের কারণে অন্যরা আর সুবিধা করতে পারেননি।
দলীয় সূত্র জানায়, দুদিনে এরশাদের নেয়া সিদ্ধান্তের বিষয়ে দলের ৩ জন মন্ত্রী, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ, সদ্য বিদায়ী মহাসচিব এবং রওশনপন্থি কয়েকজন এমপি আপত্তি জানান। তারা রওশন এরশাদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার প্রস্তাব করেন। যদিও বেশির ভাগ এমপি এবং নেতাকর্মীরা এরশাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানান। এরশাদের এ ঘোষণার পর তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও তাকে ফোন করে ধন্যবাদ জানান। দলীয় সূত্র জানায়, জিয়া উদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করার পর থেকে তিনি দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ছিলেন না। বরং তিনি সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে থাকতেন বলে দলের নেতাকর্মীরাই অভিযোগ করেন। দলের মহাসচিব হয়েও তিনি সরকারি দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেন এমন অভিযোগও রয়েছে। এ ছাড়া ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার ও প্রায়শই অবমূল্যায়ন করতেন। এ কারণে নিজ উদ্যোগে কোথাও দলের সভা-সমাবেশ বা সম্মেলন করতে পারেননি। গতকাল সংবাদ সম্মেলনে এরশাদও বাবলুর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাকে দায়িত্ব দেয়া হলেও সব কাজ আমাকে করতে হয়েছে। দায়িত্ব পালনে তিনি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে মহাসচিব পরিবর্তনের ঘোষণার পরেই শুরু হয় সংসদীয় দলের নাটকীয়তা। এরশাদকে ছাড়াই সংসদীয় দলের বৈঠক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দলের ৩ মন্ত্রী ও তাজুল ইসলাম চৌধুরী। কিন্তু বৈঠক শুরু হওয়ার আগে বেলা সাড়ে ৩টায় রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার কার্যালয়ে উপস্থিত হন এরশাদ। বিকাল পৌনে ৪টায় এরশাদ-রওশন দুজনের উপস্থিতিতে শুরু হয় সংসদীয় দলের বৈঠক। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রথমে রওশন এরশাদ জিয়াউদ্দিন বাবলুর দিকে প্রশ্ন ছোড়েন। বলেন, তুমি আমাকে কিভাবে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বানাও। আমি তো তোমাকে এটা বলিনি। বাবলু জবাবে বলেন, ম্যাডাম এটা নিয়ে মিডিয়া বেশি বাড়াবাড়ি করেছে। এরপর চুপ হয়ে যান বাবলু। বৈঠকে এরশাদ থাকা পর্যন্ত বাবলু আর কোনো কথা বলেননি। রওশন আরও বলেন, দলের চেয়ারম্যান যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। কিন্তু তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয় না। এ সময় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, উনি (এরশাদ) এভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। তখন এরশাদ বলেন, আমি এর আগে অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তখন কোনো প্রশ্ন উঠেনি। এখন কেন প্রশ্ন উঠবে? আর বাবলুর কিভাবে সাহস হয়, আমি বেঁচে থাকতে আরেকজনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করার। তিন বলেন, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সে সিদ্ধান্তই সঠিক থাকবে। এ নিয়ে কেউ ভিন্ন কিছু করতে চাইলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে। আর আমার জানামতে, দল থেকে বহিষ্কার করলে কেউ এমপি-মন্ত্রী থাকতে পারেন না। এরশাদের এই বক্তব্যের পরই চুপসে যান সবাই। বৈঠকের একপর্যায়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়, দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও এমপিদের নিয়ে যৌথসভা ডাকার। সেখানে আলোচনার মাধ্যমে করণীয় ঠিক করার। এরপর বিকাল ৪টা ২৫ মিনিটে হাওলাদারকে নিয়ে বৈঠক ত্যাগ করেন এরশাদ। বিরোধী দলীয় নেতার কার্যালয় বরাবর নিচে বিশেষ দূতের কার্যালয়ে গিয়ে বসেন তারা। এদিকে রওশনের নেতৃত্বে বৈঠক চলতে থাকে বিকাল ৪টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত। বৈঠক শেষে বিরোধী দলের হুইপ শওকত চৌধুরী বলেন, এরশাদের সিদ্ধান্তই সঠিক। এর বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা সবাই তার সঙ্গে একমত। এদিকে বৈঠক শেষ করে সংসদ থেকে বেরিয়ে যান তাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বলেন, এরশাদের সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করেছে সংসদীয় দল। এ সময় তার পাশে উপস্থিত ছিলেন-আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, জিয়া উদ্দিন বাবলু, মশিউর রহমান রাঙ্গা ও মুজিবল হক চুন্নু। এ বক্তব্য শুনেই বিশেষ দূতের কার্যালয়ে তাজুলকে ডেকে আনেন এরশাদ। এ ধরনের বক্তব্য দেয়ার জন্য তিনি তাজুল ইসলামকে ধমক দেন। পরে তাজুল বলেন, স্যার সাংবাদিকরা আমার বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা করেছে। তখন এরশাদ বলেন, আবার সঠিক বক্তব্য দিয়ে আসো। এ সময় তাজুলকে সঙ্গে নিয়েই সংসদ থেকে বের হন এরশাদ। বাইরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সামনে প্রথমে কথা বলেন তাজুল। তিনি বলেন, আমি এটা বলিনি। সাংবাদিকরা প্রতি উত্তরে বলেন, আমাদের কাছে রেকর্ড আছে। এ সময় এরশাদ পাশ থেকে বলেন, আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছি তাতে মৃত্যুর আগ পর্র্যন্ত অটল থাকবো।
এর আগে দুপুরে বনানীর কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এরশাদ বলেন, আমার স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। তিনি সংসদীয় দল চালাবেন। আমি পার্টি চালাব। আমাদের মধ্যে বিভেদের চেষ্টা করা হয়েছে। রওশন প্রেসিডিয়ামের কোনো বৈঠক ডাকেননি। সেখানে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। উনাকে দিয়ে তারা স্টেটমেন্ট দেয়ার চেষ্টা করেছিল। উনি স্টেটমেন্ট দেন না। এ পার্টিকে কেউ বিভক্ত করতে পারবে না। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে এরশাদ বলেন, জাপা ভাগ হবে না। এটা অসম্ভব। আমি জাপার চেয়ারম্যান। যারা এর আগে চলে গেছে, তাদের সঙ্গে ৮-১০ জন লোকও যায়নি। যে দুজন (ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু) দলে বিভ্রান্তির চেষ্টা করছেন, তাদের সঙ্গেও কেউ নেই। আজকের ঘটনায় জাপায় নবজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এরশাদ বলেন, জি এম কাদের পার্টির কো-চেয়ারম্যান। আমি তাকে যেটুকু দায়িত্ব দেব, তিনি ততটুকুই পালন করবেন। আর হাওলাদার এর আগেও তিনটি কাউন্সিল সফলভাবে সম্পন্ন করেছেন। তার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তাই তাকে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটির সদস্য সচিব নির্বাচিত করা হয়েছে। এরশাদ আরও বলেন, সর্বশেষ কাউন্সিলে কাজী জাফরকে আহ্বায়ক ও হাওলাদারকে সদস্য সচিব করেছিলাম। এর আগে ব্যারিস্টার আনিসকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছিলাম। হাওলাদারকে সরিয়ে দিয়েছিলাম। তখন তো গঠনতন্ত্রের কথা বলা হয়নি। এখন কেন বলা হচ্ছে। আমি পার্টির চেয়ারম্যান। আমার ক্ষমতা রয়েছে। আমি ৩৯ ধারা মোতাবেক যে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমি জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান করেছি। প্রেসিডিয়ামে সেটা পাস করিয়ে নেব। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদ ছাড়ার বিষয়ে এরশাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাকে সম্মান করেন। আমাকে সম্মানিত করেছেন। আমি উনাকে বলব, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি সারাদেশ ঘুরে বেড়াব। পার্টিকে শক্তিশালী করব। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জিএম কাদের, রুহুল আমিন হাওলাদার, প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আব্দুস সবুর আসুদ প্রমুখ।