শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা আজ

0
298

নিজস্ব প্রতিবেদক:: আজ শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা। প্রবারণা পূর্ণিমার স্নিগ্ধ চাঁদের আলোয় পরশে দুর হয়ে যাক অন্ধকার মুছে যাক সব অপসংস্কৃতি, ফিরে আসুক সভ্যতা, শান্তি ও অনাবিল সুখ মঙ্গল প্রদীপের স্বর্ণালী আলোয় বিনাশ হোক সকল অজ্ঞতা আর পাশবিকতা, ফানুসের পূণ্যালোকে আলোকিত হোক জীবন, দূরীভূত হোক সকল অন্ধকার-ধর্মান্ধতা।

বুদ্ধ বলেন, বর্ষাবাস সমাপ্তির পর তোমরা একত্রিত হয়ে প্রবারণা করবে। সেই থেকে বুদ্ধ প্রতিবছর বর্ষাব্রত পালন শেষে বাধ্যতামূলকভাবে প্রবারণা করার অনুজ্ঞা প্রদান করেন। বুদ্ধ বলেন, বর্ষাবাস শেষে তোমরা পরষ্পরের দোষ-ত্র“টি স্বীকার করে, পরষ্পরের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে। বড় ভিক্ষু ছোট ভিক্ষুর সামনে ছোট ভিক্ষু বড় ভিক্ষুর সামনে বসে উক্ত কথা গুলো উচ্চারণ করবে। এতে করে সকল ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়ে থাকে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায় নানা আচার-অনুষ্ঠানমালার মধ্যদিয়ে তাদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসবটি উদযাপন করবে। এটি আশ্বিনী পূর্ণিমা নামেও পরিচিত। তাদের মতে, প্রবারণা হলো আত্মশুদ্ধি ও অশুভকে বর্জন করে সত্য ও সুন্দরকে বরণের অনুষ্ঠান। এ প্রবারণা পূর্ণিমার পর দিন থেকে এক মাস দেশের প্রতিটি বৌদ্ধবিহারে শুরু হবে শুভ কঠিন চীবর দানোৎসব। প্রবারণা পূর্ণিমা উপলক্ষে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা করেছে। সন্ধ্যায় ফানুস উড্ডয়ন করা হবে।
প্রবারণা বৌদ্ধ ধর্মীয় বিধানে বিনয়ভিত্তিক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্রতকর্ম ও অনুষ্ঠান। এর অপর নাম আশ্বিনী পূর্ণিমা। প্রবারণার এ আবেদন বৌদ্ধ ভিক্ষু জীবনে অধিক গুরুত্ব পেলেও বৌদ্ধ নর-নারী, উপাসক-উপাসিকাদের জীবনেও এর গুরুত্ব কম নয়। শুধু ধ্যানের দিক থেকে নয়, আত্মশুদ্ধিতা, রিপু সংযম এবং আত্মোপলব্ধিতে এর অর্থবহ দিক আমাদের পূর্ণ মনুষ্যত্ব বিকাশে অনেক অবদান রাখে। এ উৎসবের আচার-অনুষ্ঠান তো আছেই, তার সঙ্গে আছে আমাদের আত্মশাসন ও আত্মবোধের মূল শিক্ষা। এ যেন এক জীবনবোধ তৈরির সর্বোত্তম শিক্ষা। কারণ শাস্ত্রে প্রবারণার অর্থে বলা হয়েছে, প্রকৃষ্টরূপে বরণ করা এবং নিষেধ করা। বরণ করা অর্থ হল, বিশুদ্ধ বিনয়াচারে জীবনকে পরিচালিত করার উত্তম আদর্শ গ্রহণ করা। আর নিষেধ করা অর্থ হল, আদর্শবান ও ধর্মাচারের পরিপন্থী কর্মগুলো থেকে বিরত থাকা অথবা ওইসব কর্ম পরিহার করা। অতএব অর্থের দিক থেকে প্রবারণার গুরুত্ব ও মর্যাদা অতীব মহান ও তাৎপর্যমণ্ডিত।

অন্যদিকে ত্রৈমাসিক বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুসংঘ আপন আপন দোষত্রুটি স্বীকারপূর্বক অপর ভিক্ষুসংঘের কাছে প্রকাশ করে এবং তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহ্বান জানায়। অর্থাৎ, ভিক্ষুরা জ্ঞাত অথবা অজ্ঞাতসারে যে কোনো অপরাধ করে থাকলে সেই অপরাধ স্বীকারপূর্বক প্রবারণা দিবসে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কারণ দৈনন্দিন জীবনাচারে চিত্ত নানা রকম অকুশলে আবিষ্ট হয়। তাই প্রতিটি মুহূর্তে চিত্ত জাগ্রত রেখে গুণের প্রতি আকৃষ্ট থাকার জন্যই এ প্রবারণার প্রবর্তন করা হয়। বুদ্ধের জীবদ্দশায় শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থানকালে তিনি ভিক্ষুসংঘের পালনীয় কর্তব্য হিসেবে এ প্রবারণার প্রবর্তন করেন।

বৌদ্ধ ধর্মীয় মতে, ভিক্ষু-শ্রামণ ও উপাসক-উপাসিকারা আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা- এই তিন মাস শীল, সমাধি ও প্রজ্ঞা সাধনার অধিষ্ঠান গ্রহণ করেন। এই তিন মাসে অষ্টমী, অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং ধ্যান, উপবাস ও সংযম শিক্ষার মধ্য দিয়েই তারা তাদের ব্রত অধিষ্ঠান সমাপন করেন। তাই ত্রৈমাসিক বর্ষাবাসব্রত অধিষ্ঠানের শেষ দিবসটিকেই বলা হয় বৌদ্ধ আভিধানিক শব্দে ‘প্রবারণা’। এটিকে বৌদ্ধ পরিভাষায় আশার তৃপ্তি বা অভিলাষ পূরণও বলা হয়।

প্রবারণা দিবসে বৌদ্ধরা সব ভেদাভেদ ভুলে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। পারস্পরিক একতা, মৈত্রী, ভালোবাসা ও বন্ধুত্বের ভাব নিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন করেন। হৃদয়কে অনেক বড় করে, চিত্তকে বিলিয়ে দেন। এর মাধ্যমে মনের মলিনতা দূর হয়, ধর্মীয় অনুভূতি জাগ্রত হয়। এতে চিত্তের সংকীর্ণতাও দূরীভূত হয়। বৌদ্ধরা সব মানুষের, বিশ্বের সব জীবের অখণ্ড সুখ, অখণ্ড কল্যাণ এবং সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল কামনা করেন।

প্রবারণার দিন বৌদ্ধরা পঞ্চশীল ও অষ্টশীল গ্রহণ করেন, পূজা দেন এবং ধর্ম শ্রবণ করেন। দানের জন্য বিহারে সুদৃশ্য কল্পতরু তৈরি করা হয়। সেদিনের ওই কল্পতরু হয় ধর্মীয় আবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই তাদের সামর্থ্যানুযায়ী ওই কল্পতরু বৃক্ষে নানা ধরনের দানীয় সামগ্রী বেঁধে দেন। এ কল্পতরু হচ্ছে জন্মচক্রের গতিধারায় উচ্চদিকে যাওয়ার চিত্তের একটি অবলম্বন। জীবের জীবনগতি যে বহু দীর্ঘ এবং বহু স্তরের মাধ্যমে এ জীবনচক্র অতিবাহিত বা প্রবাহিত হয় তারই নিদর্শনস্বরূপ এই কল্পতরু। এটিকে কল্পবৃক্ষও বলা হয়। পালিতে বলা হয়- কল্পরুক্ষ।

প্রবারণা পূর্ণিমার আরেকটি উৎসবময় দিক হল ফানুস উড্ডয়ন। বৌদ্ধশাস্ত্রমতে, বুদ্ধ বুদ্ধত্ব লাভের পর তার মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনার জন্য তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন। সেখানে তিনি তিন মাস মাতৃদেবীকে ধর্মদেশনা করেন। প্রবারণা দিবসেই তিনি ওই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে অবতরণ করেন। এ কারণেই বৌদ্ধরা প্রবারণা পূর্ণিমা তিথিতে ওই প্রতীকরূপে আকাশে প্রদীপ প্রজ্বলন করেন এবং ফানুস উত্তোলন করেন।

বৌদ্ধধর্ম হল মূলত শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা নির্ভরশীল ধর্ম। তাই বৌদ্ধমতে জীবনের সব ক্ষেত্রে জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা অপরিহার্য। কারণ অজ্ঞানতা, মূর্খতা ও অসৎকর্ম মানবজীবনে কখনও সুখ আনয়ন করতে পারে না, কখনও মানুষকে মহীয়ান করতে পারে না। দেশ ও সমাজকেও সমৃদ্ধ করতে পারে না। কারণ, অন্ধকার দিয়ে যেমন আলোকে আহ্বান করা যায় না, তেমনি অকুশল ও মন্দকর্ম দিয়ে কখনও সৎ, শুভ ও কল্যাণকে সম্ভাষণ করা যায় না। তাই বৌদ্ধরা তিন মাস প্রবারণা শিক্ষায় জীবনকে সত্য, সুন্দর ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করেন এবং অন্তর্মুখী শিক্ষায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেন। তারা সর্ববিধ মঙ্গল ও কল্যাণময়তাকে আহ্বান জানান। তারা অশুভ শক্তির বিনাশ করেন এবং শুভ শক্তির আরাধনা করেন। এটাই হল প্রবারণার মূলশিক্ষা। শুভ প্রবারণা পূর্ণিমার মৈত্রীময় শুভেচ্ছা।