সবখানে… রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

0
275

মির্জা ইমতিয়াজ শাওন, নিউজচিটাগাং২৪.কম:
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুররবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখনীতে বাঙালির জীবন যাপন, সংস্কৃতিকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি বাঙালির চিরদিনের হাসিকান্না, আনন্দ-বেদনারও রূপকার তিনি। জগতের সকল বিষয়কে তিনি তাঁর লেখায় ধারণ করেছেন। মানুষের এমন কোনো মানবিক অনুভূতি নেই যা রবীন্দ্রনাথের লেখায় পাওয়া যায় না। তাঁর সম্পর্কে কবি দীনেশ দাশ বলেছেন, ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা’। সভ্যতার সকল সংকটে রবীন্দ্রনাথ এক বিশাল সমাধান। অন্ধকারে এক বিরাট আলোর প্রদীপ। বাংলাভাষা ও সাহিত্যকে তিনি সারাজীবনের সাধনায় অসাধারণ রূপলাবণ্যমণ্ডিত করেছেন। অতুলনীয় ও সর্বতোমুখী প্রতিভা দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মানে উন্নীত করে বাঙালিকে এক বিশাল মর্যাদার আসনে নিয়ে গেছেন।

বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই সুদীর্ঘ সময়ের লেখা অথবা রবীন্দ্র রচনাবলী এখন ওয়েবসাইটে সহজলব্ধ। এই রবীন্দ্র রচনাবলীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা অসংখ্য ছোট গল্প, গান, উপন্যাস, নাটক এবং প্রবন্ধ ও রম্যরচনা আছে, যেগুলি পূর্বেই বিশ্বভারতী ও সাহিত্য আকাদেমি থেকে পুস্তক হিসাবে বহু খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর“আজ ২৫শে বৈশাখ,
আজ কবিগুরুর জন্মদিনে
রইল আমাদের প্রণাম, ও শ্রদ্ধাঞ্জলী……………..
হে নূতন,
দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ ।।
তোমার প্রকাশ হোক কুহেলিকা করি উদঘাটন
সূর্যের মতন ।
রিক্ততার বক্ষ ভেদি আপনারে করো উন্মোচন ।
ব্যক্ত হোক জীবনের জয়,
ব্যক্ত হোক তোমামাঝে অসীমের চিরবিস্ময় ।
উদয়দিগন্তে শঙ্খ বাজে, মোর চিত্তমাঝে
চিরনূতনেরে দিল ডাক
পঁচিশে বৈশাখ ।।”(সং)

২৫ বৈশাখ। বাঙালির আত্মিক মুক্তি ও সার্বিক স্বনির্ভরতার প্রতীক, বাংলাভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষের মূল নায়ক, কাব্যগীতির শ্রেষ্ঠ স্রষ্টা, দ্রষ্টা ও ঋষি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৪তম জন্মদিন। মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে ব্যতিক্রমী এই রবির কিরণে উজ্জ্বল হওয়া দিনটি এবার চট্টগ্রামসহ সারাদেশে জাতীয় ভাবে উদযাপিত হবে। এ উপলক্ষে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে সকাল ১০টায় কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার লেখা, দর্শন, চিন্তা, চেতনা তথা বহুমাত্রিক আলোকচ্ছটার ঔজ্জ্বল্যে ও মহিমায় বাঙালি জাতিসত্তা হয়েছে মহিমান্বিত ও গৌরবান্বিত, সেই বিশ্বখ্যাত কবি ১৫৪ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাই শুধু দুই বাংলার বাঙালিই নয়, পুরো ভারতবাসী এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ভাষাভাষী কবির এই জন্মবার্ষিকীর দিবসটি পালন করবে হৃদয় উৎসারিত আবেগ ও শ্রদ্ধায়। বুধবার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের পাশাপাশি কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, শাহজাদপুরের কুঠিবাড়ি, নওগাঁর পতিসর এবং খুলনার দক্ষিণডিহিতে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র জন্মবার্ষিকী পালনের লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্বকবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধী জোট নেতা বেগম খালেদা জিয়া জাতির উদ্দেশ্যে পৃথক বাণী দিয়েছেন।

রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,  বিরোধী জোট নেতা তাদের বাণীতে এই ক্ষণজন্মা কবির স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে বিস্ময়কর প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ। তার অন্তর্নিহিত জীবনবোধ ছিল সুতীক্ষ্ম। সেই তীব্র বোধে ধরা পড়েছে সমাজ, সংসার, রাজনীতি, সমাজনীতির নানা চিত্র। প্রেম-বিরহ, আনন্দ-বেদনাসহ মানব মনের অবগুণ্ঠিত অনুভূতির শৈল্পিক প্রকাশ ঘটেছে তার লেখনীতে। তার সৃষ্টিশীল কর্ম সর্বকালের, সব মানুষের। রবীন্দ্রনাথের বিশালতা এবং তার সৃষ্টির অপূর্ব মাধুর্যকে অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে হলে রবীন্দ্র চর্চার বিকল্প নেই। আমি আশা করবো জগৎ-সংসারকে জানতে নতুন প্রজন্ম রবীন্দ্র সাহিত্যে অবগাহন করবে, রবীন্দ্র চর্চায় থাকবে ব্যাপৃত। রবীন্দ্রচেতনার আলোকে ন্যায়ভিত্তিক-শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা পাবে-মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন আরো দৃঢ় হবে-এটাই কামনা করি।  বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ছিলেন শান্তির, মানবতার ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক। কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। সাহিত্যের সকল শাখায় তার অনন্যসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর দূরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তার সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখনি সমাজের অনাচার, অবিচার আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হতে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগায়

বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, ২৪ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের লেখনী আমাদেরকে উজ্জীবিত করেছে। জীবনের প্রতিটি সমস্যা-সঙ্কট, আনন্দ-বেদনা এবং আশা-নিরাশার সন্ধিক্ষণে রবীন্দ্রসৃষ্টি আমাদের চেতনাকে স্পর্শ করে।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে কালোত্তীর্ণ এ কবির সৃষ্টিকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। তাই তিনি কবিগুরুর অমর সৃষ্টি ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেন।
এদিকে জন্মের দেড় শতাধিক বছর পেরিয়ে এবং মৃত্যুর প্রায় ৭৩ বছর পরে রবীন্দ্রনাথ এখনো কেন প্রাসঙ্গিক-এ ব্যাপারে রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাঙালির এই কবি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেছিলেন যখন রাষ্ট্র ছিল পরাধীন, চিন্তা ছিল প্রথাগত ও অনগ্রসর, বাংলাভাষা ছিল অপরিণত। তিনি একাধারে এই ভাষা ও সাহিত্যকে বিশ্বমানে উন্নীত করার পাশাপাশি জাতির চিন্তা জগতে আধুনিকতার উন্মেষ ঘটিয়েছেন। বাঙালির মানস গঠনে পালন করেছেন অগ্রদূতের ভূমিকা। সত্য, সুন্দর, ন্যায় ও কল্যাণের পথে অভিসারী হয়ে ওঠার প্রেরণা যোগানোর মধ্যদিয়ে বাঙালি মননকে বিশ্বমানে উন্নীত করে জাতিকে আবদ্ধ করে গেছেন চিরকৃতজ্ঞতায়।
তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছেন, তাতে এই ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা, সকল ভাব-অনুভূতির প্রকাশ এবং নির্মল হাস্য-কৌতুকের বাহন হতে সমর্থ হয়েছে। দেড়শত বছর পেরিয়েও কবি আমাদের মাঝে চিরজাগরূক হয়ে আছেন।
রবীন্দ্র গবেষক ড. হায়াৎ মামুদ বলেন, রবীন্দ্রনাথের কাব্য প্রতিভার প্রধান ধর্ম মানবমূখিতা। তিনি প্রধানত কবি। কাব্যের মধ্যে তার মনের শ্রেষ্ঠ অংশের প্রকাশ। আবার তিনি ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গল্পকার, প্রবন্ধকার। তার মনের অপর অংশ সাহিত্যের ওইসব শাখায় বিকশিত। কাজেই তার সম্পূর্ণ মনকে বুঝতে হলে কাব্যের সঙ্গে অন্যান্য রচনা মিলিয়ে পড়তে হবে।
তিনি আরো বলেন, রবীন্দ্রনাথ অতুলনীয় এই জন্য যে, তিনি বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যে এবং বাঙালি সংস্কৃতির প্রশ্নে যেমন দিশারী পুরুষ, তেমনই শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি, নন্দনতত্ত্ব ধর্মচেতনা ও সমাজ চেতনা প্রশ্নেও তিনি অগ্রপথিক। জীবনকে তিনি মূলতঃ দেখেছিলেন সংগ্রাম হিসেবে নয় শান্তি হিসেবে।’
বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, কবিগুরুই আমাদের দিয়েছেন কথা বলার ভাষা, সুন্দর দেখার দৃষ্টি ও জন্মভূমিকে ভালোবাসার বোধ। শিখিয়েছেন কেমন করে বাসনা করতে হয় লালন, আশায় বাঁধতে হয় বুক এবং মানুষ ও প্রকৃতিকে করতে হয় আপন। কবিগুরু আমাদের কল্পনার প্রজ্ঞা দিয়েছেন, সৃষ্টির প্রেরণা দিয়েছেন, আর দিয়েছেন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের বন্দনা বাণী। আমাদের শিক্ষায়, নান্দনিক বোধে, সাংস্কৃতিক চর্চায়, দৈনন্দিন আবেগ অনুভূতির অভ্যাসে, একান্ত চিন্তার মননে এবং সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্পকলায় সারাক্ষণ আছেন তিনি আমাদের নিশ্বাসে-বিশ্বাসে, বুদ্ধি-বোধে-মর্মে-কর্মে। এ কারণেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চিরদিন আমাদের লোক। তাকে আমরা পাই প্রেম-ভালবাসায়, প্রতিবাদের ভাষায় আন্দোলনের অঙ্গীকারে এবং স্রষ্টার আরাধনার একনিবিষ্টতায়। তাকে আমরা আরো পেয়েছি আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে আত্মশক্তিরূপে। দেশমাতৃকার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার ব্রত বোধে। তাই তার জন্মদিন উদযাপন মানে বাঙালির আত্মপরিচয়ে প্রত্যয়দীপ্ত হওয়া। আগামীর পথে চলবার পাথেও অর্জন করা।
উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রবন্ধকার, নাট্যকার, গীতিকার, অভিনেতা, চারুশিল্পী, বাংলাভাষার আধুনিক রূপকার এবং মানবতাবাদী দার্শনিক। জমিদার বাড়ির সন্তান হয়েও সাহিত্য, সংস্কৃতিসহ বিশ্বমানবতার জন্য বলিষ্ঠ লেখনীর মাধ্যমে কবি বিশ্বে অমর হয়ে আছেন। যার প্রমাণ কবির সার্ধশত জন্মবার্ষিকী এ উপমহাদেশে পালিত হয়েছে বছরব্যাপী। শুধু এশিয়াতেই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ কবিকে নানাভাবে স্মরণ করছে।
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ায়ও কবির রচনাসমগ্র প্রকাশ করছে বড় বড় প্রকাশনা সংস্থাগুলো এবং বিভিন্ন দেশে কবিকে নিয়ে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে।
কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে তার গীতাঞ্জলি গ্রন্থের জন্য সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কবির গান-কবিতা, বাণী এই অঞ্চলের মানুষের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তির ক্ষেত্রে প্রভূত সাহস যোগায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে শুধু নয়, চিরকালই কবির রচনাসমূহ প্রাণের সঞ্চার করে। আমাদের প্রতিটি সংগ্রামেই শুধু নয়, কবির চিরায়ত রচনাসমগ্র আজীবন স্মরণের র্র্শীষতায় আবিষ্ট হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশকে কতটা হৃদয়ের গভীরে স্থান দিয়েছেন তা বোঝা যায় কবির অসাধারণ গানে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ কিংবা ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি তুমি এই অপরূপ রূপে আমায় দেখলে জননী।’
‘ওই মহামানব আসে/দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/মর্ত্য ধূলির ঘাসে ঘাসে ’নতুন মহামানবের আবির্ভাব বর্ণনাকারী বাংলা ভাষাভাষীর গন্ডি ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে মহামানব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন কবি।
‘আমি ভয় করব না, ভয় করব না, দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না’ কিংবা ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে।’ এইভাবে অসংখ্য গানের বাণীতে কবি মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন যুগে যুগে।
‘আজি এই প্রভাতে রবির কর, কেমনে পশিল প্রাণের পর, কেমনে পশিল গুহার আঁধারে প্রভাত পাখির গান, না জানি কেনরে এতোদিন পর জাগিয়া উঠিল প্রাণ, জাগিয়া উঠিল প্রাণ, ওরে উথলি উঠিল বারি।’ কবিতার এমনি অনুষঙ্গের মাধ্যমে বাঙালি জাতিতে সমৃদ্ধ করেন কবি।
বিশ্ববরেণ্য এই কবি পরবর্তীতে শিল্পের প্রতিটি শাখায় সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেন। সীমার মাঝে অসীমকে স্পর্শ করাই ছিল তার আজীবনের সাধনা।
তার লেখা ‘আমার সোনার বাংলা/আমি তোমায় ভালোবাসি’ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও প্রেরণা যুগিয়েছিল তাঁর অনেক গান। তার লেখা গান ভারতেরও জাতীয় সংগীত।
করিব গানে সমীকৃত হয়েছে কথার বৈচিত্র্যের সঙ্গে ভারতীয় ধ্রুপদী, বাংলা কীর্তন, বাউল ও লোকসংগীত এবং পাশ্চাত্য সংগীতের সুর। নৃত্যনাট্য নামের শিল্পটি তাঁরই উদ্ভাবন। পরিণত বয়সে চিত্রকলার যে-চর্চা তিনি করেন, তার অভিনবত্ব ও গভীরতা সকল সমালোচককে বিস্মিত করেছে। বারেবারে তিনি নিজেকে ছাড়িয়ে গেছেন। তার ভাবনা বারেবারে নতুন বাঁক নিয়েছে। ঈশ্বরে সমর্পিত তার গান নাস্তিকেরও উপভোগ্য, আবার তিনিই বলেছেন ‘ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো।’ মানবসভ্যতার যা কিছু বরণীয়, তাকেই গ্রহণ করেছেন তিনি, অকুণ্ঠচিত্তে আহরণ করেছেন কাছে দূরের নানান সংস্কৃতি থেকে।
পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ যিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেননি, তিনিই হয়ে ওঠেন স্মরণীয় শিক্ষাতাত্ত্বিক, গড়ে তোলেন বিদ্যালয়, তাকে রূপ দেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাতৃভাষাকে শিক্ষার বাহন করে নেন। পল্লী-পুনর্গঠনে তার প্রয়াস অতি আন্তরিক। কৃষি ও কুটির শিল্পের বিকাশে এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে তার প্রচেষ্টা অবিস্মরণীয়। পুত্র ও জামাতাকে তিনি বিদেশ পাঠিয়েছেন কৃষিবিদ্যা শিখতে, যন্ত্র দিয়ে চাষের পরীক্ষা করেছেন, তাঁতীদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেন বয়ন-বিদ্যালয়, চাষীরা যাতে সহজে ঋণ পায় তার জন্য স্থাপন করেছেন কৃষি ব্যাংক। শ্রীনিকেতনের সবটাই তার এই পুনর্গঠন-প্রক্রিয়ার নমুনা। এক সময়ে রাজনীতিতে তিনি যোগ দিয়েছেন সোৎসাহে, আদর্শগত কারণে পরে সরেও এসেছেন। তবে দেশবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবি কখনো ত্যাগ করেননি। জালিয়ানওয়ালাবাগের নির্মমতার প্রতিবাদ করতে যখন এগিয়ে আসেননি কোনো রাজনীতিবিদ, তখন তিনি নাইট উপাধি ফিরিয়ে দিয়ে নির্যাতিত মানুষের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ এই বাংলাদেশ ও দেশের মাটি, মানুষের এমন কোন দিক নেই, যা নিয়ে লিখেননি। তার ক্ষুরধার লেখার গতি আর বিষয়বৈচিত্রায় এই অঞ্চলের জীবনধারা, কৃষ্টি-সংস্কৃতির প্রাণভাণ্ডার চিরায়ত হয়ে ধরা দিয়েছে তার সৃষ্টিকর্মে।
রবীন্দ্র স্মৃতি বিজড়িত জেলাগুলো ছাড়াও দেশের সকল জেলায় কবির জন্মবার্ষিকী উদযাপনের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন আলোচনা সভাসহ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এসব অনুষ্ঠানে স্থানীয় রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ, শিল্পী, সাহিত্যিক ও গুণীজন উপস্থিত থাকবেন।
এসো শ্যামল সুন্দর,
আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা।
বিরহিণী চাহিয়া আছে আকাশে॥
সে যে ব্যথিত হৃদয় আছে বিছায়ে
তমালকুঞ্জপথে সজল ছায়াতে,
নয়নে জাগিছে করুণ রাগিণী॥
বকুলমুকুল রেখেছে গাঁথিয়া,
বাজিছে অঙ্গনে মিলনবাঁশরি।
আনো সাথে তোমার মন্দিরা
চঞ্চল নৃত্যের বাজিবে ছন্দে সে–
বাজিবে কঙ্কণ, বাজিবে কিঙ্কিণী,
ঝঙ্কারিবে মঞ্জীর রুণু রুণু॥…….