সরকারের বিলবোর্ড প্রচারণা…

0
103

বিবিসি বাংলা, ঢাকা
সরকারের বিলবোর্ড প্রচারণার ধরন নিয়ে বিতর্ক
শাহনাজ পারভীন >>বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রধান শহরগুলিতে বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডের চেহারায় গত ক’দিনে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।বিবিসি আ বি

গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর পাশে বিলবোর্ড জুড়ে চোখে পড়ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের গত সাড়ে চার বছরের নানা ধরনের উন্নয়নের খতিয়ান।
প্রচারণার এই ধরণ নিয়ে শহরে চলছে নানান জল্পনা কল্পনা।অন্যদিকে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো অভিযোগ করছে, কোন অনুমতি ছাড়াই তাদের এসব বিলবোর্ড ব্যবহার করছে আওয়ামী লীগ।

গত সাড়ে চার বছরে বিভিন্ন খাতে সরকারের উন্নয়নের প্রচারণায় ঢেকে দেওয়া হয়েছে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে বেশিরভাগ বিলবোর্ডে।ঢাকার শাহজাদপুর থেকে অফিস যাওয়ার পথে দুদিন আগে এধরনের বিলবোর্ড দেখে রীতিমতো বিস্মিত হয়েছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আলেয়া পারভীন।“প্রথমে বুঝতে পারিনি কী হচ্ছে। কেনই বা এগুলো লাগানো হয়েছে। পরে বুঝতে পারলাম এগুলো আওয়ামী লীগের সফলতার প্রচার। বিষয়টি আমার বেশ অস্বাভাবিক মনে হয়েছে।”

আলেয়া পারভীনের মতোই অবাক এসব বিলবোর্ডের ব্যবহারকারীরাও।

ঢাকার রাস্তায় প্রচুর বিজ্ঞাপন দেয় এরকম একটি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীনফোনের কর্পোরেট কমিউনিকেশনস বিভাগের প্রধান তাহমিদ হক জানিয়েছেন, ঢাকার রাস্তায় তাদের ভাড়া করা বেশ কয়টি বিলবোর্ড কোনোধরনের অনুমতি ছাড়াই ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তারা জানতে পেরেছেন।

“সবমিলিয়ে আমাদের কত বিলবোর্ড এভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে সে নিয়ে এ্যাড এজেন্সির মাধ্যমে আমরা জানবার চেষ্টা করছি।”

“আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হলে সেক্ষেত্রে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতাম”

তাহমিদ হক, গ্রামীনফোনের কর্পোরেট কমিউনিকেশন্স প্রধান

“আমরা বিষয়টিতে কিছুটা অবাক হয়েছি তা বলতেই হবে। আমাদের কিছুই জানানো হয়নি। আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হলে সেক্ষেত্রে আমরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে প্রস্তুত থাকতাম,” বললেন মিঃ হক।ঢাকা সিটি কর্পোরেশন দক্ষিণের মতে তাদের অঞ্চলে মোট বৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা ৮০৫টি। ঢাকা উত্তরেও এর সংখ্যা হাজারের কাছাকাছি। এর বাইরেও রয়েছে বহু অবৈধ বিলবোর্ড।

সিটি কর্পোরেশন থেকে বিলবোর্ড লিজ নিয়ে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিজ্ঞাপনের জন্য ভাড়া দিয়ে ব্যবসা করে ঢাকার কিছু বিজ্ঞাপন প্রতিষ্ঠান। তাদের বেশ ক’জনের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে কয়েকজন কথা বলতে রাজি হননি। আর কয়েকজন কথা বলতে ভয় প্রকাশ করেছেন।এদিকে ঈদের মৌসুমে অনেক প্রতিষ্ঠান তাদের সামগ্রীর বিজ্ঞাপন বেশ ঘটা করে প্রচার করছিল। এরকম পরিস্থিতিতে বিলবোর্ডগুলো কোন অনুমতি ছাড়া কেউ ব্যবহার করছে কিনা তা জানতে চাইলে, ঢাকা সিটি প্রশাসনিক কর্মকর্তা নজমুল ইসলাম বিবিসি বাংলাকে বলেন, “সিটি কর্পোরেশন বিলবোর্ড নানান অ্যাড এজেন্সিকে লিজ দেয়। আমরা নিয়মিত তাদের কাছ থেকে ভাড়া পাচ্ছি। তারপর কী হচ্ছে সেটি আমাদের দেখার দরকার নেই। ”অন্যদিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেছেন “এই ধরনের অভিযোগ যৌক্তিক নয়। আমার বিশ্বাস এখানে অবশ্যই অনুমতি চাওয়া হয়েছে।”তিনি আরও বলেন, “এখানে বিলবোর্ডে যা লেখা হয়েছে তা আওয়ামী লীগের সফলতার কথা। আমরা চ্যালেঞ্জ করছি যদি কেউ এখানে কোন মিথ্যা তথ্য দেখাতে পারে।”

তবে আলেয়া পারভীনের মতো আরও অনেক ঢাকাবাসী জানিয়েছেন এধরনের রাজনৈতিক প্রচারণা তারা আগে কখনো দেখেননি।

ইত্তে অ বি
দৈনিক ইত্তেফাক> ঢাকা সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, রাজধানীর ৯৫ ভাগ বিলবোর্ডই অবৈধ ।
সরকারি প্রচারণা নয় তথ্যমন্ত্রী বলেছেন, সরকার বা প্রশাসনের উদ্যোগে এ ধরনের কোন বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়নি
রাজধানী জুড়ে বিলবোর্ডে সরকারের সাফল্যগাথা প্রচার নিয়ে ব্যাপক হৈ চৈ শুরু হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে চলছে নানা আলোচনা। রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতায়ও এখন এই বিলবোর্ড। বিরোধী পক্ষ বলছে, অন্যের বিলবোর্ড দখল করে সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রচারণা চালানো হচ্ছে তা অসত্য, অর্ধসত্য ও মিথ্যা। আওয়ামী লীগের নেতারাও বলেছেন, বিলবোর্ডের একটি বক্তব্যও অসত্য প্রমাণ করতে না পারলে তাদের ক্ষমা চাইতে হবে। এভাবেই রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে বিলবোর্ড।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নাম-পরিচয় প্রকাশ না করে অভিযোগ করা হচ্ছে, তাদের ভাড়া নেয়া বিলবোর্ডে সরকারের সাফল্যগাথা প্রচার করা হয়েছে। এক রাতের মধ্যেই তাদের কিছু না জানিয়ে সরকারের পক্ষে কে বা কারা বিলবোর্ডের লেখা পরিবর্তন করেছে। এমন অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে এসব বিলবোর্ড কি আদৌ অনুমোদিত? কে তাদের অনুমোদন দিয়েছে? ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (বিএন) বিপন কুমার সাহা ইত্তেফাককে বলেন, রাজধানীতে যে বিলবোর্ড আছে, তার ৯৫ ভাগই অবৈধ। কারো বিলবোর্ড যদি বেদখল হয়ে থাকে, তারা সিটি করপোরেশনে অভিযোগ নিয়ে আসতে পারেন। তাদের অভিযোগ সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।

তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাককে বলেন, সরকারি বা প্রশাসনের উদ্যোগে কোন বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়নি। বেসরকারি পর্যায়ে বা ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকে হয়ত বিলবোর্ডের মাধ্যমে দলীয় প্রচারণা চালাচ্ছেন। গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেন, বিলবোর্ড দখল করে সরকারের চালানো প্রচারণা অসত্য। তার জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেছেন, একটা বিলবোর্ডও দখল করা নয়। আর কোন বক্তব্য অসত্য তা প্রমাণ করতে না পারলে তাদের জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। দেশের মানুষ তেমনটাই প্রত্যাশা করেন বলে উল্লেখ করেন হানিফ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় ১৫ হাজার বিলবোর্ড রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ১৪ হাজারই অবৈধ। বৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ২০০। এর মধ্যে ঢাকা উত্তর এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক হাজার, বাকি ২০০ অন্যান্য সংস্থার অনুমোদন দেয়া। অন্যসব বিলবোর্ডই অবৈধ।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক আখতার হোসেন ভুঁইয়া ইত্তেফাককে বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে প্রায় ৫শ বিল বোর্ড রয়েছে। বৈধ থেকে অবৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঈদের পর অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ অভিযান শুরু হবে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী আনসার আলী খান ইত্তেফাককে বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৫ শতাধিক বিলবোর্ড রয়েছে। প্রতিবছর জানুয়ারি মাসে টেন্ডারের মাধ্যমে এসব বিলবোর্ড বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থাকে ভাড়া দেয়া হয়ে থাকে। এখন বিজ্ঞাপনী সংস্থা কাকে ভাড়া দেয়, সে তথ্য সিটি করপোরেশনের কাছে নেই। আর গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইত্তেফাককে বলেন, তাদের অধিদপ্তর থেকে সরকারের সাফল্যগাথা নিয়ে কোন ধরনের প্রচার বা প্রচারণা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। তাই বিষয়টি তারা অবহিত নন।

রাজধানীর মানিকমিয়া এভিনিউ, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, মত্স্যভবন মোড়, পল্টন, গুলিস্থানসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন বিলবোর্ডে শোভা পাচ্ছে সরকারের সাফল্যগাথা। যদিও কারা এটি প্রচার করছে, তার কোন নাম-পরিচয় ব্যবহার করা হয়নি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সাবেক একজন সচিব ইত্তেফাককে বলেন, কোন মন্ত্রণালয় বিলবোর্ডে প্রচারণা চালাতে পারে না। এমনকি সরকারও এই প্রচারণায় যেতে পারে না। কারণ জনগণের টাকায় সরকার চলে। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে এসব প্রচারণা যে কেউ চালাতে পারেন।

বিলবোর্ডের দখল-বেদখল আর বৈধ-অবৈধ নিয়ে যখন বিস্তর আলোচনা তখন সেই বিলবোর্ডের মধ্যে ঢুকে পড়েছে প্রকাশ্য রাজনীতি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিগত জোট সরকারের আমলে বিলবোর্ড বাণিজ্যের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন একজনই। পুরো ঢাকা শহরে বিলবোর্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ ছিল তার হাতেই। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে কোন একক ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণে নেই এই বিলবোর্ড বাণিজ্য। ক্ষমতাধর কয়েকজনের পরিবারের সদস্যরাই এখন এগুলোর নিয়ন্ত্রক। খোদ সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল সূত্র থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তাদেরও কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশ রয়েছে এই অবৈধ বিলবোর্ড ব্যবসায়। আবার অবৈধ বিলবোর্ডের সঙ্গে যেহেতু ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা থাকেন, সে কারণে সেগুলো অপসারণ করতে গিয়েও নানা ঝক্কির মধ্যে পড়তে হয় বলে স্বীকার করেছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

আদালতের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছর জুনে অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদের অভিযানে নামে দুই সিটি করপোরেশন। কিন্তু পরের দুই মাসে পাঁচটি বিলবোর্ডের বেশি উচ্ছেদ করতে পারেনি দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর উত্তর সিটি করপোরেশন মাঠেই নামেনি। এভাবেই শেষ হয় অভিযান। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন (বিএন) বিপন কুমার সাহা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরেই অবৈধ বিলবোর্ডগুলোকে প্রচলিত আইনি কাঠামোর আওতায় নিয়ে আসার চেষ্টা করছি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো প্রয়োজনীয় ভারি যন্ত্রপাতি না থাকা। বিলবোর্ড উচ্ছেদের জন্য ৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন ক্রেন প্রয়োজন হয়। কিন্তু উত্তর সিটি করপোরেশনের এ ধরনের কোনো ক্রেন নেই। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একটি ক্রেন রয়েছে। প্রয়োজন হলে আমরা তাদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে কাজ করি।

মানব জমিন
মানব আ বি
বিলবোর্ড দখল, মালিকদের ক্ষতি ১৫০ কোটি টাকা
স্টাফ রিপোর্টার: দখল। ছিনতাই। অবৈধ কারসাজি। বেনামী আগ্রাসন। সিনাজুরি। জোরজুলুম। নানা মন্তব্য মিডিয়ায়। ব্যবসায়ী মহলে। পথ চলতি সাধারণ মানুষের। সংবাদ শিরোনামে, কথায় ঝরে পড়ছে বিস্ময়, বিক্ষোভ। রাতারাতি দখল হয়ে গেছে রাজধানীর শ’ শ’ বিলবোর্ড। বৈধ মালিকের বিজ্ঞাপন ঢেকে, আড়াল করে, সাঁটানো হয়েছে সরকারের সাড়ে চার বছরের উন্নয়নের বিবরণ, দলীয় স্লোগান, নেতা-নেত্রী ও দলীয় প্রতীকের ছবি। কারা এ কাজ করেছে তা নিয়ে মিডিয়ায় হেঁয়ালি করলেও দখলদার যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তা স্পষ্ট হয়েছে এর মধ্যে। তবে বিলবোর্ডগুলো থেকে তাদের দখলদারিত্বের অবসান কবে হবে কেউ বলতে পারছেন না। ব্যবসায়িক ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে বিলবোর্ড ব্যবহারকারী এজেন্সি ও বিজ্ঞাপনদাতারা এখন ঘোরতর আশঙ্কায়, কিন্তু মুখ খুলতে গিয়ে প্রকাশ করছেন অসহায়তা।
পাঁচ সিটি করপোরেশনে শোচনীয় পরাজয়ের পর হঠাৎ করেই আগ্রাসী প্রচার-তৎপরতা শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। রাজধানীর কোটি কোটি টাকার বিলবোর্ডগুলো দখল করে তা সরকারের সাফল্যগাঁথা দিয়ে ভরে তোলা ওই তৎপরতারই এক অংশ। সপ্তাহ খানেক ধরে চলছে এ প্রচার-দখল অভিযান। প্রতিদিনই চলছে। রাজধানী ছাড়িয়ে ক্রমে অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোতেও এ অভিযান চলবে বলে জানা যাচ্ছে বিভিন্ন সূত্র থেকে। দখল মানে দখল। তাই কোন ধার ধারে নি কেউ বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো বা বিজ্ঞাপনদাতাদের অনুমতি নেয়ার। কোন তোয়াক্কাও করেনি। ইচ্ছা হয়েছে, দখলে নিয়েছে। যে কেউ বলবেন কাজটি সংগত নয়, অবৈধ। কিন্তু ক্ষমতায় থাকায় দলের কেউ তা অসঙ্গত বা অবৈধ বলে ভাবছেন না। ভ্রূক্ষেপ করছেন না। এদিকে বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো ও বিজ্ঞাপনদাতারা এ নিয়ে ক্ষমতাসীন মহলকে চ্যালেঞ্জ করার ভাবনা মাথায়ও আনতে পারছেন না। অবস্থান অনুসারে এক একটি বিলবোর্ডে বছরে ব্যয় হয় তিন লাখ থেকে ৪০ লাখ টাকা। এখন এই দখল হয়ে যাওয়ায় বিলবোর্ডগুলো থেকে কবে আওয়ামী লীগ তাদের সাফল্যগাথা সারিয়ে নেবে, আর এতে তাদের কত ব্যয় হয়ে চলবে, সে সম্পর্কে কিছুই বলতে পারে না বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলো বা বিজ্ঞাপনদাতারা। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে দেখা ছাড়া কিছুই করার নেই তাদের। এ ঘটনায় তারা ছাড়াও ঢাকা সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারাও যে অস্বস্তিতে পড়েছেন তা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যাচ্ছে। বিভিন্ন বিজ্ঞাপন সংস্থার প্রতিনিধিরা মিডিয়ায় জানিয়েছেন, তাদের মক্কেল বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সহ বিভিন্ন বিজ্ঞাপনদাতা তাদের বিলবোর্ড দখল নিয়ে অভিযোগ করেছেন। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, প্রাথমিকভাবে প্রতি বর্গফুট ১২ টাকা হিসেবে সাড়ে সাত লাখ বর্গফুট বিজ্ঞাপন-স্থান ব্যবহারের চুক্তি করেছেন তারা। এ কাজ দেয়া হয়েছে মিরপুর ভিত্তিক স্পট গাইড ইভেন্টস নামের একটি কোম্পানিকে। কোটি কোটি টাকা খরচ হবে এ প্রচার অভিযানে। আর এ অভিযান চলবে দেশজুড়ে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের প্রতিটি সড়কপথের মোড়ে, সেতু ও ওভারব্রিজে সাঁটানো হবে সরকারের সাফল্যগাথা সংবলিত বিলবোর্ড, ফেস্টুন ও ব্যানারে। পত্রিকান্তরে এক সাক্ষাৎকারে আওয়ামী লীগের উপ প্রচার সম্পাদক অসীম কুমার উকিল বলেছেন, আমাদের প্রচারাভিযান চলতেই থাকবে। এর ৭৫ ভাগ থাকবে সরকারের সাফল্য সম্পর্কে, ২৫ ভাগ থাকবে দলীয় প্রচারণা বিষয়ক।
ওদিকে বাংলাদেশ আউটডোর অ্যাডভার্টাইজিং এস্টাব্লিশমেন্ট ওনারস্, এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ রাশেদ জানান, তাদের বেশির ভাগ বিলবোর্ড গত সাত-আট দিনের মধ্যে দখল হয়ে গেছে। তিনি বলেন, সাধারণত ঈদের আগে মক্কেলদের কাছ থেকে পেমেন্ট পাই। এখন এই দখরের কারণে তারা পেমেন্ট বন্ধ রেখেছেন। এ দখল চলতে থাকলে আমাদের ক্ষতি ১৫০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
মোহাম্মদ রাশেদ জানান, তাদের এসোসিয়েশনের সদস্য সংখ্যা ১৬৫। রাজধানীতে তাদের বৈধ বিলবোর্ড রয়েছে প্রায় দুই হাজার। তিনি বলেন, দখল হওয়া বিলবোর্ডগুলোতে সাঁটানো বিজ্ঞাপনে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীর ছবি। তাই এসোসিয়েশনের কোন সদস্যই এ নিয়ে মুখ খুলতে রাজি নন। মন্তব্য করে কি বিপদে পড়েন- এই ভয় তাদের। তবে এভাবে বিলবোর্ড দখলের ঘটনাকে তারা সবাই নজিরবিহীন বলে বর্ণনা করেন। একজন সদস্য বলেন, একটি বৈধ বিলবোর্ডের বিজ্ঞাপন ঢেকে নিজেদের বিজ্ঞাপন লাগাবার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়।
তবে আওয়ামী লীগ চাইছে, বিলবোর্ডগুলো আগামী নির্বাচন পর্যন্ত রাখতে। ঈদের পর ঢাকার সীমানা পেরিয়ে সারাদেশে বিলবোর্ডে প্রচারাভিযান চলবে। এরই মধ্যে ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহর চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় এসব বিলবোর্ড স্থাপন করা হয়েছে। বিলবোর্ড স্থাপন ও পরবর্তী ধাপে প্রচার-প্রচারণা খাতে সরকার মোট খরচ করবে ৬০ কোটি টাকা। এ অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা এখন চূড়ান্ত। প্রশ্ন উঠেছে, রাতারাতি বিলবোর্ডগুলো কিভাবে দখল করা হলো? এত বিলবোর্ডই বা কোথায় তৈরি হলো? তথ্য যোগাড় করা হয়েছে কোথা থেকে? কোত্থেকেই বা এলো মোটা অঙ্কের অর্থ? ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, বিলবোর্ডগুলো সম্পর্কে তারা কিছুই জানেন না। বিলবোর্ডগুলো আদতে কে লাগিয়েছেন ওই সম্পর্কেও তাদের কাছে অজানা। তাই অবৈধ বিলবোর্ডগুলো অপসারণে ‘কাগজে কলমে’ কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছেন, ‘সম্ভব’ হলে ঈদের পর অপসারণ করবেন তারা। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রশাসক আখতার হোসেন ভূঁইয়া মানবজমিনকে জানিয়েছেন, বিলবোর্ড লাগানোর বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে আমাদের কেউ কিছু জানায়নি। সরকার যদি উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরে এতে আমি কোন সমস্যা দেখি না। অবৈধভাবে কেউ কিছু করে থাকলে খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবো। তিনি বলেন, সরকার সিটি করপোরেশনে অনুদান দিয়ে থাকে। তাই উন্নয়নের চিত্র বিলবোর্ডের মাধ্যমে তুলে ধরা হলে দোষের কিছু নেই। এটাকে দলীয় প্রচারণার কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। বিলবোর্ড সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে নানা তথ্য মিলছে। বলা হচ্ছে একাধিক প্রতিষ্ঠান এতে জড়িত। এগুলোর একটি রাজধানী ইস্কাটনে অবস্থিত আপন কমিউনিকেশন। তাদের অফিসে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র সংবলিত এসব বিলবোর্ড, পোস্টার ও ফেস্টুন ডিজাইনসহ সব কাজই করা হয়েছে। অনেক আগে থেকেই এ কার্যক্রমটি শুরু করেছেন তারা। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে এ কোম্পানিটি ব্যক্তি উদ্যোগে এসব কাজ করছে বলে জানিয়েছেন তথ্য মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ স্থানীয় কর্মকর্তা। তিনি জানান, তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে আপন কমিউনিকেশনকে আমরা শুধু তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছি। এর বেশি কিছু আমাদের করতে হয়নি। আপন কমিউনিকেশন সূত্রে জানা গেছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সম্পাদক এই প্রকল্পের ক্রিয়েটিভ বিভাগের প্রধান হিসেবে রয়েছেন। তাকে সহায়তা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের একদল শিক্ষার্থী। ঈদের পর সারা দেশে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রচারে আরও উদ্যোগ নেবেন তারা। তাদের উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঈদের পরই আগস্টের শেষ সপ্তাহে বা সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রের পাশে বাণিজ্যমেলার মাঠে একটি সাত দিনের মেলার আয়োজন করা। মেলার মূল বিষয় হবে সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রদর্শন। এছাড়া, থাকবে ছয়টি বিভাগীয় শহরে বিলবোর্ড, ফেস্টুনসজ্জিত গাড়িতে করে রোড শো, রাস্তার পাশে মেলা, জেলা শহরে ওই জেলার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের চিত্র নিয়ে মেলা এবং প্রদর্শনের চিন্তা-ভাবনাও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ৩রা আগস্ট মধ্যরাত থেকে শুরু হয়ে সকাল পর্যন্ত বিলবোর্ড সাঁটানো হয়েছে। এ কাজে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা সহায়তা দিয়েছেন। ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা শহরে বৈধ বিলবোর্ডের সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। এর মধ্যে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে ৪০৩টি, বাকিগুলোর সবই উত্তর সিটি করপোরেশনের অধীনে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে সবচেয়ে বেশি বৈধ বিলবোর্ড রয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোন ও ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের। এসব কোম্পানির অর্ধেকের বেশি বিলবোর্ড দখল করে নিয়েছে সরকার বা আওয়ামী লীগ। এর বাইরে বিএসআরএম, কেএসআরএম, বাংলালিংক, রবি, বিডিডিএল ও এয়ারটেলসহ বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড দখল করে উন্নয়নের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এসব কোম্পানির প্রতিনিধিরা বিস্ময় প্রকাশ করে জানিয়েছেন, আমাদের পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচারের বিলবোর্ডগুলো ঢেকে দেয়া হলো? অথচ এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না। ইউনিলিভারের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে আমাদের প্রায় ১৫০টি বিলবোর্ড রয়েছে। প্রতিটি বিলবোর্ডের পেছনে ব্যয় হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। আমাদের এ ক্ষতি পোষাতে কাকে দোষ দেবো? কারণ দখল করা বিলবোর্ডগুলোতে কারও নাম উল্লেখ করা নেই। গ্রামীণফোনের শীর্ষ স্থানীয় এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঢাকা শহরে আমাদের অনুমোদিত ৯০টি বিলবোর্ড রয়েছে। আমাদের বিলবোর্ড কারা দখলে নিয়েছে এ সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।