সীমান্ত পেরিয়েছে ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা

0
47

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর সহিংসতার শিকার হয়ে প্রায় ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা দেশ ছেড়েছে। এদের মধ্যে প্রায় ৫০ হাজারই আহত বলে বার্তা সংস্থার এপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) হাইকমিশনার ভিভান তান বলেন, গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সহিংসতাপ্রবণ রাখাইন রাজ্য থেকে দেশটির আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলার মুখে প্রায় ৭৩ হাজার রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে দেশ ছেড়েছে। বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য নো ম্যান্স ল্যান্ডে এখনো হাজার হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মধ্যে কাজ করা বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মীদের বরাত দিয়ে এপি আরো বলছে, মিয়ানমার থেকে ৫০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা আহত অবস্থায় বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের মধ্যে অনেকেই বুলেটের আঘাতে আহত হয়েছে।

মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে পলায়ন অব্যাহত রয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গাদের ঢলে বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরগুলো ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। তারপরও আরো রোহিঙ্গা প্রতিদিন বাংলাদেশে আসছেই।
শাহ পরীর দ্বীপে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা বলছে, বোমা বিস্ফোরণ ও আগুনে পুড়িয়ে রোহিঙ্গাদের হত্যা করছে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী।

এর আগে গত বছরের অক্টোবরে সহিংসতার পর ৯০ হাজার মানুষ এ দেশে আশ্রয় নিয়েছিল। এবার এখন পর্যন্ত এলো প্রায় ৭৩ হাজার। এ ছাড়া গত কয়েক দশকে বিভিন্ন সময়ে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এদের অনেকেই উপকূলের বিভিন্ন নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের অবস্থান করছে। কিছু রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছে সারা দেশে। বিশেষত চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এদের উপস্থিতি বেশি। যদিও স্থানীয়দের ধারণা, এই সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে।

এদিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হামলা-নির্যাতন ক্রমাগতভাবে বাড়তে থাকার মুখে নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে সহিংসতার শিকার রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে জরুরি খাদ্য সরবরাহ কর্মসূচি স্থগিত করেছে জাতিসংঘ।

২০১২ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছিল জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। এতে আড়াই লাখ মানুষের খাদ্যের সংস্থান হতো। কিন্তু এ কর্মসূচি স্থগিত করায় তাদের খাদ্য নিরাপত্তায় চরম অনিশ্চয়তা তৈরি হলো।

গতকাল শনিবার ডব্লিউএফপির এক বিবৃতিতে বলা হয়, রাখাইন রাজ্যে সহিংসতায় অভ্যন্তরীণভাবে গৃহহীন দুই লাখ ৫০ হাজার এবং অন্যান্য অতিদরিদ্র মানুষের মধ্যে যে খাবার সাহায্য দেওয়া হতো, তা স্থগিত করা হলো। এদের মধ্যে রাখাইন রাজ্যেই বিভিন্ন ক্যাম্পে থাকা এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ডব্লিউএফপির খাবারের ওপরই নির্ভর করত, যাদের অধিকাংশই রোহিঙ্গা।

গত ২৪ আগস্ট রাতে রাখাইন রাজ্যে একসঙ্গে ২৪টি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি সেনা আবাসে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এই ঘটনার পর মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে।

জাতিসংঘ গত শুক্রবার তাদের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, মিয়ানমারে সহিংসতা শুরুর পর গত এক সপ্তাহে ৪০০ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৭০ জন ‘রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী’, ১৩ জন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দুজন সরকারি কর্মকর্তা এবং ১৪ জন সাধারণ নাগরিক।

রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে কর্মরত দাতা সংস্থার কর্মীরা জানান, জরুরি প্রয়োজনীয় বিভিন্ন সামগ্রী যেমন সুপেয় পানি, খাবারের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁদের অস্থায়ী আবাসস্থল বা শরণার্থী শিবিরগুলো মানুষে ভরে গেছে। এর ফলে নতুন আসা শরণার্থীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে, যা একটি গুরুতর সমস্যা।

একসঙ্গে প্রচুর মানুষ দেশে ঢোকার কারণে গর্ভবর্তী নারী, শিশু বা বৃদ্ধরা ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে। স্যানিটেশন এবং সুপের পানির ব্যবস্থা করা এই মুহূর্তে দাতব্য সংস্থার কর্মীদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

পালিয়ে আসাদের মধ্যে কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছোট ছোট নৌকায় করে নদী ও সমুদ্রপথে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছে। প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যে নৌকাডুবিতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে। এ পর্যন্ত নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৪০ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবু শরণার্থী মানুষের ঢল কমছে না।

জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। জাতিগতভাবে নির্মূল করতে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের গ্রামে আগুন দিয়ে বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়াসহ গণহত্যা ও গণধর্ষণ চালান সেনাবাহিনীর সদস্যরা। সহিংসতার শিকার হয়ে গত বছরের অক্টোবরে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

এর আগে ২০১২ সালের জুনেও রাখাইন রাজ্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় আক্রান্ত হয়েছিল। তখন প্রায় ২০০ রোহিঙ্গা নিহত হয়। ওই সময় দাঙ্গার কবলে পড়ে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছিল।