সীমাবদ্ধতার বৃত্তেই ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট

0
103

চমেক হাসপাতালের আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) শয্যা দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। গত ২ মার্চ মন্ত্রণালয়ের হাসপাতাল২ অধিশাখা এ নির্দেশ দেয়। অধিশাখার উপসচিব রেহানা ইয়াছমিন স্বাক্ষরিত ওই নির্দেশনায় (স্মারক নং৪৫.১৫৫.১১৪.০০.০০.০০৭.২০১৫১২৫) বলা হয়হাসপাতালে বিদ্যমান শয্যা সংখ্যার দ্বিগুণ আইসিইউ শয্যা সংখ্যা চালু করতে হবে। বর্ধিত আইসিইউ সেবা সুবিধা সম্প্রসারণের স্থান নির্ধারণ করতে হবে হাসপাতালের বিদ্যমান অবকাঠামোর মধ্যেই। বিদ্যমান চিকিৎসক এবং নার্সদের সমন্বয়েই এ বর্ধিত সেবা প্রদান নিশ্চিত করতে নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছে।

তবে মন্ত্রণালয় আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণ করার নির্দেশ দিলেও নানা সীমাবদ্ধতার বৃত্তেই আটকে আছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। তাদের দাবিহাসপাতালের বিদ্যমান অবকাঠামোতে আইসিইউ সেবা সম্প্রসারণের পর্যাপ্ত জায়গা নেই। তাছাড়া আইসিইউ সেবার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশিক্ষিত এ্যানেসথেসিস্টের সংখ্যাও পর্যাপ্ত নয়। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণ করা মোটেই সহজ কাজ নয় বলে জানান চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন। অবশ্য, বর্ধিত আইসিইউ সেবা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর, ইনফিউশন পাম্প ও সিরিঞ্জ পাম্পসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি সরবরাহ চেয়ে মন্ত্রণালয়ের নিকট চাহিদাপত্র পাঠাতে বলা হয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় এ কথা বলা হয়েছে।

নির্দেশনা অনুযায়ীঅবকাঠামো সংকট ও প্রশিক্ষিত এ্যানেসথেসিষ্টের অপর্যাপ্ত সংখ্যাসহ আইসিইউ শয্যা দ্বিগুণে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার বিষয়টি লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে বলে জানান হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জালাল উদ্দিন। জানতে চাইলে হাসপাতাল পরিচালক আজাদীকে বলেন, আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণ করতে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আমরা পেয়েছি। তবে অবকাঠামো সংকটসহ আমাদের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যার কারণে মন্ত্রণালয়ের এ নির্দেশনা বাস্তবায়ন খুব সহজ নয়। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে দুয়েকদিনের মধ্যে আমরা বৈঠক করবো। বৈঠকের পর বিষয়টি লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে, চমেক হাসপাতাল ছাড়াও দেশের সকল সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এই আইসিইউ সেবা সম্প্রসারণের কথা বলা হয়েছে নির্দেশনায়। মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলিতে আইসিইউ শয্যা সংখ্যা কমপক্ষে ২০ শয্যায় উন্নীত করতে এবং ২৫০ শয্যার সদর হাসপাতালগুলোতে (যেখানে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নেই) ১০ শয্যার স্ক্যানু চালু করতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

উল্লেখ্য, মুমূর্ষু রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) কেবল ভরসাস্থলই নয়, অপরিহার্যও। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে মুমূষূ রোগীদের এখানে বাচিঁয়ে রাখা হয়, বাঁচিয়ে তোলা হয়। কিন্তু চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ১২ শয্যার আইসিইউ বিভাগটি নিজেই যেনো মুমূর্ষূ। বিভিন্ন সংকটে বিপর্যস্ত এ বিভাগটি ধুঁকছে দীর্ঘদিন ধরেই। মোট ১২ শয্যার অর্ধেকই প্রায় সময় অকেজো থাকে। শয্যার সাথে অপরিহার্য ভেন্টিলেটর (কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসদানের যন্ত্র) ও অন্যান্য সরঞ্জামাদি নষ্ট হয়ে পড়ায় অচল হয়ে যায় এসব শয্যার সেবা। অথচ, চিকিৎসা সেবায় গরীবের একমাত্র ভরসাস্থল হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের এই হাসপাতালে দৈনিক কম হলেও একশ মুমূর্ষূ রোগীর জন্য আইসিইউ শয্যার আবেদনঅনুরোধ আসে। আর সাধারণ আবেদনকারীর পাশাপাশি অনুরোধকারীর কাতারে থাকেন মন্ত্রীএমপি এবং সচিবরাও। কিন্তু শয্যা সংকট তো আছেই, পাশাপাশি বিভিন্ন সংকটে যে কয়টি আছে তাতেও ঠিকমতো সেবা দিতে অপারগ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। এতে করে গরীবঅসহায় রোগীরা এই আইসিইউ চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছে। কারণ, নগরীর প্রাইভেট হাসপাতালক্লিনিকগুলোতে আইসিইউ সেবা নিতে হলে দৈনিক ৩৫ থেকে ৪৫ হাজার টাকা ফি গুনতে হয় রোগীর পরিবারকে। যা গরীবঅসহায় পরিবারের পক্ষে বহন করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। ফলে মুমূর্ষু আইসিইউ’র মতো ধুঁকে ধুঁকে মরতে হয় এসব অসহায় রোগীদের।

এদিকে, এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে চমেক হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা দ্বিগুণ করতে দৈনিক আজাদীর পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী পরিবার পিএইচপি ফ্যামিলি’র চেয়ারম্যান সুফী মিজানুর রহমানকে অনুরোধ জানানো হয়। আজাদীর অনুরোধের প্রেক্ষিতে হাসপাতালটির আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দ্বিগুণ করার প্রতিশ্রুতি দেন সুফী মিজানুর রহমান। প্রায় দুই বছর আগে তিনি এই প্রতিশ্রুতি দিলেও তখন থেকেই অবকাঠামো সংকট ও বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কথা বলে আসছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। ফলে দশটি আইসিইউ শয্যাসহ আনুষঙ্গিক সব সরঞ্জাম প্রদানে সুফী মিজানুর রহমান প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকলেও তা আর হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন সময় দৈনিক আজাদীতে একাধিকবার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। সর্বশেষ স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও স্বাস্থ্য সচিবকে বিষয়টি অবহিত করা হয় আজাদীর পক্ষ থেকে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সম্প্রতি (ফেব্রুয়ারিতে) অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় বিষয়টি চিরকুটের মাধ্যমে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম ও স্বাস্থ্য সচিব মো. সিরাজুল ইসলামের নজরে আনা হয়। পরবর্তীতে চলতি মার্চ মাসের শুরুতে সরকারি হাসপাতালের আইসিইউ শয্যা সংখ্যা দ্বিগুন করার এ নির্দেশনা জারি করলো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তবে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও এখনো একই সীমাবদ্ধতার বৃত্তে আটকে আছে চমেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

চমেক হাসপাতাল আইসিইউ বিভাগ সূত্রে জানা যায়আগে ১৮ জন নার্স তিন শিফটে দায়িত্ব পালন করলেও বর্তমানে বিভাগে ৩৫ জন নার্স দায়িত্ব পালন করছেন। এতে করে নার্স সংকট অনেকটা কেটে গেছে। তবে ন্যূনতম ছয় জন কনসালটেন্ট (সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালনের জন্য) প্রয়োজন হলেও বিভাগে মাত্র তিনজন কনসালটেন্ট (এ্যানেসথেসিস্ট) আছেন বলে জানিয়েছেন আইসিইউ বিভাগের সহকারি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশিদ।

ডা. হারুন অর রশিদ বলেন, বর্তমানে আমাদের আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র বারটি। অথচ, অপারেশনের বা জটিল ধরণের রোগীকে এখানে রাখতে হয়। প্রতিদিনই এমন রোগীর চাপ থাকে প্রচুর। ফলে জরুরি রোগীর ক্ষেত্রেও শয্যা পাওয়া দুর্লভ হয়ে পড়ে। তাছাড়া এখানে নাম মাত্র ফিতেই ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা সেবা পেয়ে থাকে রোগীরা। গরীবের একমাত্র ভরসাস্থল বলেই এখানে রোগীদের প্রচুর চাপ থাকে। তাই শয্যা সংখ্যা বাড়াতে পারলে এ অঞ্চলের বিশাল সংখ্যক মানুষ উপকৃত হতো। তবে শয্যা সংখ্যা বাড়ালেও এর সাথে প্রয়োজনীয় চিকিৎসকনার্স ও আনুষঙ্গিক সব সরঞ্জাম নিশ্চিত করতে হবে বলেও জানান তিনি।