সুখী জিনে লুকিয়ে থাকা রোমান্স

0
103

‘ইন আ রিলেশনশিপ’। ফেসবুকে এ ‘স্ট্যাটাস’ দিয়ে কী বোঝানো হয়, কম-বেশি সবাই জানি। অন্তত যারা ফেসবুকার, তারা সবাই তো বটেই!
বলা বাহুল্য, এ স্ট্যাটাস যিনি পোস্ট করছেন, তিনি পেশায় শিক্ষার্থী। বুড়োরা কিংবা বড়রা, মানে চাকরিজীবী—তারাও যে এ রকম স্ট্যাটাস দেন না বা দিতে পারেন না, তা বলছি না। কিন্তু ‘সম্পর্কে জড়ানোর’ এমন ঘোষণা মূলত শিক্ষার্থীরাই বেশি দেন। ওকে, তরুণ-তরুণীরা দেন। কারণ, এটাই তো তাদের উপযুক্ত সময়।
তা, শিক্ষার্থীরা জ্ঞান সন্ধানের পাশাপাশি রোমান্সও খোঁজে কেন? ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবাই কিন্তু সমান রোমান্টিক নয়। আবার সব ‘রিলেশনশিপ’ সমান সুখের হয় না। কেন? উত্তর খুঁজে ফিরছিলেন চীনের একদল বিজ্ঞানী। গবেষণা করে তারা উত্তর জানতে পেরেছেন। তারা বলছেন, তরুণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তারা এমন এক জিন খুঁজে পেয়েছেন, যা কিনা ছাত্রছাত্রীদের রোমান্সের জন্য দায়ী।
যে সব ছাত্রছাত্রীর এক জোড়া নির্দিষ্ট জিন আছে তাদের রোমান্টিক সঙ্গী পাওয়ার সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি।
চীনের পিকিং ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা আরও বলেছেন, পারস্পারিক সম্পর্ক গঠন ছাড়াও ব্যক্তিত্ব, পড়াশোনা, সম্পত্তি প্রভৃতির ওপর ওই জোড়া জিনের প্রভাব বিদ্যমান।
জিনটিকে বৈজ্ঞানিক মহলে ডাকা হয় 5-HTA1 নামে। চীনা বিজ্ঞানীদের ওই দলটি বলছে, এ জিনের কার্যকারিতা নির্ভর করে মানুষের মনমানসিকতা ও পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর। এখানে বলে রাখি, মানুষের মেজাজ-মর্জি নির্ভর করে মস্তিষ্ক নিঃসৃত সেরোটনিনের ওপর। এ সেরোটনিনের অন্যতম সংবেদী জিন হলো 5-HTA1 (সেরোটনিনের রাসায়নিক নাম হলো 5-HT , যার পুরো নাম হল 5-হাইড্রোক্সি ট্রিপ্ট্যামিন)।
চীনের বিজ্ঞানীরা দেখলেন, 5-HTA1 জিন আমাদের মেজাজ উঠা-নামা নিয়ন্ত্রণকারী হরমোন সেরিটোনিনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
রোমান্টিক জুটির মূলে সিসি জোড়
5-HTA1 জিনের আবার দুটি ধরন আছে। একটি সি (C) প্রকরণের, আরেকটি জি (G) প্রকরণের। সি প্রকরণটি জি হতে অপেক্ষাকৃত বেশি সেরিটোনিন নিঃসরণে ভূমিকা রাখে।
আমার-আপনার প্রত্যেকেরই এক জোড়া 5-HTA1 জিন থাকে। কারও ক্ষেত্রে দুটো জিনই সি প্রকরণের, কারো হয়ত জোড়া জি। আবার কারও বেলায় হয়ত জোড়া জিনের একটি সি এবং একটি জি এবং এ বিষয় মা-বাবার জিনোটাইপের ওপর নির্ভরশীল।
চীনের ওই বিজ্ঞানী দল ৫৭৯ জন হ্যান চাইনিজ শিক্ষার্থীর ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। দেখা গেল, যাদের এক জোড়া 5-HTA1 জিনের উভয়ই সি প্রকরণের—মানে জোড়া সি—তারা ‘ইন আ রিলেশনশিপ’ বা ‘সম্পর্কে জড়িত’। এ জোড়কে বলা হচ্ছে ‘সুখী জিন’।

রোমান্স জমজমাট : যদি দেখেন আপনার ফেসবুক বন্ধুটির স্ট্যাটাস ‘ইন আ রিলেশনশিপ’, তাহলে ধরে নিতে পারেন তাদের এক জোড়া সি প্রকরণের 5-HTA1 জিন আছে।
অন্যদিকে, যাদের এক জোড়া 5-HTA1 জিনের একটি কিংবা দুটি জিনই জি প্রকরণের, তাদের সম্পর্কে জড়ানোর সম্ভাবনা তুলনামূলক কম।
বিজ্ঞানীদের পরিসংখ্যান বলছে, সি-জি কিংবা জি-জি 5-HTA1 জিনওয়ালা শিক্ষার্থীদের রোমান্স করা বা রোমান্টিক সঙ্গী পাওয়ার সম্ভাবনা ৪০ শতাংশ কম।
নেচার গ্রুপের ‘সায়েন্টিফিক রিপোর্টস’ জার্নালে এ নিয়ে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে ২০ নভেম্বর। প্রবন্ধের প্রধান লেখক জিয়াওলিন ঝৌ। পিকিং ইউনিভার্সিটির এ মনোবিজ্ঞানী বলেন, যেসব মানুষ জি প্রকরণের জিন বহন করেন তারা স্নায়ুজনিত নানা রোগ ও হতাশায় ভোগেন। দুঃখবাদ, নিরাশাবাদ, স্নায়ুবিক রোগ ইত্যাদি যে কোনো সম্পর্কের উন্নতি, গুণগত মান, স্থায়িত্ব প্রভৃতির ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ। যেহেতু এ ব্যাপারগুলো ঘটে জি প্রকরণের 5-HTA1 জিনের কারণে, ঝৌ মন্তব্য করেছেন, ‘এ জিন বহনকারী মানুষ ব্যর্থ রোমান্টিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে।’
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী আলেকজান্ডার কোগানের বলেছেন, ‘সামাজিক আচরণের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র একটি জিন বিশেষত জিনের একটি প্রকরণ আমাদের মধ্যে এত বড় পার্থক্য সৃষ্টির করে—সত্যিই আবিষ্কারটি রোমাঞ্চকর।’
সুখী জিন যা বলতে পারে না
কারা সম্পর্কে জড়িয়েছে আর কারা জড়ায়নি, এটা বলে দিতে পারে 5-HTA1 জিনের ধরনটা। কিন্তু কারা নিঃসঙ্গ (সিঙ্গেল) থাকতে চায় আর কারা চায় সম্পর্কে জড়াতে—সেই পার্থক্য নির্দেশ করার ক্ষেত্রে কিন্তু এ ‘সুখী জিনের’ প্রভাব মাত্র ১.৪ শতাংশ।
ঝৌ ও তার সতীর্থ গবেষকেরাও বলেছেন, সুখী জিনের প্রভাব সব জাতির ক্ষেত্রে সমান নাও হতে পারে। যেমন তারা লিখেছেন, ১৯৮০ সালের দিকে চীনের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা প্রেম বা কোনো প্রকার রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াতে পারত না। তাদের জন্য এটা নিষিদ্ধ ছিল।
কিন্তু সেই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয় পরে। যেমন বিজ্ঞানী ঝৌর গবেষণায় যারা অংশ নিয়েছেন তারা সম্পর্কে জড়াতে পেরেছেন নিজেদের ইচ্ছা মতো।
সুখী জিন আরেকটি বিষয় বলতে পারে না। তা হলো, কোনো সম্পর্ক ঠিক কতদিন টিকে থাকবে। সম্পর্ক ভাঙ্গার পেছনে তো অনেক পরিস্থিতি ও কারণ থাকে। তাই আমরা এটা দিয়ে মোটেও নিশ্চিত হতে পারব না যে, যারা জোড়া সি প্রকরণের সুখী জিনধারী তারা সম্পর্ক চালিয়ে যাবে দীর্ঘদিন।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে যারা এ সুখী জিন ধারণ করেন, তাদের ৫০ শতাংশই রোমান্টিক সম্পর্কে বেশ স্থির, মানে চুটিয়ে প্রেম করেন। সেটাই বা কম কি?
বাই দ্য ওয়ে, আপনার ফেসবুকে স্ট্যাটাসে যেন কি লেখা? যদি ‘ইন আ রিলেশনশিপ’ হয় তাহলে আপনি সুখী জিনের অধিকারী। কেউ কেউ অবশ্য সুখী জিনওয়ালা হয়েও এ স্ট্যাটাস মারতে চান না। গোপন করা ছাড়া আর কি-ই বা কারণ হতে পারে তার। মানুষ কেন কিছু গোপন করে, সে নিয়ে না হয় কথা হবে পরে।
তথ্য সহায়তা : দ্য গার্ডিয়ান ও সায়েন্টিফিক রিপোর্টস।