সেরা অধিনায়ক মাশরাফি

0
106

অস্ট্রেলিয়ার সাবেক অধিনায়ক রিচি বেনো একবার বলেছিলেন, ‘অধিনায়কত্ব নব্বইভাগ ভাগ্য আর দশ ভাগ দক্ষতার ওপর নির্ভর করে। তবে তোমার যদি সেই দশ ভাগ না থাকে তাহলে ভুলেও অধিনায়ক হতে চেও না।’ ফুটবলের মহানায়ক পেলে বলেছিলেন, আপনি সেরাদের সেরা, এটা তখনই প্রমাণ হবে যখন আপনি চাপের মুখে নিজের সেরাটা বের করে দলের জন্য বিশ্বকাপটা জয় করতে পারবেন।’ ফুটবলে অধিনায়কের ভূমিকা খুব কম হলেও ক্রিকেটে দলের জয়-পরাজয় অধিনায়কের ওপরই নির্ভর করে। আর এই কারণেই ক্রিকেট মাঠে অধিনায়কত্ব নিয়ে আলোচনাও থাকে তুঙ্গে।

চার যুগ বয়সী ওয়ানডে ক্রিকেট অসংখ্য তারকা জন্ম দিয়েছে। তবে যারা দেশকে নেতৃত্ব দিয়ে সোনালী ট্রফিটা জিততে পেরেছেন তারাই অমর হয়ে আছেন ইতিহাসের পাতায়। যাদের দক্ষতা ও বুদ্ধিদীপ্ত চিন্তা চেতনার কারণে দেশ বিশ্বমঞ্চে সেরা হয়েছে তাদের মহানায়কের আসনে আসীন করেছেন ভক্তরা। কপিল দেব, ইমরান খান, অজুর্না রানাতুঙ্গা এমনই কয়েকজন এশিয় মহানায়ক। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে নিজ দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে তারা সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছেন।

ভারতের ক্রিকেট ইতিহাসে কপিল দেব বা মহেন্দ্র সিং ধোনি, পাকিস্তানের ইমরান খান, শ্রীলংকার ক্ষেত্রে সেটা অজুর্না রানাতুঙ্গা। সবাই কিংবদন্তি, বিশ্বসেরা। বাংলাদেশের ভক্তরা সেই আসনেই বসিয়েছেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে। অসামান্য, অসাধারণ পর্যায়ের সাফল্য না থাকলেও বাংলাদেশের জন্য মাশরাফি যা করেছেন সেটাকে বীরোচিতই বলা যায়। ‘ভাঙাচোরা’ কিংবা ‘সাধারণ’ একটা দল ম্যাশের অধিনায়কত্বেই হয়ে উঠছে জায়ান্ট কিলার। এই কারণেই বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা অধিনায়কের খেতাব পেয়েছেন ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ খ্যাত মাশরাফি।

২০০৯ সালের শুরুতে অধিনায়কের দায়িত্ব পান মাশরাফি। সেবার মোহাম্মদ আশরাফুলের স্থলাভিষিক্ত হন তিনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে বাংলাদেশ সেই ম্যাচে জিতলেও হাঁটুতে চোট পেয়ে মাঠ ছাড়েন ম্যাশ। ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাঠের বাইরে ছিলেন। ২০১৪ সালে মাশরাফি দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব নেওয়ার পরই বদলে যায় লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ম্যাশ দায়িত্ব নেওয়ার পর ঘরের মাঠে টানা পাঁচটি ওয়ানডে সিরিজ জেতে বাংলাদেশ। সেবার ভারত, পাকিস্তান, দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারায় টাইগাররা। বিশ্বকাপে প্রথমবার কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠা এবং লাল-সবুজের চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনাল স্বপ্ন ছুঁয়ে দেখেছিল নড়াইল এক্সপ্রেসের নেতৃত্বেই।

সমালোচকরা বদলে পারেন সাকিব, তামিম, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহর মতো দুর্দান্ত কিছু ক্রিকেটার পেয়েছেন মাশরাফি। তবে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই ফুলগুলিকে এক সুতোয় গেঁথেছেন ম্যাশই। বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রধান রূপকার তিনিই। তামিম-সাকিবরা ছিলেন তবে দলীয় সাফল্য এসেছে মাশরাফির হাত ধরেই।

এবারের বিশ্বকাপে মাশরাফিকে ঘিরেই স্বপ্নের জাল বুনছে বাংলাদেশ। ১৯৮৩ সালে অতি সাধারণ এক দল নিয়ে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। দলে বড় কোনো তারকা ছিলেন না। এমনকি ইংল্যান্ডে যাওয়ার আগে গাভাস্কার-সন্দীপ পাতিলরা বিশ্বকাপ জয়ের কথা চিন্তাও করেননি। ১৯৯২ সালে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ের গল্পটাও ঠিক তেমনই। ইনজামাম, ওয়াসিম আকরামসহ তরুণ কয়েকজন ক্রিকেটার নিয়ে বিশ্বকাপ মিশন শুরু করে দলটি। নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে পুরো টুর্নামেন্ট দারুণভাবে খেলে শিরোপাও জিতে নেয় ইমরান খানের দল।

১৯৯৬ সালে শ্রীলংকাকে অমরত্ব প্রদান করে অজুর্না রানাতুঙ্গার ক্রিকেটীয় মস্তিষ্ক। জয়সুরিয়াকে দারুণভাবে ব্যবহার করেন তিনি। সেই সঙ্গে ডি সিলভা, গুরুসিনহাদের নিয়ে মিডল অর্ডারটাকে দূর্গ বানিয়ে ফেলেন এই ব্যাটসম্যান রানাতুঙ্গা। যে দলটার গ্রুপ পর্বই পেরুনোর কথা নয় সেই দলটাই কিনা স্টিভ ওয়াহ, পন্টিং, বেভানদের নিয়ে গড়া অস্ট্রেলিয়াকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়ে শিরোপা ছিনিয়ে নেয়। কপিল-ইমরান-রানাতুঙ্গারা পারলে মাশরাফি কেন পারবেন না!

তিন ফরম্যাটের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার রয়েছেন তার দলে, রয়েছেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে তুখোড় ওপেনার তামিম ইকবাল। মিডল অর্ডারে সাকিব, মুশফিক, মাহমুদুল্লাহদের সমন্বয়ে গড়া এক প্রাচীর, সেই সঙ্গে সৌম্য, সাব্বির, লিটন দাসদের মতো একঝাঁক প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান। বোলিং বিভাগে মাশরাফি তো থাকছেনই, তাকে সঙ্গ দেবেন বুদ্ধিদীপ, কাটার মাস্টার, ইয়র্কারে দক্ষ মুস্তাফিজুর রহমান। ইংলিশ কন্ডিশনে আগুন ঝরাতে প্রস্তুত রুবেল হোসেন, মাত্র কয়েকটা ম্যাচ খেললেও আবু জায়েদ রাহী দেখিয়ে দিয়েছেন বৈচিত্র, সুইং, গতিতে তিনিও কারো চেয়ে কম নন। স্পিনে সাকিবকে সঙ্গ দেবেন ক্রিকেটের বাংলাদেশের বিস্ময় বালক খ্যাত মেহেদী হাসান মিরাজ। দলে রয়েছেন কার্যকর অলরাউন্ডার মোসাদ্দেক হোসেন সৈকত। আয়ারল্যান্ড সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তো তার ঝাল ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে!

এবারের বাংলাদেশ দলে অভিজ্ঞতা ও প্রতিভার ছড়াছড়ি। এই দলটিকে দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা দল বলা হচ্ছে। সাকিব-তামিম-মুশফিকরা ফুলের মতো সুগন্ধ ছড়াচ্ছেন। মাশরাফির কাজ হচ্ছে ফুলগুলোকে এক সুতোয় গেঁথে মালা তৈরি করা, যেটা এর আগেও অনেকবারই করেছেন তিনি। এই টুর্নামেন্টেও মাশরাফি যদি ভালোভাবে মালাটা গাঁথতে পারেন তাহলে অধরা বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্নটা এবার পূরণ হতেই পারে। ক্যাপ্টেন ম্যাশের প্রতি সেই ভরসাটা দেশবাসীর রয়েছে। টাইগারদের প্রতিটি ম্যাচে প্রার্থনায় বসবে লাখো-কোটি বাঙালী। ক্রিকেট ‘ঈশ্বর’ এতোগুলো হাতকে নিশ্চয় ফিরিয়ে দেবেন না! এবার কেবল মাঠের লড়াইয়ের অপেক্ষা। খেলবে টাইগার! জিতবে টাইগার!