সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে

0
78

আজ ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। ‘চালকদের বেপরোয়া গতি, পথচারীদের অসতর্কতা, লাইসেন্স প্রদানকারী কর্তৃপক্ষের অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থা, আইন প্রয়োগে শিথিলতা, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন ও মালিকপক্ষের নানা অব্যবস্থাপনা’।
-সেই ২০১৪ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার এই সাতটি কারণ চিহ্নিত করা হয়েছিল। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, চিহ্নিত কারণগুলোর ওপর জোর দিলেই চট্টগ্রামসহ সারাদেশে প্রায়-প্রতিদিন সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা কমে আসত। কিন্তু এই নিয়ে যেন কারো কোন মাথা-ব্যথা নেই। ফলে বন্ধ হচ্ছে না সড়ক দুর্ঘটনাও। এতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যাও। তবে অনেকে বলছেন, সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সামগ্রিকভাবে উদ্যোগ নিতে হবে। এক্ষেত্রে কেবল চালকদের দোষারোপ করলে চলবে না। পথচারী-যাত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকেই সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারণ অনেক ক্ষেত্রে দুর্ঘটনার জন্য পথচারী কিংবা যাত্রীও দায়ী থাকেন।
আজ ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘দোষারোপ নয়, দুর্ঘটনার কারণ জানতে হবে, সবাইকে নিয়ম মানতে হবে’। এদিকে ২২ অক্টোবর দিনটিকে ‘জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস’ হিসেবে গেজেট আকারে ঘোষণা করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামের একটি সংগঠন। জাতীয় সড়ক নিরাপদ কাউন্সিলের ৮ম সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলেও তা এখনো বাস্তবায়ন হয় নি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে বিষয়টি আটকে রয়েছে। এ নিয়ে সংগঠনটি মানববন্ধন, প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি, গণস্বাক্ষর অভিযানসহ নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে।
সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান
নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির (এনসিপিএসআরআর) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ২শ ৪৫ জন মারা যান। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ নামে একটি সংগঠনের জরিপ অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে ২০১৬ সালের ২১ অক্টোবর পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় ছোট-বড় মিলে প্রায় ১ হাজার ৯ শ ৬৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় ২৭৬ জন।
এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত ‘যাত্রী কল্যাণ সমিতি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘গত ঈদ যাত্রায় (ঈদুল আযহা) সারাদেশে ১৯৩ সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৮ জন প্রাণ হারান। সংগঠনটির গত বছরের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০১৫ সালে দেশে প্রতিদিন গড়ে ১৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত হন।
এতে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১২ মাসে ৬ হাজার ৫৮১টি ছোট-বড় সড়ক দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। এতে ৩০ হাজার ৪৯৭ জন যাত্রী, চালক ও পরিবহন শ্রমিক সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৮ হাজার ৬৪২ জন আর আহত হয়েছেন ২১ হাজার ৮৫৫ জন। এর মধ্যে হাত বা পা হারিয়েছেন বা অন্য কোন অঙ্গ হারিয়ে চিরতরে পঙ্গু হয়েছেন ১ হাজার ৩০৫ জন। এছাড়া গত বছর ঢাকা চট্টগ্রাম-মহাসড়কে ১ হাজার ৭৬৭টি সড়ক দুর্ঘটনা হয়েছে।
গত বছর সংঘটিত সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে ৫৬ ভাগ, শহর এলাকায় ২৩ ভাগ, গ্রাম বা ফিডার রোডে ২১ভাগ সংঘটিত হয়েছে। তবে শহর এলাকা ও গ্রামে হাট বাজার এলাকায় ফুটপাত দখলের কারণে এবং বাসে ব্রেক না থাকায় পথচারীর মৃত্যুর হার ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। এছাড়াও এসব দুর্ঘটনায় নিহতের প্রায় ৫২ ভাগই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
সড়ক দুর্ঘটনার কারণ
অদক্ষ চালক এবং তাদের অনিয়ন্ত্রিত ওভারটেক, ফিটনেসবিহীন যানবাহনই মূলত সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। পাশাপাশি পথচারীদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে অসচেতনতার জন্যও ঘটছে দুর্ঘটনা। তবে সচেতন মহলের অভিযোগ, বিআরটিএ এবং ট্রাফিক বিভাগের সুষ্ঠু তদারকির অভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এদিকে মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে জানা গেছে, ‘দুর্ঘটনা হ্রাসকল্পে‘ এবং চালকদের নিয়ন্ত্রণে সড়কে তিন প্রকার ট্রাফিক সাইন (সংকেত চিহ্ন) থাকার কথা। কিন্তু চট্টগ্রামের বিভিন্ন মহাসড়কগুলো থেকে হ্রাস পাচ্ছে এসব চিহ্ন। কোথাও কোথাও সংকেত চিহ্ন থাকলেও এসব বিষয়ে জ্ঞান নেই অনেক চালকেরই। বরং বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছেন তারা। ফলে বিভিন্ন সময়ে এসব বেপরোয়া গতির যানের কারণে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
এদিকে ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নিয়মানুযায়ী মহাসড়কে তিন ধরনের সংকেত চিহ্ন থাকবে। এর মধ্যে ৮ ধরনের বাধ্যতামূলক হ্যাঁ বাচক চিহ্ন, ৩২ ধরনের বাধ্যতামূলক নিষেধ চিহ্ন, ১৮ ধরনের সতর্কীকরণ চিহ্ন, ২৮ ধরনের সতর্কতামূলক চিহ্ন এবং ২৪ ধরনের তথ্যমূলক চিহ্ন রয়েছে। এসব চিহ্ন চালকদের নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধে সহায়তা করবে।
সড়ক ব্যবহার বিধি’র আইন অনুযায়ী, চালকদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার আগে এসব সংকেত চিহ্নগুলো সম্পর্কে জ্ঞান আছে কি না তা যাচাই করে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট লাইসেন্স প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে। অভিযোগ রয়েছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অসদুপায়ী কর্মকর্তারা লাইসেন্স দেওয়ার আগে সংকেত চিহ্ন সংক্রান্ত জ্ঞান আছে কি না তা যাচাই করে দেখেন না।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, নগরীর অধিকাংশ চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এছাড়া গাড়ির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সার্টিফিকেট অব রেজিস্ট্রেশন (ব্লু বুক), তৃতীয় পক্ষ বীমা, ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সার্টিফিকেট, রুট পারমিট, বাসের জন্য কন্ডাক্টর লাইসেন্স এবং পি,এস,ভি ব্যাজ ছাড়াই নগরীসহ আশ পাশের এলাকায় অধিকাংশ যান চলাচল করছে। ফলে অদক্ষ চালক এবং ফিটনেসবিহীন এসব যানের কারণেই প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
নিরাপদ সড়ক চাই চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক শফিক আহমেদ সজীব দৈনিক আজাদীকে বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা এখন দেশের জাতীয় সমস্যা। কিন্তু আগামীতে এটি মহামারী আকার ধারণ করবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে। অথচ দুর্ঘটনা কমানো কিংবা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে, সর্বক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে গণজোয়ার সৃষ্টি করতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ এখনই সময় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার।
আজকের কর্মসূচি
নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চট্টগ্রাম মহানগর কমিটি জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে সড়ক দুর্ঘটনা রোধকল্পে জনসচেতনতামূলক গাড়ি চালকদের চক্ষু ও স্বাস্থ্য পরীক্ষাসহ চিকিৎসা ক্যাম্প, পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমাবেশ, শিক্ষার্থী সমাবেশসহ নানা কর্মসূচির আয়োজন করে। এর ধারাবাহিকতায় আজ সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক মিলনায়তনে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোঃ ইকবাল বাহার। সংগঠনের সভাপতি এস. এম. আবু তৈয়বের সভাপতিত্বে আয়োজিত সমাবেশে বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ শিপ হ্যান্ডলিং এন্ড বার্থ অপারেটরস্‌ এসোসিয়েশনের ভাইস চেয়ারম্যান এ, কে, এম, শামসুজ্জামান (রাসেল), চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পরিবহন মালিক গ্রুপের কার্যকরী সভাপতি ইকবাল মোঃ মনসুরুল করিম (নিপু), বাংলাদেশ জাতীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন (সিলেট-চট্টগ্রাম পূর্বাঞ্চলীয় কমিটি)’র সভাপতি ছিদ্দিকুল ইসলাম, চট্টগ্রাম প্রাইমমুভার ট্রেইলর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোঃ হুমায়ুন কবির, চট্টগ্রাম জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি উজ্জ্বল বিশ্বাস।