হাকালুকি হাওর থেকে প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে

0
105

বর্ষা মওসুমে হাকালুকি হাওর থেকে প্রতিনিয়ত লুট হচ্ছে নানা প্রজাতির মাছ। আর এ বাণিজ্য ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতা ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের ছত্রছায়ায় চলছে। তবে কৌশলটা ভিন্ন। হাকালুকি হাওরে ছোট-বড় ২৩৮টি বিল। বিলগুলো ইজারা দিয়ে সরকার প্রতি বছর রাজস্ব পায়। কিন্তু হাওরকে ঘিরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট চক্রের লুটের কারণে সরকার হারাচ্ছে হাকালুকিকাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আর ধ্বংস হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। মৌলভীবাজার জেলার জুড়ী-বড়লেখা-কুলাউড়া ও সিলেট জেলার ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ- এ ৬টি উপজেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত মিঠাপানির বৃহত্তম হাওর হাকালুকি। অভিযোগ রয়েছে এ উপজেলাগুলোর বাসিন্দারা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় বাণিজ্যের সিন্ডিকেট তৈরি করে অনেকটা নির্বিঘ্নেই হাকালুকি থেকে আহরিত মৎস্য ব্যবসা করছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি বড় সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে জুড়ী উপজেলার শাহাপুর, নয়াগ্রাম, খাকিয়াখা, গড়েরগাঁও, বেলাগাঁও ও খাগটেখা গ্রাম ঘিরে। এটা নিয়ন্ত্রণ করেন স্থানীয় পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্য ও আওয়ামী লীগ নেতা। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নওয়াবাজার খালের মুখ বাজারে তার লোকেরা জেলেদের কাছ থেকে হিসাব নিকাশ বুজে নেন। এছাড়া আশ্রুরী ঘাঠ যাত্রী ছাউনি বড় সড়কের পাশে রাত-দিন প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে হাকালুকির মাছ। কুলাউড়া ভুকশিমইল ইউনিয়নের মিরশংকর, সাদীপুর উত্তর, সাদীপুর দক্ষিণ, গড়করণ, বাদে ভুকশিমইল, মুক্তাজিপুর, জাবদা, শশার কান্দি ও বরমচাল, ভাটেরা ইউনিয়নের হাওর পাড়ের কয়েকটি গ্রাম। এ স্থানের আহরিত মাছের লেনদেন নিয়ন্ত্রণ করেন কুলাউড়া বাজারের ২-৩ জন মাছ ব্যবসায়ী। তেঘরী ঘাট বটগাছের নিচে ও জাবদা বাজারে সন্ধ্যার পর মাছগুলো বিক্রি হয়। এস্থানে আহরিত মাছ গাড়ি বোঝাই হয়ে ঢাকা ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় যায়। কৌশলে বড়লেখার হাওর পাড়ের তালিমপুর ইউনিয়নের গগরা, হাল্লা, ইসলামপুর, শ্রীরামপুর, নসীরাবাদসহ কয়েকটি গ্রামের জেলে পরিবারের লোকজনও হাওরে অবৈধভাবে মাছ শিকারে নিয়োজিত রয়েছে। এ এলাকার আহরিত মাছ গুলো কানোগো বাজার ও দাশের বাজারে বিক্রি হয়। জুড়ী, বড়লেখা ও কুলাউড়ার জেলেদের থেকে তথ্য মিলে এ কাজে বাদ পড়েনি অন্য ৫টি উপজেলার শিকারিরাও। সব উপজেলার হাওর পাড়ের শিকারিরা স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে কিংবা প্রভাবশালীদের চত্রছায়ায় মৎস্য নিধন করছে। ফলে শুধু যে মাছই নিধন হচ্ছে এমন নয় এরই সঙ্গে ধ্বংস হচ্ছে হাকালুকির জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও। হোগা (চাপিলা), চিংড়ি, দাড়কিনা, কাশখয়রা, মলা, চেলাপাতা, কেচকি ও তিতপুঁটি শিকারের নামে এসব মৎস্য শিকারী ও সিন্ডিকেট সদস্যরা শিকার করে নিচ্ছে সব ধরনের পোনা কিংবা ডিমওয়ালা মা মাছ। নিষিদ্ধ বেড় জাল ও কারেন্ট জাল দিয়ে এসব মাছ নিধন করা হয়। স্থানীয় বাসিন্দা ও জেলেদের দেয়া তথ্যমতে, জালের মালিকরাই মূলত সৃষ্টি করেছে টোকেন সিস্টেমের। টোকেন ছাড়া জাল দিয়ে মাছ ধরে ডাঙ্গায় উঠলেই মাছসহ ধরা পড়ে যেতে হয় উপজেলা মৎস্য অফিসে। সেখানে গিয়ে আর মাছ ধরবে না হাওরে এমন লোক দেখানো মুচলেকা দিয়ে টোকেন নিয়ে আবার একই পেশায় নামে ।
জেলেদের সূত্রে জানা যায়, একেকটা জালের সঙ্গে ২৫-৩০ জন করে শিকারি থাকেন। ২০০০ হাত জালে থাকে ৬০ থেকে ৭০ জন। শিকারিদের এসব জাল ৪০০, ৫০০, ১২০০ ও ২০০০ হাত লম্বা হয়ে থাকে। শিকারিদের সবচেয়ে ক্ষতিকারক জাল হচ্ছে তিতপুঁটি মারার কৌশলী জাল। স্থানীয়রা এ জালের নাম দিয়েছে বিষ জাল। এ জাল পেতে শিকারিরা ছোট ছোট মাছের পোনা ধরে, গলফা জাল দিয়ে শিকার করা হয় বড় বড় মাছ। শিকারিদের সঙ্গে জালের মালিকদের চুক্তি হল সব খরচ বাদে জালের ১ ভাগ, শিকারিদের ২ ভাগ। তাতে করেই শিকারিদের জনপ্রতি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা দৈনিক আয় হয়। হাওরের মধ্যে কত টাকার মাছ শিকার হল তার হিসাব রাখা হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে। জেলেরা জানায়, আর্থিক সুবিধা পাওয়ার কারণে এমন অবৈধ কাজে তাদের সাহস যোগান জালের মালিক ও স্থানীয় সরকার দলের অনেক নেতা। পুলিশ কিংবা মৎস্য বিভাগ তাদের না ধরতে তাদের দেওয়া হচ্ছে একটি বিশেষ টোকেন। এটাই তাদের হাওরের মাছ ধরার মূল পাস কার্ড। এটা থাকলে প্রশাসনের লোকেরা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনা। তারা জানায়, ৬ উপজেলায় হাওরে প্রতিদিন কোটি টাকার উপরে মাছ শিকার হচ্ছে। মাছ শিকার থেকে বিক্রয় সব কিছুই চলে নির্দিষ্ট নিয়মে। সব মাছ বড় শহরে ও রাজধানীতে চলে যায়। মাঝে মধ্যে হঠাৎ লোক দেখানো দু’ একটি অভিযান চালিয়ে তাদের গুরুদায়িত্ব পালন করে প্রশাসন। প্রশাসনের এমন আচরণ নিয়ে হাওর পাড়ের সচেতন মহলে ক্ষোভের অন্ত নেই। তবে এ বিষয়ে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের রয়েছে ভিন্নমত। তারা জানান, তাদের নানা প্রতিকূলতা থাকার পরও হাওরে তাদের অভিযান অব্যাহত থাকে। কেউ তাদের নামে টোকেন ব্যবসা চালালে এর দায়ভার তাদেরই নিতে হবে বলে তারা জানান। তবে এর সঙ্গে স্থানীয় মৎস্য বিভাগের কোন কর্মকর্তা কিংবা কর্মচারী জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে তারা আশ্বস্ত করেন।
শিকারি (ছদ্ম নাম) সালাম মিয়া (৪৫) ও তফুর আলী (৫০) সহ অনেকেই জানান, জীবিকার জন্য অন্য কোন উপায় না থাকায় বেআইনি জেনেও তাদের হাওরে মাছ শিকার করতে হচ্ছে। এব্যাপারে কুলাউড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. সুলতান মাহমুদ জানান, তিনি এখানে নতুন এসেছেন হাকালুকি হাওর থেকে এরকম কোন অবৈধ মৎস্য আহরণে টোকেন ব্যবসা সম্পের্কে তার জানা নেই। তবে যে সকল বিল লিজ যায়নি সে সকল বিলে অবৈধ ভাবে মাছ আহরণের খবর পেয়েছি। শিগগিরই সংশ্লিষ্ট অবৈধ মৎস্য শিকারিদের বিরুদ্ধে আইনুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।