হামদ-নাতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন নজরুল

0
158

মুসলিম জনগোষ্ঠীর নবজাগরণের প্রতীক-কাজী নজরুল ইসলাম।তিনি মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে কোরআন ও হাদিসের আলোকে লিখেছেন সাড়া জাগানো কালজয়ী ইসলামি গান, গজল ও হামদ-নাত।

বাংলা ভাষায় যে সব গীতিকার ইসলামি গান লিখেছেন, তাদের মধ্যে তার নাম সবার আগে চলে আসে। ইসলামের এমন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নেই, যা নিয়ে তিনি গান কিংবা কবিতা লেখেননি।

কাজী নজরুল ইসলাম লেখা প্রথম ইসলামী গান ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে’ এবং ‘ইসলামের ওই সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর’ যখন মরমী শিল্পী আব্বাস উদ্দীনের কণ্ঠে গ্রামোফোনে রেকর্ড হয়ে বাজারে বের হলো, তখন বাঙালি মুসলমানদের মনে সে কী প্রাণের জোয়ার!

দীর্ঘদিনের ঘুমন্ত নির্জীব মুসলমানরা যেন হঠাৎ করে জেগে উঠল নতুন কোনো এক জীয়নকাঠির পরশে। অনেক প্রতীক্ষার পর অনেক ক্লান্তি শেষে তারা যেন কাছে পেল তাদের নব মুক্তির আহ্বায়ককে।

কাজী নজরুলের ইসলামি গানের মূল ভিত্তিই ছিল কুরআন ও হাদিস। অনেক ক্ষেত্রেই সেই নির্যাস প্রায় অনুবাদের ভাষা।

হাদিসে বলা হয়েছে- ‘যদি তোমরা আল্লাহর ভালোবাসা পেতে চাও, তাহলে আমারই অনুসরণ করো, আল্লাহও তোমাদেরকে ভালোবাসবেন।’ কাজীর কথায় সেই নির্যাসই দৃশ্যমানে— ‘আল্লাহকে যে পাইতে চায় হজরতকে ভালবেসে, খোদার হাবিব শেষ নবী তুই হবি নবীর হবিব।’

আল্লাহর পরিচয় কি! তিনি কাছে, না দূরে থাকেন! তাঁকে চেনার উপায় কি! এসব বিষয় সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে নজরুল বলেছেন— ‘আল্লাহ যদিও ধরাছোঁয়ার বাইরে, তবুকে এই মহান সত্তাকে চেনা যাবে তার সৃষ্টিতে, তাঁকে অনুভব করা যাবে প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুতে। তিনি এক স্থানে বা এক বস্তুতে সীমাবদ্ধ নন, বরং আকাশ-জমিনের সর্বত্র তিনি বিরাজমান।’

আর এ জন্যই কবি আল্লাহর নির্দিষ্ট কোনো নাম খুঁজে পাননি।

আল্লাহর ৯৯টি গুনবাচক নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ‘অনামিকা’ নামে সম্বোধন করেছেন। কবি লিখেছেন— ‘কোন নামে হায় ডাকব তোমায় নাম না জানা অ-নামিকাজলে স্থলে গগন তলে তোমার মধুর নাম যে লিখা।’

তিনি আল্লাহর শ্রেষ্ঠ্যত্বের পাশাপাশি তার সৌন্দর্যও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন— ‘হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর তোমার মনোহর রূপের ছায়া, রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।’

নজরুল কেবল আল্লাহর সৌন্দর্যই বর্ণনাই করেননি, তাঁর ওপর ভরসা রাখারও আহ্বান জানিয়ে লিখেছেনে- ‘ও মন, কারো ভরসা করিসনে তুই এক আল্লাহর ভরসা কর, আল্লাহ যদি সহায় থাকেন ভাবনা কিসেব, কিসের ডর।’

আল্লাহ প্রেম হল সকল প্রেমের ঊর্ধ্বে। আল্লাহর প্রতি অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসাই জীবনের মূল মন্ত্র। ইসলামি গানে কবির ভাষায়— ‘আল্লাহ আমার প্রভু আমার নাহি নাহি ভয়, আমার নবী মুহাম্মদ, যাঁহার তারিফ জগৎময়।’ মাগো আমায় শিখাইলী কেন আল্লাহ নাম, জপিলে আর হুঁশ থাকে না ভুলি সকল কাম।’

আল্লাহ তায়ালা কোরআনে ঘোষণা করেছেন়- ‘লা খওফুন আলাইমিন’ অর্থাৎ তাদের (মুমিন মুসলমান) কোনো ভয় নেই। কবি আল্লাহর ঘোষণাকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন। তাই তিনি হাশরের মাঠে ভয়ে ভীত না হয়ে বরং আল্লাহর সাক্ষাতে খুশি হয়ে উঠবেন।

তার একটি ইসলামি গানে তিনি সেই কথাই বর্ণনা করেছেন – ‘যে দিন রোজ হাশরে করতে বিচার তুমি হবে কাজী, সে দিন তোমার দিদার আমি পাবো কি আল্লাজি, সে দিন নাকি তোমার ভীষণ কাহহার রূপ দেখে, পীর পয়গম্বর কাঁদবে ভয়ে ইয়া নফসি ডেকে, আমি তোমায় দেখে হাজারবার দোজখ যেতে রাজি।’

আল্লাহ প্রেমের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পেয়ারে নবীজী মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি ভালোবাসাও কবির ইসলামি গানে প্রতীক হয়ে উঠেছে। নবীজীকে নিয়ে তিনি নাত লিখেছেন ১০০র বেশি। নবীজীর প্রশংসা ও স্তুতিবাক্যে রচিত এই গানগুলির জন্য মুসলিম সমাজ তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ।

তিনি লিখেছেন- ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায় আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।’ ‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কি রে তোর কণ্ঠেরই গান এমন মধুর লাগে।’

নবীজীকে নিয়ে লিখা নজরুল ইসলামের আরও কয়েকটি বিখ্যাত সংগীত— ‘মুহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল।’ ‘তৌহিদেররই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম।’ ‘তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হযরত।’ ‘এ কোন মধুর শারাব দিলে আল-আরাবী সাকি।’ ‘মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে।’ ‘ইয়া মুহাম্মদ বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও’ ইত্যাদি ইত্যাদি।

কেবল আল্লাহ ও নবীজীর শানে সংগীত লিখে নজরুল ক্ষান্ত হননি। তিনি মুসলিম জাতির পরিচয়, তাদের অতীত, মুসলমানদের বিভিন্ন পর্ব ইত্যাদি নিয়ে চমৎকার সব গান লিখেছেন। মুসলমানদের পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘ধর্মের পথে শহীন যাহারা আমরা সেই সে জাতি, সাম্য-মৈত্রী এনেছি আমরা বিশ্বে করেছি জ্ঞাতি।’

নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ঈদ, কোরবানী, মহররম, রবিউল আউয়াল নিয়েও প্রচুর ইসলামি গান ও গজল লিখেছেন কবি। ঈদ নিয়ে তাঁর লেখা— ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এল খুশীর ঈদ’ এ গানটি না শুনলে ঈদের আনন্দই যেন অপূর্ণ থেকে যায়।

নবীজীর আবির্ভাবের আনন্দঘন দিনটি অর্থাৎ ১২ই রবিউল আউয়াল সম্পর্কে তিনি লিখেছেন— ‘আসিয়াছেন হাবিবে খোদা, আরশ পাকে তাই ওঠেছে শোর; চাঁদ পিয়াসে ছুটে আসে আকাশ পানে যেমন চকোর।’

‘ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর।’

কাজী নজরুল ইসলাম ইসলামি গজল ও গানে আমাদের যা দিয়েছেন তা অতুলনীয়। ইসলামি গানের ভাণ্ডার তিনি পূর্ণ করেছেন তার শক্তিশালী কলমের ডগায়। ইসলামের প্রতি তার গভীর অনুরাগ থেকেই তিনি ইসলামি গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন।

ইসলামের প্রতি তার ভক্তি-ভালোবাসা, শ্রদ্ধার প্রতিফলন দেখতে পাই, তিনি যখন আল্লাহর কাছে যাওয়ার ব্যাকুল আশায় মগ্ন, তখন তিনি লেখেছেন— ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন কবর থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।’