হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় প্রয়োজন বেসরকারি সংস্থা

0
183

 

অহিদুল আলম

 

বর্তমানে সিটি করপোরেশনের জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটা বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন ঘরবাড়ি, শিক্ষা-প্রতিষ্টান, অফিস-আদালত, কলকারখানা, হাসপাতাল, কাঁচাবাজার, কসাইখানা, শপিংমল এবং নির্মাণ প্রকল্প থেকে প্রচুর পরিমাণে ময়লা আবর্জনা উৎপন্ন হয়। দৈনন্দিন উৎপন্ন অধিকাংশই বর্জ্যই ক্ষতিকারক নয়, তাই এইগুলোকে সহজেই সংগ্রহ, রিসাইক্লিংএবংডাম্পিংকরাযায়।যেমন – প্লাস্টিক, ধাতব পদার্থ, কাগজ, প্যাকেজিং বস্তু, ছেঁড়াকাপড়, পলিথিন, রাবার এবং গ্লাস ইত্যাদি পরিশোধনের মাধ্যমে রিসাইক্লিংকরাযায়। তাছাড়াজৈব এবং তাপীয় পরিশোধনপদ্ধতিতেউদ্বৃত্তখাদ্য, কৃষি পণ্যের উচ্ছিষ্ট, কাঁচাবাজারের বর্জ্য এবং পশুর বর্জ্য ইত্যাদি থেকে জৈবসার, বায়োগ্যাস এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়।

 

কিন্তু শিল্প-কারখানার বর্জ্যে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ এবং ধাতু থাকে যা পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এছাড়াও ধারালো যন্রপাতির টুকরা এবং কাঁচ থাকে যা যেকোন সময় দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে। তাই এইসব বর্জ্যকে পৃথকভাবে এবং যথাযথপরিশোধনের মাধ্যমে ধ্বংস,ডাম্পিংএবংরিসাইক্লিংকরতে হয়। উপযুক্তপরিশোধনেরমাধ্যমেশিল্প-কারখানারবর্জ্যথেকেরাসায়নিকপদার্থ,ধাতুএবংবিদ্যুৎউৎপাদনকরাযায়।কিন্তুএইসববর্জ্যযদিসাধারণবর্জ্যেরসাথেমিশেযায়তখনসাধারণবর্জ্যকেওবিপজ্জনকএবংবিষাক্তকরেতুলে। তখন সাধারণ বর্জ্যও পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।

অনুরূপভাবেহাসপাতালের বর্জ্যে সংক্রামক জীবাণু এবং বিষাক্তরাসায়নিকপদার্থ থাকে যা স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরূপ। তাছাড়া ব্যবহৃতসিরিঞ্জ, সুঁচ, কাঁচের বোতল, গজ, ব্লেড এবং অপারেশনের যন্ত্রপাতি সতর্কতার সহিত সংগ্রহ না করলেসংগ্রহকারী আহত হতে পারে। বর্তমানে সিটি কর্পোরেশন হাসপাতালের বর্জ্যগুলো গৃহস্থালির বর্জ্যের সাথে সংগ্রহএবংডাম্পিংকরে।কিন্তু পরিবেশের অধিদপ্তরের ২০০৮ সালের আইন অনুযায়ী দণ্ডনীয় অপরাধ এবং উন্নত বিশ্বে ইহা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহের জন্য যেই কালার কোডিং দেওয়া আছে তাও কেউ মানে না।নিয়ম অনুযায়ী হাসপাতালের বর্জ্যগুলোকে নিজস্বইনসাইনেরেটরেরমাধ্যমেধ্বংস করে মাটিতে পুঁতে রাখতে হয়। কিন্তু কোন হাসপাতালই এই নিয়ম মানে না বরং তাঁরা নিজদের ইনসাইনেরেটরগুলোব্যবহারনাকরেসরাসরিহাসপাতালেরবর্জ্যগুলোসিটিকরপোরেশনের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।

 

 

এখনও পর্যন্ত, সারা দেশে হাসপাতালেরবর্জ্যসংগ্রহেরজন্যআলাদাকোনব্যবস্থানেই।তাইহাসপাতালেরবর্জ্যসাধারণবর্জ্যকেসংক্রামিতকরে।কিন্তুসাধারণজনগণএইবিষয়েসচেতননন,এমনকিহাসপাতালেরকর্মকর্তা, কর্মচারীএবংরোগীও।তাইজীবাণুবহনকারীবর্জ্যেরমাধ্যমেবিষাক্তজীবানুপরিবেশেছড়িয়েপড়ে যা পরবর্তীতে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।তাছাড়াসিটিকর্পোরেশন বর্জ্যের পরিমাণ কমানোর জন্য সংগৃহীত সাধারণ বর্জ্য এবং হাসপাতালের বর্জ্য উভয়কে একসাথে আগুনে পুড়াই ফলে তীব্র ক্ষতিকর বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থডাইঅক্সিন (C12H4Cl4O2) এবংফুরান (C4H4O) উৎপন্নহয়।তাই সাধারণ বর্জ্যের সাথে হাসপাতালের বর্জ্যের সংগ্রহ, ধ্বংস এবং ডাম্পিং করা পরিবেশ এবং স্বাস্থ্য উভয়ের জন্য ক্ষতিকর।

 

দারিদ্রতার কারণে এবং সচেতনতার অভাবে অনেক গরীব লোক এবং টোকায় হাসপাতালের বর্জ্য থেকে স্যালাইন ব্যাগ, ধাতব উপাদান, প্ল্যাস্টিক, কাঁচের উপাদান এবং প্যাকেজিং বস্তুসংগ্রহ করেস্ক্র্যাপ দোকানে বিক্রি করে। কিন্তু তারা কোন প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে না, এমনকি সংগ্রহীত পুনর্ব্যবহারযোগ্য ব্রজ্যগুলোকে পরিশোধনও করে না। ফলে তারা বিভিন্ন সংক্রামক রোগে ভোগে এবং যারা রিসাইক্লিং করা বস্তুগুলো ব্যবহার করে তারাও সংক্রমিত হয়।হাসপাতালের বর্জ্য রিসাইক্লিং এর মাধ্যমে নীরবে বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ এবং জীবাণু মানুষের শরীরে সংক্রামিত হয়।

 

বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ, তাই সিটিকর্পোরেশনকে সীমিত বাজেটের মধ্যে একত্রে অনেক কাজ করতে হয়। ফলেসিটিকর্পোরেশনেরপক্ষেবর্জ্যব্যবস্থাপনায়বেশিগুরুত্বদেওয়াসম্ভবনয়।এইজন্যহাসপাতালেরবর্জ্যব্যবস্থাপনারজন্যপ্রয়োজনবেসরকারিউদ্যোগ।দেরিহলেও,প্রদীপনবেসরকারিভাবেখুলনাশহরেপ্রথম২০০০সালেপৃথকভাবেহাসপাতালবর্জ্যব্যবস্থাপনারজন্যউদ্যোগনেয়।পরবর্তীতে, প্রিজম বাংলাদেশ (এনজিও) খুলনা এবং ঢাকা শহরে ২০০২ সালেমাসিক চার্জের ভিত্তিতে হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করে। অনুরূপভাবে, ঢাকায়আন্তর্জাতিকডায়রিয়ারোগগবেষণাকেন্দ্র, বাংলাদেশ (ICDDR, B) হাসপাতালের সংক্রামক বর্জ্যনিজস্ব  ইনসাইনেরেটরেরমাধ্যমেধ্বংসকরারকার্যক্রমশুরুকরে।রাজশাহী শহরে অনুরুপ কার্যক্রম শুরু হয় সিটিকর্পোরেশনএবংরাজশাহীমেডিকেলকলেজহাসপাতালেরযৌথউদ্যোগে।সর্বশেষচট্রগ্রামশহরেইনোভেশনসেবাসংস্থা নামে বেসরকারি সংস্থা ২০১১সালেপৃথকভাবে হাসপাতালের বর্জ্য সংগ্রহ, পরিশোধন এবং ধ্বংস উদ্যোগ নেয়।

 

 

অনেক হাসপাতাল বেসরকারি সংস্থার সেবাকে তাদের দৈনন্দিন উৎপন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য গ্রহণ করেছে।কারণ তাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় মনোযোগ দেওয়ার সময় নেই। কিন্তুবেসরকারিসংস্থাবেশিলাভেরজন্যসঠিকভাবেবর্জ্যসংগ্রহ,পরিশোধনএবংধ্বংসকরে না। ফলে প্রথাগত উপায়ে হাসপাতালের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে। অথচ মাঝখানে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। বর্তমানে বেসরকারিসংস্থাগুলোরসেবাএবংসিটিকর্পোরেশনেরসেবারমধ্যেশুধুমাত্রকভারভ্যানেরব্যবহারব্যতীততেমনকোনপার্থক্যনেই।তাইহাসপাতালগুলোবেসরকারিসংস্থারসেবাকেগ্রহণ করতে আগ্রহ হারাচ্ছে। তাছাড়া মাসিক চার্জ বেশি হওয়ায় কম আয়ের হাসপাতাল এবং ক্লিনিকগুলো বেসরকারিসংস্থারসেবানিতেচাচ্ছেনা।অপরদিকেবেসরকারিসংস্থাগুলোওতাদেরসীমাবদ্ধতারজন্যবেশিবর্জ্যউৎপাদনকারীহাসপাতালগুলোকেসেবাদিচ্ছেনা।

 

যাই হউক, বেসরকারিসংস্থা হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকার এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে যথেষ্ট সাড়া পেয়েছে কিন্তু তাদের সেবার মান যথাযথ না হওয়া এবং বেশি চার্জ নেওয়ার জন্য জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। কিন্তুবেসরকারিসংস্থাকে হাসপাতাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দিলে যেমন সঠিকভাবে এবং নিরাপদে হাসপাতালবর্জ্যসংগ্রহ,পরিশোধনএবংধ্বংসকরা যাবে,তেমনি সিটি কর্পোরেশনের খরচও কমবে। তাই বেসরকারিসংস্থাকে হাসপাতালেরবর্জ্যব্যবস্থাপনারকাজেনিয়োজিতকরাসময়ের উপযুক্ত চাহিদা। তাছাড়া বেসরকারি সংস্থাকে হাসপাতাল থেকেমাসিকচার্জ, বর্জ্যসংগ্রহ,পরিশোধনএবংধ্বংসকঠোরনির্দেশনাপ্রদান করাউচিত।সিটিকর্পোরেশন, স্বাস্থ্যঅধিদপ্তরএবংপরিবেশঅধিদপ্তরেরযৌথউদ্যোগেতাদেরকাজনিয়মিতপর্যবেক্ষণকরাএবং পরামর্শ দেওয়া দরকার।

 

লেখক: অহিদুল আলম বর্তমানে ইস্ট চীন ইউনিভার্সিটি অফ সাইন্স এন্ড টেকনোলজিতে সলিড ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট এবং রিসোর্স রিকভারি বিষয়ে পিএইচডি গবেষণারত আছেন। [email protected]