হয়তো বড়লোকরা ঈদ করছে

0
77

হাসান আজিজুল হক |
ঈদ নিয়ে কথা বলা এক ঝক্কির ব্যাপার। আবার সবদিক বিবেচনা করে কথা বলাও মুশকিল। কিন্তু আমি জানি না, আমাদের যে ধর্ম, ইসলামের কথাই বলছি, তা কতটা প্রাণের মধ্যে মনের মধ্যে কতটা ধারণ করেছি আর কতটা যে প্রদর্শন করছি সেটা নিয়ে মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়। কারণ দেশে যেভাবে অপরাধপ্রবণতা আর অপরাধ বেড়েছে, কারণ ধর্মের নামে যে বিভৎস কাণ্ডকারখানা চলছে তাতে মনে হয় বর্তমান পৃথিবীর ওপর থেকে আমার আস্থা চলে গেল। বর্তমান পৃথিবীটা মানুষের পৃথিবী বলে আর মনে হয় না। বাংলাদেশ সম্পর্কে একই কথা মনে হয়, নানা ভাবে অপরাধ চাষ হচ্ছে। কেউ ধর্মের নামে করে কেউ ধর্ম বাদ দিয়ে করে, প্রতিনিয়ত অপরাধ সংগঠিত হচ্ছে। অসহ্য ব্যাপারগুলো হচ্ছে। এগুলো দমন করার জন্য নৈতিকভাবে যা করা দরকার তাহলো আমাদের দেশে যে সম্পদ আছে তার সুষম একটা বন্টন, সুষম একটা ব্যবস্থা। আমাদের রাজনীতিতে তা একেবারেই নেই। তাই এর বাইরে ঈদ বলতে আর কী হবে। হয়তো বড়লোকরা ঈদ করছে। বিরাট ব্যাপার হচ্ছে। আমরা তো জানি প্রোগ্রাম-টোগরাম কোনো কোনো অঞ্চলে প্রচলিত আছে। কী রকম মেজবান-টেজবান তারা করছে কোরবানীতে, ঈদে বারোটা-চব্বিশটা গরু জবাই করে। কিন্তু কী হয়েছে? তাদের ভেতর থেকে আমরা কেমন মানুষ পেয়েছি? ঈদে এলে বাল্যকালে যে আনন্দ অনুভব করতাম তাতে ফিরে যাই। তখন যেভাবে আঁতর মাখা হতো, আমাদের বাড়িতে কামাল আতাতুর্কের যে টুপি ছিল—গোল ও বড়, ঝালর দেয়া—তা মাথায় দিয়ে, পা-জামার সঙ্গে শার্ট বা জামা পড়ে গ্রামের বাইরে হাঁটতাম। তখন উৎসবের ভেতর সম্প্রীতির অনুভব ছিল।
তো এখন আনন্দ দেখি না কিন্তু। আমি কোনো কোনো বছর ঈদের ঠিক নামাজের পরই গাড়ি নিয়ে গ্রামের ভেতরে ঢুকে যাই। আশ্চর্য ব্যাপার, মনে হয় এমন নিরানন্দের ব্যাপার আর হয় না। কেউ কোথাও নেই, কেমন নিঝুম হয়ে রয়েছে। কোনো কোনো চায়ের দোকানে তিন-চারজন লোক টুপি মাথায় বসে রয়েছে। গল্প-গুজব করছে, কথা-বার্তা বলছে, এই পর্যন্তই।
দুই বছর আগে আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে দেখি লোকে লোকারণ্য। প্রচুর লোক। ভাবলাম এদের ঈদ উদযাপনটা তো ভাল। পরে বুঝলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক আছে তারাই ঈদের জামা পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে গিয়েছে আরকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে আশেপাশে যে গ্রাম আছে, ওদিকে পদ্মা তীর পর্যন্ত, কোনো গ্রামে আমি উৎসবের ছোঁয়া পেলাম না। আমার দিক থেকেই এমন মনে হয়েছে কি না আমি জানি না।

তারপরও সমস্ত কিছুর ওপর নির্ভর করে মানুষের শিক্ষা, অর্থনৈতিক কাঠামো, অবস্থা ইত্যাদি। কাজেই উৎসব কী করে হয়। এই তো গতকাল আমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি ডাক্তার নেই। কেন নেই? বলে যে, আগের দিন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আত্মহত্যার ঘটনা যে ঘটেছে সেই লাশটা এখনো মর্গে আছে তার পোস্ট মর্টেম হবে। কাজেই ডাক্তার ব্যস্ত আছে।
উৎসব বলতেই তার ভেতরে আনন্দের যে বিষ্ফোরণ সেটা বোধ হয় ক্রমেই কমে গেছে বলে আমার ধারণা। ধর্মের আমরা যে ব্যবহার করছি, তাতে মানুষ কী বলবে বল। খুন করবো, হেন করবো। করছেও তো। মানুষ ভয়ে ভয়ে থাকছে।
এর মধ্যে ঈদের উৎসব আসবে কোত্থ থেকে। আমার শৈশব এখানে ডানা মেলবে কি করে।
এর পাশাপাশি আছে মানুষের বস্তুমুখী হওয়ার মানসিকতা। পোশাকের জন্য আত্মহত্যার খবরও আমরা পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের উৎসব, সম্প্রীতি কোথায় যাচ্ছে, সেই প্রশ্নটি বারবার সামনে আসছে। আমরা একটা ধরতাই কথা বলছি, ঈদ মানে উৎসব। আগে ঈদ উপলক্ষে গ্রামে গ্রামে মেলা বসতো। মেলায় গেলেই ভাল লাগতো। কত মানুষ আসে। কত কি জিনিস বিক্রি করে। ছোটবেলা আমি এরকম মেলাতে মেলাতে মেলাতে মেলাতে ঘুরে বেড়িয়েছি। আনন্দের অন্ত ছিল না।
দু’বছর আগে ঈদের দিনে এক গ্রামে গিয়েছিলাম। দেখলাম রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে দু-তিনটি দোকান। একটা বাদাম বিক্রি করছে, আরেকটায় লাড্ডু আর পাশেরটায় শিশুদের বাঁশি-বেলুন আছে। এই তো। হয়ে গেল মেলা!

এইগুলো বাদ দিয়ে আমরা কবে আনন্দের মুহূর্ত তৈরি করতে পেরেছি? বিজয় দিবসে কথা বলি, স্বাধীনতা দিবসের কথাই বলি আর একুশে ফেব্রুয়ারির কথাই বলি। একুশের ফেব্রুয়ারিকে ধরে ভাগ্যিস বাংলা একাডেমিতে একটা বইমেলা হয়েছিল। তাই ওটা একটা দিন হয়েছে। তার মানে একুশের আলাদা একটা গুরুত্ব জাতির সামনে দাঁড়িয়েছে ওই বইমেলা কারণেই।
এসব দুএকটা বড় অনুষ্ঠান বাদে সামাজিক সম্প্রীতি ও সামাজিক লেনদেন অনেকটাই কমে গেছে। যে যা করে, তারই পুনাবৃত্তি করে বেঁচে থাকে–এই অবস্থা হয়েছে। যে কারণে ঈদগুলো ঈদ থাকে না, উৎসবগুলো উৎসব, মেলাগুলো মেলা থাকে না। যেটুকু থাকে তা যারা একটু বড়লোক তাদের ভেতর ছিটেফোঁটা আছে। সেখানে পরস্পরের বাড়ি যাওয়া হচ্ছে, খাওয়া-দাওয়া হচ্ছে, জামা কাপড়ের বাহার হচ্ছে।